নিবন্ধন আছে এমন দলের সঙ্গে মিশে যাবে জামায়াত!

jamayat-400x266সিটিএন ডেস্ক:
রাজনীতিতে টিকে থাকার জন্য দুটি বিকল্প পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। এর একটি নতুন নামে আত্মপ্রকাশ। দ্বিতীয়টি হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন আছে এমন দলের সঙ্গে মিশে যাওয়া। সেক্ষেত্রে তারা ধর্মভিত্তিক কোনো দলের সঙ্গে মিশবে না। নতুন যে কোনো একটি পথ অনুসরণ করলেও গোপনে জামায়াতে ইসলামীর কর্মকা- অব্যাহত থাকবে। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী ধর্মাশ্রয়ী দলটি যে কোনো সময় নিষিদ্ধ হতে পারে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিকল্প নিয়ে ভাবছে জামায়াতে ইসলামী। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

২০১৯ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজস্ব ব্যানারে অংশ নেয়া জামায়াতের নীতিনির্ধারকদের প্রধান টার্গেট। কিন্তু এ মুহূর্তে তাদের সামনে সে সুযোগ নেই। জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের বিষয়টি দেশের সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন। ফলে সরকার জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখলে তারা দলীয় ব্যানারে নির্বাচন করতে পারবে না। কাজেই নতুন নামে দল গঠন বা অন্য কোনো দলের সঙ্গে মিশে যাওয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছেন নেতারা। তবে নতুন নামে সংগঠন করলেও নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধন নিতে হবে।

জামায়াতের নেতাদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা নতুন নামের দলটিকে নিবন্ধন দেয়া হবে কি না তা নিয়েও সংশয় আছে। নিবন্ধন না পেলে তারা ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনে দলীয় ব্যানারে নামতে পারবে না। সেক্ষেত্রে নেতারা দ্বিতীয় বিকল্প হিসেবে নিবন্ধিত কোনো দলের সঙ্গে মিশে যাওয়ার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন। ২০ দলীয় জোটভুক্ত নিবন্ধিত দলগুলোর মধ্য থেকে যে কোনো একটিকে বেছে নেয়ার চিন্তাভাবনা চলছে। বিষয়টি নিয়ে একাধিক শরিক দলের সঙ্গে শীর্ষ নেতাদের কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। একীভূত হলে জামায়াতের নেতাদের কোন পর্যায়ের পদ দেয়া হবে তা নিয়ে আলাপ আলোচনা চলছে। তবে জোটের শরিক ধর্মভিত্তিক কোনো দলের সঙ্গে মিশবে না জামায়াত। দ্বিতীয় বিকল্পকে জামায়াতের জন্য নিরাপদ মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের একজন সদস্য বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে হলে আমাদের নতুন করে ভাবতেই হবে। কারণ, যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে আমরা এখন দেশে-বিদেশে এমনকি ২০ দলীয় জোটেও কোণঠাসা হয়ে পড়েছি। নিবন্ধন জটিলতায় নির্বাচনেও অংশ নিতে পারছি না। এ অবস্থা থেকে বের হয়ে রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে নতুন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এটি করতে শীর্ষ নেতাদের ওপর দলের তরুণ প্রজন্মের চাপও রয়েছে।’

জামায়াত সংশ্লিষ্টরা বলেন, দেশী-বিদেশী চাপের মুখে জামায়াত কৌশলী হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে নিষিদ্ধ হওয়ার আগেই তারা নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তবে নিষিদ্ধ হলেও দল হিসেবে জামায়াত গোপনে টিকে থাকবে। গোপন কর্মকা- অব্যাহত রাখবে। এতে ৬০ বছরের বেশী বয়সী নেতারা কাজ করবেন। তারা প্রকাশ্যে আসবেন না। তারা বলেন, এ পর্যন্ত পাকিস্তানে দু’বার এবং স্বাধীন বাংলাদেশে একবার নিষিদ্ধ হয় জামায়াত। তখনও তারা গোপনে কর্মকা- চালিয়ে গেছেন। এবারও একই পথ অনুসরণ করবেন। আবার সুযোগ বুঝে আগের মতো ফের ঘুরে দাঁড়াবে এমন সিদ্ধান্ত আছে তাদের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের অপর এক সদস্য বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে এরই মধ্যে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। ফাঁসির আগে কারাগার থেকে জামায়াতের নীতিনির্ধারকদের উদ্দেশে ‘পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নতুন কর্মকৌশল গ্রহণ সময়ের দাবি’ শিরোনামে এক গোপন চিঠি লেখেন মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। তারা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের এই চিঠি সামনে রেখে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।

ওই নেতা বলেন, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান তার চিঠিতে দলটির দীর্ঘ ৬০ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের আত্মবিশ্লেষণ করে বেশকিছু নতুন কৌশল ও কর্মপন্থা প্রকাশ করেন। চিঠিতে তিনি বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘খুব নাজুক’ ও জামায়াতের জন্য ‘কঠিন চ্যালেঞ্জ’ উল্লেখ করে তা মোকাবেলায় তিনটি বিকল্প পথ বাতলে দেন। এগুলো হচ্ছে- (১) যা হবার হবে, আমরা যেমন আছি তেমনি থাকব। (২) পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জামায়াত সিদ্ধান্ত নিয়ে পেছনে থেকে একটি রাজনৈতিক দল গড়ে তুলবে এবং (৩) যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আছে জামায়াতের নেতৃত্ব থেকে তাদের সরে দাঁড়ানো এবং সম্পূর্ণ নতুন প্রজন্মের হাতে দলের দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া।

সূত্র জানায়, পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দলটির শীর্ষ নেতারা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের এই প্রস্তাব আমলে নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু করেছেন। সেই চিন্তাভাবনার অংশ হিসেবেই নতুন কর্মকৌশল নির্ধারণ করতে যাচ্ছে দলটি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই তারা এই কর্মকৌশলের বাস্তবায়নে জোরালো তৎপরতাও শুরু করেছে। এক্ষেত্রে জামায়াতের অন্যতম নীতিনির্ধারক ও দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। তিনি বিদেশে বসে এ বিষয়ে বুদ্ধি পরামর্শ দিচ্ছেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর তিনি দেশ ছাড়েন। এখনও ফেরেননি।

নতুন নামে জামায়াতের রাজনীতি করার বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনে দল হিসেবে এখন আর জামায়াতের নিবন্ধন নেই। সরকারের যে মনোভাব, তাতে হয়তো এ বছরের মধ্যেই জামায়াত দল হিসেবে নিষিদ্ধ হবে বলে মনে হচ্ছে আমার। জামায়াতে ইসলামী নামের এই দলটি বাংলাদেশে আর থাকবে না। তবে দলের অনুসারীরা থাকবেন এবং তারা নতুন নামে দল গঠন করে রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন।’

তার কথায়, সেই দলটি ২০১৯ সালের নির্বাচনেও অংশ নেবে। তারা কীভাবে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, সেই প্রক্রিয়া কেমন হবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে আমার জানা তথ্য মতে, নতুন নেতৃত্বের জন্য জামায়াতের তরুণরা কাজ করছেন।

জামায়াত সংশ্লিষ্টদের মতে, তাদের এখন আর কোনো দৃশ্যমান তৎপরতা নেই। যা আছে তা সংবাদ বিজ্ঞপ্তি বা প্রেস রিলিজে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। দলটির ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানের নামে এসব সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হলেও তাকে প্রকাশ্যে দেখা যায় না। পাওয়া যায় না টেলিফোনেও। মধ্যম বা তৃতীয় সারির কোনো নেতাও সেল ফোন খোলা রাখেন না। নামমাত্র কর্মসূচি দেয়া হয়। প্রথমদিকে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত শীর্ষ নেতাদের বিচারের রায় ঘোষণার পর জামায়াত-শিবির যে সহিংস প্রতিবাদ করেছে, এখন তা নেই। এ অবস্থায় নেতাকর্মীদের ধরে রাখতে, তাদের মনোবল ফিরিয়ে আনতে এবং রাজনীতির মাঠে টিকে থাকতে জামায়াত নয়া পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে এগোচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, তারা (জামায়াত) যে নতুন নাম নিয়ে রাজনীতি করতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। মিসরেও এভাবেই তারা ক্ষমতায় গিয়েছিল। তিনি বলেন, এ পরিস্থিতিতে বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার বিকল্প নেই। কারণ ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুযায়ী ধর্মের নামে রাজনীতির সুযোগ নেই।-যুগান্তর।


শেয়ার করুন