চট্টগ্রাম : বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে আল বদর প্রধান ও জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর নিজামীকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর করাকে ‘হত্যা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন জমায়াত চট্টগ্রাম মহানগরী আমির ও সাতকানিয়ার সাবেক সাংসদ মাওলানা মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম। একই সাথে নিজামীর গুণকীর্তন গেয়ে নিজামীর মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়ারও হুমকি দিয়েছেন যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারের কাঠগড়ায় থাকা দলটির কেন্দ্রিয় কর্ম পরিষদের এ সদস্য।
বুধবার দুপুরে নগরীর চকবাজার প্যারেড মাঠে নিজামী গায়েবানা জানাযা পূর্ব সংক্ষিপ্ত এক বক্তব্যে শামসুল ইসলাম এসব কথা বলেন। যদিও এসময় প্যারেড মাঠ ও আশপাশে বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্য মোতায়েন ছিল।
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বিশ্বনন্দিত ইসলামী আন্দোলনের নেতা উল্লেখ করে শামসুল ইসলাম বলেছেন, ‘দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। শিক্ষা আন্দোলন, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এবং টিপাইমুখ বাঁধ প্রতিরোধ আন্দোলনসহ গণমানুষের অধিকার আদায়ের বিভিন্ন আন্দোলনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।’
‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণেই তাঁকে সরকার মিথ্যা অভিযোগে হত্যা করেছে। যুগে যুগে ইসলামী আন্দোলনের ওপর জুলুম নির্যাতন ও নিপীড়ন এবং হত্যা করার মত ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। মাওলানা নিজামীকে হত্যা তারই ধারাবাহিকতা মাত্র। বাংলাদেশের জনগণ ইসলামকে বিজয়ী করার মাধ্যমেই মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে হত্যার বদলা নেবে ইন্শা আল্লাহ।’
জানাজা পূর্ব সমাবেশে জামায়াত নেতৃবৃন্দ আগামীকাল ১২ মে জামায়াত আহুত দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল সফল করার আহবান জানান তিনি।
নামাজে জানাযায় উপস্থিত ছিলেন, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা জামায়াতের আমীর মুহাম্মদ জাফর সাদেক, উত্তর জেলা জামায়াতের আমীর অধ্যক্ষ মাওলানা আমিরুজ্জামান, চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের সেক্রেটারী মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম, জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরার সদস্য ও সাবেক এমপি আলহাজ্ব শাহজাহান চৌধুরী, খাগড়াছড়ি জেলা আমীর অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল মোমেন, চট্টগ্রাম মহানগরী এসিসটেন্ট সেক্রেটারী অধ্যক্ষ মুহাম্মদ নুরুল আমিন ও অধ্যক্ষ মাওলানা খাইরুল বাশার, নগর জামায়াতের প্রচার সম্পাদক মুহাম্মদ উল্লাহ, নগর জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য মুহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান, নগর উত্তর ছাত্রশিবিরের সভাপতি মুহাম্মদ সালাহ উদ্দিন, নগর দক্ষিণ ছাত্রশিবিরের সভাপতি মুহাম্মদ শোয়াইব প্রমুখ।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন হত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যা, লুট, ধর্ষণে পরিকল্পনা, সাম্প্রদায়িক উসকানি ও সহায়তাসহ মোট ১৬টি অভিযোগে আল বদর নেতা মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এরপর রিভিউ (রায় পুনর্বিবেচনা) আবেদনও খারিজ করে দেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ মামলার সাক্ষ্য ও জেরা শেষ হয় ২০১৩ সালের শেষের দিকে। এরপর ২০১৪ সালের ২৪ জুন দুই দফা যুক্তিতর্ক শেষে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়েছিল। ওই দিন রায়ের সকালে নিজামীর ‘অসুস্থতায়’ রায় ঝুলে যায়। পরে ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ পাঁচটি অপরাধে নিজামীর মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেন। অন্যগুলোতে যাবজ্জীবন ও বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়।
জামায়াতে ইসলামীর আমির নিজামী একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের শুরুর দিনগুলোতে ছিলেন জামায়াতের তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি। পদাধিকার বলে তিনি ছিলেন আল-বদর বাহিনীর প্রধান, যে আধাসামরিক সংগঠনটি পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগিতায় দেশজুড়ে হত্যা, ধর্ষণসহ ব্যাপক যুদ্ধাপরাধ ঘটায়। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের বুদ্ধজীবীদের হত্যা করাই ছিল এ বাহিনীর মূল লক্ষ্য।
২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘোষণা করেন। তার বিরুদ্ধে ১৬টি অভিযোগের মধ্যে আটটি প্রমাণিত হয়। এর মধ্যে চারটি অভিযোগে তাঁকে ফাঁসির আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এই রায়ের বিরুদ্ধে নিজামীর আপিলের রায় ঘোষণা করা হয় চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি। আপিলে আরও তিনটি অভিযোগ থেকে নিজামী খালাস পান। বাকি পাঁচটি অভিযোগে তাঁকে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া দণ্ড বহাল রাখেন আপিল বিভাগ, এর মধ্যে তিনটিতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এগুলো হলো পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার রূপসী, বাউসগাড়ি ও ডেমরা গ্রামের ৪৫০ জনকে নির্বিচার হত্যা ও ধর্ষণ, ধুলাউড়ি গ্রামে ৫২ জনকে হত্যা এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা। বাকি দুটি অভিযোগে তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন সর্বোচ্চ আদালত।
মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ১২টা ১০ মিনিটে মতিউর রহমান নিজামীর (৭৩) মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়
বাংলামেইল২৪ডটকম