নির্বিচারে মুসলিম নিধনের নাম ওয়ার অন টেরোরিজম

গত ৭ এপ্রিল অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সাথে এনজিও প্রতিনিধি দলের এক প্রাক-বাজেট বৈঠকে এনজিও নেতৃবৃন্দ মাদ্রাসা শিক্ষায় বাজেট কমানোর অনুরোধ করে বলেন, ‘দেশে যে জঙ্গিবাদ-মৌলবাদের উত্থান ঘটছে তার প্রধান কারণ মাদ্রাসা শিক্ষা। দরিদ্র পরিবারের ছেলে-মেয়েদের দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে জঙ্গি শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। মাদ্রাসা শিক্ষায় মোটা অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে। এই শিক্ষার নামে আমরা আমাদের ছেলে-মেয়েদের জঙ্গি বানাচ্ছি কি না তা ভেবে দেখার সময় এসেছে।’ এর জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘কওমী মাদ্রাসা অ্যান্ড ইটস সিস্টেমস আর টেরিবলি ডেঞ্জারাস।’

এই লেখা যখন লিখছি অর্থাৎ ১৭ এপ্রিল সকালে টেলিভিশনে ব্রেকিং নিউজে দেখাচ্ছে গতরাতে দিনাজপুরের হাজি মুহম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্র“পের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সশস্ত্র যুদ্ধে দু’জন নিহত এবং অপর দশজন আহত হয়েছে। গত দুই-তিন দশকে বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের দ্বন্দ্ব, কিম্বা সংগঠন দুইটির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে যেভাবে প্রকাশ্যে একে-৪৭সহ বিভিন্ন ভয়ানক আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শনের ভিডিও ও স্থিরচিত্র গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, সেরকম অস্ত্র বা দ্বন্দ্বের শতকরা একভাগ ঘটনাও কি বাংলাদেশের কোনো মাদ্রাসাতে দেখা গিয়েছে? কিম্বা পুলিশি তল্লাশিতে সাধারণ শিক্ষার সর্বোচ্চ এসব প্রতিষ্ঠান থেকে যেসব আগ্নেয়াস্ত্র, ইয়াবা, ফেনসিডিল, কনডম, যৌন উত্তেজক নানা সামগ্রী উদ্ধার করা হয়েছে তা কি বাংলাদেশের কোনো মাদ্রাসাতে পাওয়া গেছে? এসব প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিয়ত ধর্ষণসহ নারী নির্যাতনের যেসব ঘটনা ঘটেছে তার শতাংশের একভাগও কি কোনো মাদ্রাসায় ঘটে? প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেভাবে নারীদের উপর যৌন নিপীড়ন হয় তা কি কোনো মাদ্রাসার ক্যাম্পাসে হয়েছে, নাকি ওইসব ঘটনার সাথে মাদ্রাসার কোনো ছাত্রের সংশ্রব পাওয়া গেছে? সন্ত্রাস, খুন, গুম, ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন, নারী ও মাদক ব্যবসার এমন সহ¯্র জ্বলন্ত উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও কেউ এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের বা বাজেট কমানোর দাবি করে না। তাদের কাছে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘যা কিছু ঘটে গিন্নী বলেন কেষ্টা বেটাই চোর’। যদি জেএমবি থেকে শুরু করি তাহলে দেখতে পাবো, জেএমবির প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আবদুর রহমান মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন।

সেকেন্ড ইন কমা- বাংলাভাই বাংলাভাষা-সাহিত্যের ছাত্র ও শিক্ষক ছিলেন। সামরিক প্রধান আতাউর রহমান সানি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। এমনকি আজকের আলোচিত ‘জঙ্গি সংগঠন’ আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ১,২,৩ৃ, আল্লাহর দল, জঙ্গি অভিযোগে সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হিজবুত তাহরীর মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন নয়। এসব সংগঠনের সদস্য অভিযোগে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তারা বুয়েট, মেডিকেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আইবিএ ইনস্টিটিউট, নর্থসাউথ, ব্রাকের মতো নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বাংলাদেশের তথাকথিত জঙ্গিবাদবিরোধীদের মুখে একদিনের জন্যও এসব বিশ্বাবিদ্যালয় বন্ধ করার কোনো দাবি শোনা যায়নি। এতে বোঝা যায়, সন্ত্রাস বন্ধ করা তাদের লক্ষ্য নয়, ইসলামী শিক্ষা বন্ধ করাই তাদের মূল লক্ষ্য। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বেই তথাকথিত জঙ্গিবাদের সাথে জড়িত শীর্ষ নেতারা মাদ্রাসা শিক্ষার প্রোডাক্ট নয়। আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন, আইম্যান আল-জাওয়াহিরী কিম্বা আজকের আলোচিত আইএস ফোর্সের শীর্ষনেতারা সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত। জঙ্গিবাদের সাথে জড়িতদের পেশাভিত্তিক আন্তর্জাতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রকৌশল পেশা থেকে সবচেয়ে বেশি জঙ্গি সৃষ্টি হয়েছে। গত দুই দশকে আল-কায়েদা বা আইএসসহ বিশ্বের নামকরা জঙ্গি সংগঠনগুলোর শীর্ষস্থানীয় পদগুলোতে কোনো বাংলাদেশীকে দেখা যায়নি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, ইউরোপ আমেরিকা থেকেই প্রায়শই যুবক-যুবতীরা আইএসে যোগ দেয়ার জন্য পাড়ি জমাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। এর মধ্যে রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী। লন্ডনের কিংস কলেজের প্রভাষক ক্যাথরিন ব্রাউন এবং কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন। তিনি মনে করেন, পাশ্চাত্যের নারীদের দুটি বিকল্পের একটি গ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়, যা কিনা যথার্থ নয়। হয় তারা অধিকার ও নারীবাদের স্বীকৃতি পেয়ে থাকে, না হয় ‘প্রথা’ ও ‘ধর্ম-বিশ্বাস’। দুটোই একসঙ্গে পাওয়ার দাবি করা বৃথা। কারণ, তাদের নিজস্ব সম্প্রদায়গুলোর পাশাপাশি দেশের মূল ¯্রােতোধারার জনগোষ্ঠীও সেটাকে অযৌক্তিক হিসেবে দেখে থাকে। এই সুযোগটাকেই কাজে লাগাচ্ছে আইএস।

তারা পাশ্চাত্যে নারীর মর্যাদা নিয়ে অনবরত প্রশ্ন তুলছে। সবচেয়ে বেশি আলোকপাত করা হচ্ছে, ঘরের কাজ ও বাইরে বেতনভুক্ত চাকরি নিয়ে মনে সৃষ্ট দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, ধর্ষণের সংস্কৃতি, পর্নোগ্রাফি, বর্ণবাদ ইত্যাদি বিষয়ের ওপরে। ব্রাউনের মতে, আইএসের কাছে নারী ও পুরুষ সমান নয়। তারা পাশ্চাত্যের উদার নারীবাদি মতাদর্শকে মানে না। আইএসের ‘রাষ্ট্রে’ নারীদের খুব সামান্যই বাইরে বেরোনো, কাজ করা বা অন্যান্য প্রকাশ্য ভূমিকা পালনের সুযোগ আছে। আইএসের ভেতরে বিবাহের মানে দু’জন মানুষের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্কের চেয়ে অনেক বেশি কিছু। সেখানে ব্যক্তিগত কিছু চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে যুক্ত আছে সুন্দর জীবনের ধারণা; আছে এক ও অভিন্ন লক্ষ্য। এর লক্ষ্য হচ্ছে ইসলামভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলা। যেসব পশ্চিমা তরুণী সিরিয়া ও ইরাকে যাচ্ছে, তাদের লক্ষ্য নতুন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা জননীর ভূমিকা পালন করা। এটা ইউরোপে বসবাসরত তরুণী মুসলিমদের সম্পর্কে আজ যে নেতিবাচক সর্বজনীন ধারণা বিরাজমান, তার বিপরীত। ব্রাউনের এই গবেষণা থেকে দেখা যায়, মাদ্রাসা শিক্ষা বা ইসলাম নয়, বরং পাশ্চাত্যের অন্তঃসারশূন্য শিক্ষা ও সমাজ ব্যবস্থার প্রতি বিতৃষ্ণা থেকেই সেখানকার তরুণ-তরুণীরা জঙ্গী সংগঠনে যোগ দিচ্ছে। বলা হচ্ছে, আইএস ইসলামী খেলাফত। কিন্তু আইএসের কর্মকা-, মধ্যপ্রাচ্যের আজকের ভৌগলিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, এটি ইসলামবিরোধী শক্তির স্বার্থের পরিপূরক ইসলামের নামধারী পাশ্চাত্যের স্বার্থ রক্ষাকারী একটি সংগঠন।

অতীতে আমরা দেখেছি মার্কিন সরকার যখনই বিপদে পড়েছে তখন তাকে রক্ষায় আল-কায়েদা নেতাদের ভিডিও, অডিও ক্লিপ প্রচার করতে। কিন্তু আল-কায়েদার প্রয়োজনীয়তা কমে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী ক্লিনটন গণমাধ্যমে বলেন, আল-কায়েদা আমেরিকার সৃষ্টি। একইভাবে যেদিন আইএসের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে সেদিন ভবিষ্যতের কোনো মার্কিন রাষ্ট্রপ্রধান বা অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়তো বলবেন, আইএস ইসলামী খেলাফত ছিল না, মার্কিন খেলাফত ছিল। আবার বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যখন আল-কায়েদাকে ব্যবহারের লক্ষ্যে তাকে অস্ত্র সরবরাহের প্রয়োজন হয়ে পড়ে তখন আল-কায়েদার নাম সন্ত্রাসীর তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়। এদিকে ইয়েমেনে শিয়া বিদ্রোহী হুতিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়েও আল-কায়েদাকে ব্যবহার করা হচ্ছে। অর্থাৎ পাশ্চাত্যের প্রয়োজনে আল-কায়েদা জঙ্গি নয়, পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে গেলেই জঙ্গি।

সকলে জানে, আফগানিস্তানে রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করতে সারা বিশ্ব থেকে মুসলিম জিহাদীদের জড়ো করে ভারত ও পাকিস্তানের মাটিতে প্রশিক্ষণ দিয়ে আফগানিস্তানে প্রেরণ করার কাজে মার্কিন যুক্তরাষ্ট প্রধান পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকা পালন করেছে। আবার সে-ই আফগানিস্তানে রাশিয়ার পতনের পর হাজার হাজার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অস্ত্রধারী জিহাদীকে কোনো প্রকার পুনর্বাসন ছাড়াই ফেলে রেখে যায় আফগানিস্তানের যুদ্ধভূমে। তখন যদি তাদের নিরস্ত্র করে পুনর্বাসনের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা হতো তাহলে আজকের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। কিন্তু তা না করায় আফগান যুদ্ধোত্তর কালে জিহাদীদের অনেকে ফিলিস্তিন, কাশ্মিরসহ বিশ্বের বিভিন্নস্থানে নির্যাতিত মুসলমানদের মুক্তির লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু করতে ছড়িয়ে পড়ে। ¯œায়ুযুদ্ধোত্তরকালে এইসব জিহাদী সহসায় ইসলামের প্রতিপক্ষ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যকে সামনে পেয়ে যায়। ফলে তারা আঘাত শুরু করে পাশ্চাত্যের স্বার্থের বিরুদ্ধে। শুরু হয় জিহাদের নতুন পর্ব। এমন প্রেক্ষাপটে নাইন-ইলেভেনের ঘটনা ঘটে। পাশ্চাত্য মুসলিম জিহাদীদের বিরুদ্ধে চরম ব্যবস্থা গ্রহণে মরিয়া হয়ে ওঠে। জিহাদী নেটওয়ার্কের কমান্ড ভেঙে পড়ে। এসময় জ্ঞাতে, অজ্ঞাতে পাশ্চাত্যের কাউন্টার টেররিজমের ফাঁদে পা দিয়ে বিচ্ছিন্ন সংগঠনসমূহ এমনসব কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ে যাকে জিহাদ না বলে সন্ত্রাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইসলামবিরোধী শক্তিগুলো মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা ও ইসলামকে নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে জঙ্গিবাদ বা টেররিজম নামক কনসেপ্টকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। এ লক্ষ্যে তারা মুসলিম দেশগুলোতে ইসলামী নাম দিয়ে গড়ে তুলেছে অনেক সন্ত্রাসী সংগঠন। লোভী, নামধারী, বিপথগামী, খারাপ ও এজেন্ট মুসলমানদের তারা এই সংগঠনের নেতৃত্বে বসিয়ে দিয়েছে। এই সংগঠনগুলো বিভ্রান্ত হয়ে, পরিচালকের গোপন নির্দেশে, কিম্বা লোভের বশবর্তী হয়ে পাশ্চাত্যের নির্দেশিত পন্থায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

আর এটাকেই অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে পাশ্চাত্যের ইসলামবিরোধী শক্তিগুলো জঙ্গিবাদ নির্মূলের নামে মুসলমাদের উপর নির্বিচারে বোমা, মিসাইল মারছেÑ যার নাম দিয়েছে তারা ওয়ার অন টেররিজম বা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমেরিকার পরিচালিত যুদ্ধে ইরাক, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে এ পর্যন্ত ১৩ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে। গত ২৫ মার্চ নোবেল প্রাইজ উইনিং ইন্টারন্যাশনাল ফিজিশিয়ান্স ফর দ্য পিভেনশন অভ নিউক্লিয়ার ওয়্যার, ফিজিশিয়ান ফর স্যোশাল রেসপন্সিবিলিটিস ও ফিজিশিয়ান্স ফর গ্লোবাল সারভাইবালস প্রকাশিত ‘বডি কাউন্টস, ক্যাজুয়াল্টি ফিগারস আফটার টেন ইয়ারস অভ ওয়্যার অন টেররিজম’ শীর্ষক রিপোর্টে এ তথ্য দেয়া হয়েছে। রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, প্রকৃত সংখ্যা এর থেকে কমপক্ষে ১০ গুণ অর্থাৎ এক কোটি ত্রিশ লাখ। সূত্র প্রেসটিভি। ইরাক, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের উপর ভিত্তি করে এই সংখ্যা নিরূপণ করা হয়েছে। বিশ্বের অন্যত্র সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধে কত লোক নিহত হয়েছে তার সংখ্যা যোগ করা হয়নি এই রিপোর্টে। তাছাড়া এই যুদ্ধে পাশ্চাত্যের কতজন সৈন্য ও নাগরিক নিহত হয়েছে তার সংখ্যাও এর মধ্যে যোগ করা হয়নি। শুধুমাত্র আক্রান্তদের উপর নির্ভর করেই এই সংখ্যা নিরূপণ করা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, আমেরিকানদের বলা হয়েছে ইরাক যুদ্ধে মাত্র ৯৯০০ ইরাকি প্রাণ হারিয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ আমেরিকান বিশ্বাস করে প্রকৃত সংখ্যা উল্লেখিতের চেয়ে কমপক্ষে ১০০গুণ বেশি। রিপোর্টেও সূত্রেই বলা যায়, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধে পাশ্চাত্য ইরাক, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে এক দশকে ১ কোটি ৩০ লাখ মুসলমানকে হত্যা করেছে। দু’টি বিশ্বযুদ্ধেও এত বিপুল পরিমাণ প্রাণহানি ঘটেনি। কিন্তু আমেরিকাকে যুদ্ধাপরাধীর কাঠগড়ায় কেউ দাঁড় করাচ্ছে না। কারণ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে তা করা হয়েছে। সেকারণেই বলা হয়েছে, মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা করা এবং ইসলামকে নিয়ন্ত্রণ করার কনসেপ্ট বা তত্ত্বের নামই টেররিজম। এটি এমন এক টার্মিনোলজি যা মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যার লাইসেন্স তুলে দিয়েছে পাশ্চাত্যের ইসলামবিরোধী শক্তির হাতে। সেকারণেই আমরা ইসলামবিরোধী শক্তিগুলোকে নিজ দেশে জঙ্গিবাদবিরোধী ও প্রতিপক্ষের দেশে জঙ্গীবাদের সহায়ক বা পৃষ্ঠপোষক হিসেবে দেখতে পাই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাংলাদেশী ছাত্র নাফিস প্রেমে ব্যর্থ হয়ে যখন আত্মহত্যার পথ খুঁজছিল। মার্কিন কাউন্টার টেররিজমের অপারেটররা তাকে বোঝালো, তুমিতো মরবেই। কিন্তু এমন কাজ করে মরো যাতে আখিরাতে তুমি মুক্তি পাবে। দিনের পর দিন কাউন্টার টেররিজমের অপারেটরদের মগজ ধোলাইয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে নাফিস। এরপর অপারেটররাই তাকে নকল বিষ্ফোরক দিয়ে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে বোমা হামলা চালাতে বলে, আবার তারাই তাকে অ্যারেস্ট করে। প্রশ্ন হচ্ছে, প্রেমে ব্যর্থ নাসিফ হয়তো আত্মহত্যার জন্য ফ্যানের সাথে ঝুলতো, কীটনাশক পান করতো, ছাদ থেকে লাফ দিতো, কিম্বা রাস্তায় গাড়ির নিচে লাফ দিতো। কিন্তু ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে বোমা হামলার কথা কখনো ভাবতো না। তাহলে কে তাকে জঙ্গি বানালো? ‘দ্যা কান্ট্রি মেড হিম অ্যা টেররিস্ট।’

বাংলাদেশে যেমন প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ইসলামী কিতাব মানেই জিহাদী বই, তেমনি পাশ্চাত্য ইসলামী নাম দিয়ে দাড়ি টুপিওয়ালা সন্ত্রাসী ভাড়া করে বোমা মেরে, মানুষ মেরে তাদের টেররিস্ট বলছে। মূলত জিহাদকে কনডেম করতে, তা থেকে মুসলমানদের দূরে সরিয়ে দিতেই এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে ইসলামবিরোধী শক্তিগুলো। এ ক্ষেত্রে তারা অনেকাংশে সফল হয়েছে। মুসলিম বিশ্বের অনৈক্য, অভিন্ন নেতৃত্বের অনুপস্থিতি ও বিভ্রান্তি, হতাশা, ভোগবাদি সংস্কৃতির প্রভাব এজন্য বিশেষভাবে দায়ী। জিহাদের সঠিক ব্যাখ্যা ও ব্যবহার মুসলিম বিশ্বে অনুপস্থিতিও এর বড় কারণ।

পাশ্চাত্যের ইসলামবিরোধী শক্তিগুলো ইসলামী নামযুক্ত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে ঢালাওভাবে জিহাদী আখ্যা দিচ্ছে। কিন্তু কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের নাম ইসলামী হলেই সে সংগঠন জিহাদী হয় না। যেমন কারো নাম মুজাহিদুল ইসলাম হলে তিনি ইসলামের মুজাহিদ না হয়ে কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতিও হতে পারেন। আবদুর রব নামধারী ব্যক্তি রবের বা আল্লাহর গোলাম না হয়ে বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্রের রাহাবার হতে পারেন। ঠিক তেমনি আসারুল্লাহ বাংলা বাহিনী আল্লাহর আনসার না হয়ে আনসারুল ইবলিস হতে পারে। আল্লাহর দল নাম নিয়ে যে কেউ শয়তানের পায়রবি করছে না তার তদন্ত বর্তমান কাউন্টার টেররিজম করে না। কেননা কাউন্টার টেররিজম পরিচালিত হয় পাশ্চাত্যের থিওরি ও প্রশিক্ষণে। কাউন্টার টেররিজমের অপারেটররা এমনভাবে ঘটনা ঘটান যাতে, আপাতদৃষ্টিতে ইসলামপন্থীদের উপর দোষ চাপানো সহজ হয়। এটি নতুন কোনো কৌশল নয়। ইসলামের বিরুদ্ধে এরকম ঘটনার অনেক প্রমাণ ইতিহাসে বর্ণিত রয়েছে। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদা খ্যাত সূর্যসেন চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করেন। তিনি এই দিনটিকে বিশেষভাবে বেছে নেয়ার কারণ এদিন চট্টগ্রামে সর্ব ভারতীয় মুসলমানদের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। এই সম্মেলন উপলক্ষে ৬০০ সদস্যের এক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তোলা হয়। তাদের চেনার জন্য বিশেষ পোশাক ও মাথায় পরিধানের জন্য তুর্কি টুপি তৈরি করা হয়। সূর্যসেনের বাহিনী অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সময় একই ধরনের পোশাক ও টুপি পরিধান করে এবং পালাবার পথে এ সকল পোশাক ও টুপি ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় যাতে ব্রিটিশ সরকার অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের জন্য মুসলমানদের দায়ি করে তাদের বিরুদ্ধে অপরেশন পরিচালনা করে।

শুরুতে সূর্যসেনের পরিকল্পনা মতো ঘটেছিলও তাই। তবে তৎকালীন বিভাগীয় ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা খান বাহাদুর আহসানউল্লাহর তদন্তে প্রমাণিত হয় মুসলমানরা নয়, এটি সূর্যসেনের বাহিনীর কাজ। এ বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যকে মাথার উপর গীতা রেখে বুকের রক্ত কালীদেবীর পায়ে অঞ্জলী দিয়ে শপথ নিতে হতো। খান বাহাদুর আহসানউল্লাহর তদন্তে সূর্যসেনের নাম প্রকাশ পাওয়ায় তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে তার বিশ্বস্ত অনুচর হরিপদ ভট্টচার্যকে তাকে হত্যার মিশনে প্রেরণ করেন। ১৯৩১ সালের অক্টোবর মাসে খুব কাছে থেকে গুলি করে হরিপদ খান বাহাদুর আহসানউল্লাহকে খুন করে। বর্তমানে জঙ্গিবাদের নামে এ ধরনের ঘটনা যে ঘটছে না কিম্বা মন্দিরে মূর্তি ভাঙার পর মুসলিম ব্যক্তি ও সংগঠনের নাম দিয়ে যে পোস্টার রাখা হয় তা আসলে কারা করছে তা প্রমাণ করার জন্য খান বাহাদুর আহসানউল্লাহর মতো অফিসারদের অভাব রয়েছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদবিরোধী অপারেশনের চিত্র বোঝানোর জন্য একটি গল্পের সাহায্য নেয়া যায়। দু’টি কিশোর মাদ্রাসা ছাত্র হেঁটে যাচ্ছে। তাদের পেছনে ঝুলানো ব্যাকপ্যাক দেখে পুলিশের সন্দেহ হয়। রাস্তায় ডিউটিরত পুলিশ তাদের থামিয়ে ব্যাকপ্যাক চেক করতে করতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। : কোন মাদ্রাসায় পড় তোমরা? : যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসায়। : তোমাদের মাদ্রাসায় জঙ্গি প্রশিক্ষণ দেয়া হয়? পুলিশের হাতে পড়ে এমনিতেই তরুণ ছাত্র দু’টি ভয়ে কুকড়ে গেছে। তার উপর এমন প্রশ্নে তারা কিছুটা বিস্মিত ও বিহ্বল হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে : জঙ্গি কি স্যার? জঙ্গি জান না, হরকত বা আল-কায়েদার নাম শুনেছ? ধমকে ওঠে পুলিশ। : জি স্যার শুনেছি। : আছে নাকি তোমাদের মাদ্রাসায়? : আছে স্যার। কিছুটা বিস্মিত চোখে পুলিশ তাকায় ওদের দিকে। : সত্যি বলছ, পুলিশের ধমক এবং অমন তাকানোয় ওরা আরো ভয় পেয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে : সত্যি স্যার আছে। : দেখিয়ে দিতে পারবে? : পারবো স্যার। এবারে পুলিশ যেন বিশ্বজয় করে ফেলেছে, পুরস্কার ও প্রমোশন চোখের সামনে ভাসতে থাকে তার। সে ওয়্যারলেস সেটের মাধ্যমে থানার ওসিকে জানায়, স্যার যাত্রাবাড়ির দুই মাদ্রাসা ছাত্রকে অ্যারেস্ট করেছি। ওরা স্বীকার করেছে ওদের মাদ্রাসায় আল-কায়েদা ও হরকত দুটোই আছে। এখনই ফোর্স পাঠান স্যার। পুলিশ পিকআপ ভ্যানে ছাত্র দু’টিকে তুলে নিয়ে মাদ্রাসার দিকে রওনা হয়।

কিছুক্ষণের মধ্যে বিপুল সংখ্যক পুলিশসহ বিভিন্ন এলিট ফোর্স মাদ্রাসাটি ঘিরে ফেলে। টিভি চ্যানেলগুলো লাইভ টেলিকাস্ট করার যন্ত্রপাতি নিয়ে মাদ্রাসার আশপাশে অবস্থান নেয়। দেশের সব চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ চলতে থাকে যাত্রাবাড়ীর অমুক মাদ্রাসায় আল-কায়েদার ও হরকতের (হরকত উল জেহাদ) খোঁজ পেয়েছে আইনশৃক্সখলা বাহিনী। অপারেশনের প্রস্তুতি চলছে। ছাত্র দু’টিকে নিয়ে পুলিশ মাদ্রাসায় প্রবেশ করলে মাদ্রাসা সুপার ছুটে এসে বলেন : কী হয়েছে! ওরা কী অপরাধ করেছে? কিছুই না। আপনার মাদ্রাসায় আল-কায়েদা লুকিয়ে আছে। ওরা আমাকে বলেছে। এই দেখাও কোথায় আল-কায়েদা? ভয়ে ছাত্রটি বলে : কোন কায়েদা দেখাবো স্যার? নুরানী না বোগদাদী? পুলিশ বলে, আর হরকত কোথায় থাকে দেখাও। ছাত্রটি তখন বলে কায়েদার মধ্যেই হরকত থাকে স্যার। যের, যবর, পেশকে হরকত বলা হয়। এটি একটি গল্প। কিন্তু সত্যতাও আছে। আমরা সকলে জানি কোরবানির সময় এতিমখানা ও মাদ্রাসার ছাত্ররা ছোরা নিয়ে কোরবানির পশু জবাই করার জন্য শহরের অলি গলিতে ছড়িয়ে পড়ে। উদ্দেশ্য লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের জন্য কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ। কোরবানি শেষে এই ছোরাগুলো পরবর্তী বছরের জন্য তারা মাদ্রাসায় সংরক্ষণ করে। পুলিশ এই ছোরা ধরে মাদ্রাসাতে জঙ্গি প্রশিক্ষণ হয় নির্ধারণ করে। এক শ্রেণীর মিডিয়াও প্রচার করে যে মাদ্রাসায় দেশীয় অস্ত্র পাওয়া গেছে। ইনকিলাব


শেয়ার করুন