নির্বাচনী সিস্টেমটাকেই ভেঙে ফেলছে ক্ষমতাসীন দল

election_7797-400x225সিটিএন ডেস্ক:
ভোট কেন্দ্র দখল, গুলি, সহিংসতা, প্রাণহানি আর জাল ভোটের মহোৎসবের মধ্য দিয়ে প্রথম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে গোটা নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর গণঅনাস্থা বলে আখ্যায়িত করেছেন রাজনৈতিক নেতারা। নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রতিক্রিয়ায় দেশের বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতারা বলেন, এককথায় বলতে গেলে এটা আওয়ামী স্টাইলের নির্বাচন। সরকারি দলের ছক ও নির্দেশনা অনুযায়ী নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। ভোট ডাকাতি, কেন্দ্র দখলসহ নানা অনিয়মের কারণে সমগ্র বাংলাদেশের জনগণকে পৃথিবীর মানুষের কাছে হেয়প্রতিপন্ন করা হয়েছে; চিহ্নিত হয়েছে ভোট ডাকাতের দেশ হিসেবে। সমগ্র নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর গণঅনাস্থা তৈরি হয়েছে। নির্বাচনী সিস্টেমটাকেই ভেঙে ফেলছে ক্ষমতাসীন দল। পরবর্তী ধাপগুলোতেও এমনই তামাশার নির্বাচন হবে বলে আশংকা অনেকের।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নেতারা বলেন, দলীয় ভিত্তিতে ইউপি নির্বাচন- সরকারের এ সিদ্ধান্তের কারণেই এতগুলো মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে, অসংখ্য প্রাণহানির আশংকা সৃষ্টি হয়েছে। এ আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের কারণে শান্তিপ্রিয় গ্রামে ঘরে ঘরে খুন-সংঘর্ষ-জিঘাংসাকে ছড়িয়ে দিয়েছে সরকার। এসব খুনের দায় সরকার এবং নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই বহন করতে হবে। বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে বলে মনে করেন তারা।

বিকল্প ধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের প্রথম পর্যায়ের নির্বাচনের ফলাফল দেখে মনে হচ্ছে, শতকরা ৯৫ ভাগের বেশি ভোট আওয়ামী লীগের পক্ষে পড়েছে। যদি এটা সত্যিই হয়, তাহলে নির্বাচনকালীন কিছুদিনের জন্য সরকার থেকে পদত্যাগ করে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন দিয়ে সংসদ পুনর্গঠন পথে সরকারের পক্ষে নৈতিক বাধা কোথায়?

তিনি বলেন, আমি সরকারকে আহ্বান করব, অবিলম্বে একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করে পৃথিবীর মানুষের কাছে প্রমাণ করুন, আপনাদের সরকার আসলেই কত গণতান্ত্রিক, কত জনপ্রিয়।

ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, আমার নির্বাচনী এলাকা বাবুগঞ্জের তিন ইউনিয়নেই পুরো দখলের নির্বাচন হয়েছে। তবে যেসব এলাকায় ভালো নির্বাচন হয়েছে সেখানে আমরা ভালো করেছি। তবে এই নির্বাচন কমিশনের যে ক্ষমতা তা প্রয়োগ করতে পারেনি। আমার কাছে মনে হয়েছে নির্বাচন কমিশন দুর্বল। নির্বাচনী সহিংসতায় সারা দেশে কয়েকজন নিহত ও বিপুল সংখ্যক আহত হয়েছে। এটা একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। তারপর আমি বলব, এসব হওয়া উচিত হয়নি। এসব সহিংসতা ও সংঘর্ষ এড়িয়ে যাওয়া উচিত ছিল।

জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী প্রথম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। এই নির্বাচনে সরকার অবৈধ প্রভাব বিস্তার করেছে। পেশিশক্তি, ভয়ভীতি দেখিয়ে ভোট কেন্দ্র দখল করা হয়েছে। সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। তারপরও তৃণমূলে পার্টিকে শক্তিশালী করতে সামনের সব স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেব। এছাড়াও এসব নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করে সামনের দিনে জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক কর্মপরিকল্পনা ঠিক করা হবে বলেন জানান তিনি।

লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ বলেন, প্রথম ধাপে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। পুলিশ ও প্রশাসন কথা শোনে না নির্বাচনের আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার প্রকাশ্যেই এ কথা স্বীকার করেছেন। নির্বাচনী সহিংসতায় সারা দেশে ১১ জন নিহত ও এক হাজারের অধিক মানুষ আহত হয়েছে। বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে দায়িত্বে থাকা প্রশাসন ও আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরাও ব্যালটে সিল মেরে বাক্সভর্তি করেছেন। বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে প্রিসাইডিং অফিসারের স্বাক্ষর ছাড়াই ব্যালট পেপার বাক্সে ঢুকানো হয়েছে।

এলোমেলো অবস্থায় বহু ব্যালট পেপার পাওয়া গেছে। এই ধরনের নির্বাচনের কারণে জনগণ এরই মধ্যে সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছে। কোনো সভ্য সমাজে এ ধরনের অসভ্য আচরণ অনাকাক্সিক্ষত ও অবাঞ্ছিত। তারা নির্বাচনী সিস্টেমটাকেই ভেঙে ফেলছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ভোট ডাকাতি, কেন্দ্র দখলসহ এসব অনিয়মের কারণে সমগ্র বাংলাদেশের জনগণকে পৃথিবীর মানুষের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়েছে। ভোট ডাকাতের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ চিহ্নিত হয়েছে। বিরাজমান অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে এই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো স্তরেই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা যায় না। আমি আশা করি, দায়িত্ববোধ থেকে প্রথম ধাপের ইউপি নির্বাচনের এসব অনিয়মের কারণে প্রধান নির্বাচন কমিশনার, কমিশনারবৃন্দ, কমিশনের সচিবসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত সবাই পদত্যাগ করবেন। একই সঙ্গে সরকারকে বলব, আপনারা যত দ্রুত নির্বাচনের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারবেন, ততোই আপনাদের জন্য মঙ্গলজনক।

জেএসডির সভাপতি আসম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন এক বিবৃতিতে বলেন, অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে ১১ জন নিহত ও অসংখ্য আহত হয়েছে। দলীয় ভিত্তিতে ইউপি নির্বাচন সরকারের এ সিদ্ধান্তের কারণেই এতোগুলো খুন সংঘটিত হয়েছে, অসংখ্য প্রাণহানির আশংকা সৃষ্টি হয়েছে। এ আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের কারণে শান্তিপ্রিয় গ্রামের ঘরে ঘরে খুন-সংঘর্ষ-জিঘাংসাকে বিস্তার করে দিয়েছে সরকার। এসব খুনের দায় সরকার এবং নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই বহন করতে হবে।

তারা বলেন, সরকার জনগণের ভোটাধিকার হরণ, নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না। ক্ষমতার স্বার্থে সারা দেশটাকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে, খুনের চারণ ভূমিতে পরিণত করছে। ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকার ও নির্বাচন কমিশন চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। নেতারা ভোটবিহীন এবং খুন করে ক্ষমতায় থাকার বর্তমান সরকারের যে রাজনীতি তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।

ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ নেজামী বলেন, প্রথম ধাপের ইউপি নির্বাচন যা হয়েছে তা বলে লাভ কী? এটা তো আওয়ামী স্টাইলের নির্বাচন। বর্তমান আওয়ামী সরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না, তা আবার প্রমাণিত হয়েছে।

বিজেপি চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, প্রথম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন একতরফা হয়েছে। সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকার কারণেই এবারের নির্বাচনও সুষ্ঠু হয়নি। নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তারা তা প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিগত দিনের জাতীয় নির্বাচন, উপজেলা ও পৌর নির্বাচনের মতো এবারের ইউপি নির্বাচনেও প্রমাণ করেছে এই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।

বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, সরকারি দলের ছক ও নির্দেশনা অনুযায়ী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। তৃণমূলে সরকারি দলের নিরংকুশ দখলদারিত্ব কায়েম করা হয়েছে।-যুগান্তর।


শেয়ার করুন