কক্সবাজারে ‘বাল্য বিয়ে’ বিষয়ক সেমিনারে দাবি

নিকাহ রেজিষ্ট্রাররা ‘বিয়ের পরিচালক’ নন, তারা কেবলই নিবন্ধনকারি

Cox'sBazar Picture 29.08.2015আনছার হোসেন

‘হঠাৎ করে কোন বর-কনের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয় না, বর-কনের অভিভাবক, সমাজপতি ও জনপ্রতিনিধিগণের সম্মিলিত প্রয়াসেই একটি বিবাহ অনুষ্টান আয়োজিত, পরিচালিত ও সম্পাদিত হয়ে থাকে। তারপরই নিকাহ রেজিষ্ট্রারগণ ওই বিবাহটি নিবন্ধন করে থাকেন। মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) বিধিমালা ২০০৯ এর ২৩ক (৩) বিধি অনুসারে বিবাহ নিবন্ধনের সময় বর কনে বা অন্য কোন ব্যক্তি মিথ্যা তথ্য দিলে এবং ওই তথ্যের ভিত্তিতে কোন বিবাহ নিবন্ধন করা হলে তার জন্য কোন নিকাহ রেজিস্ট্রার দায়ী হবেন না।’
এমন দাবি করে ‘বাল্য বিবাহে দায় কার? প্রতিরোধে করণীয়’ শীর্ষক এক সেমিনারে বলা হয়েছে, ‘বিয়ে অনুষ্টান আয়োজন, পরিচালনা ও সম্পাদনের জন্য বর-কনের অভিভাবক ও সমাজপতিগণই মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। ক্ষেত্র বিশেষে তারা বাল্য বিয়ে নিবন্ধনে নিকাহ রেজিষ্ট্রারদের উপর চাপ সৃষ্টি করে থাকেন। অথচ নিকাহ রেজিষ্ট্রারগণ বিয়ে নিবন্ধনের জন্য সরকারিভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ও সুনির্দিষ্ট পদবিধারী ব্যক্তি হওয়া সত্বেও প্রস্তাবিত বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৪ (খসড়া) এ নিকাহ রেজিষ্ট্রারগণকে ‘বিবাহ পরিচালনাকারী’ বলে সংজ্ঞায়িত করা অযৌক্তিক।’

বাংলাদেশ মুসলিম নিকাহ রেজিষ্ট্রার সমিতি কক্সবাজার জেলা শাখা আয়োজিত এই সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংগঠনটির কক্সবাজার জেলা সভাপতি মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আলী হোসেনের সভাপতিত্বে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্টিত এই সেমিনারে প্রবন্ধকার মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন দাবি করেন, ‘ইদানিং নোটারী পাবলিকের কার্যালয় কাজী অফিসের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সমাজপতিরা নোটারী পাবলিকের কার্যালয়কে কাজী অফিসের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করছেন, ফলে নিবন্ধনবিহীন বিয়ের হার বাড়ছে।’
তার মতে, ‘নোটারী পাবলিককে আইনের আওতায় আনা না হলে বাল্য বিবাহ আদৌ বন্ধ হবে না।’

কাজী মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন তার প্রবন্ধে বিয়ের আইনগত বয়স নির্ধারণ নিয়েও প্রশ্ন তুলেন। তিনি বলেন, ‘সরকার সম্প্রতি বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন ২০১৪ (খসড়া) বিশ্বের অন্য দেশগুলোর সাথে সমন্বয় করে বরের বয়স ২১ ও কনের বয়স ১৮ বছর বহাল রেখে পিতা-মাতার সম্মতি ও আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে কনের বয়স ১৬ বছর নির্ধারণ করেছেন। সরকারের এই সিদ্ধান্তে গুটিকয়েক নারীবাদী ছাড়া সর্বস্তরের জনসাধারণের সমর্থন রয়েছে।’

তিনি প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, নারীবাদীদের কেউ কেউ বরের বয়স ২৫ বছর ও কনের বয়স ২৩ বছর, আবার কেউ কেউ বরের বয়স ২৩ বছর ও কনের বয়স ২১ বছর নির্ধারণ করার দাবি জানাচ্ছেন।

তিনি মনে করেন, ‘এক শ্রেণীর নারীবাদীরা বাংলাদেশের পরিবার প্রথাকে ভেঙ্গে দিয়ে বিয়ে বহির্ভূত যৌনাচারে উৎসাহিত করে যাচ্ছে নানাভাবে। তাই তাদের বাল্য বিয়ের পর জোরপূর্বক বিয়ে তত্ব নিয়ে গণমাধ্যমে সোচ্চার দেখা যাচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য বাল্য বিয়ে বন্ধ করে দেশের জনমানুষের কল্যাণ নয়, বরং বিয়ে প্রথাকে বিতর্কিত করে বাংলাদেশে বিয়ে বহির্ভূত যৌনাচারের অভয়ারণ্য সৃষ্টি করা।’

২৯ আগষ্ট শনিবার বিকালে কাজী এরশাদ উল্লাহর সঞ্চালনায় অনুষ্টিত সেমিনারে ‘জন্ম নিবন্ধন সনদের বেপরোয়া সংশোধন’ নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। প্রবন্ধকার মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন মনে করেন, ‘জন্ম নিবন্ধন সনদের তারিখ পরিবর্তনে কোন নীতিমালা আছে বলে মনে হয় না। জন্ম নিবন্ধকগণ জন্ম নিবন্ধন সনদে ইচ্ছে মতো বয়স বাড়িয়ে ও কমিয়ে থাকেন।’
তিনি রামু উপজেলার জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে দেয়া একই ব্যক্তির ভিন্ন জন্ম সনদে ভিন্ন বয়সের বাস্তব উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, ‘ইচ্ছে মতো জন্ম তারিখ পরিবর্তন করে জন্ম সনদ ইস্যূ করায় পক্ষগণের মধ্যে দেওয়ানী ও ফৌজদারী মামলার সৃষ্টি হচ্ছে। এবং দূর্ভাগ্যজনক ভাবে এ ধরণের মামলায় আসামির তালিকা থেকে নিকাহ রেজিষ্ট্রারের নামও বাদ যাচ্ছে না।’

মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন প্রশ্ন তুলেন, ‘বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন ২০১৪ (খসড়া) পর্যালোচনা ও ওই আইনের অভিপ্রায় দেখে মনে হচ্ছে, নিকাহ রেজিষ্ট্রারগণকে জেলে দেয়া হলে বাল্য বিয়ে বন্ধ হয়ে যাবে! বাস্তবতা কি তাই?’
তিনি বাল্য বিয়ে রোধে বিয়ে নিবন্ধনের সময় বর-কনের বয়স প্রমাণের জন্য সঠিক জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্ম নিবন্ধন সনদ উপস্থাপনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন।

সভাপতির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আলী হোসেন বলেন, ‘সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের মানসিক অবস্থারও পরিবর্তন হয়। সেই পরিবর্তনে নিজেদেরকেও মানিয়ে নিতে হয়।’

তিনি মনে করেন, প্রত্যেকটি আইনেই কোন না কোন ত্রুটি থাকে। আইনের ভালো-খারাপ দিক দু’টোই থাকে। কিন্তু ভালো দিকের চেয়ে খারাপের দিকে প্রাধান্য দিলে সমাজ পরিবর্তন হবে না।
তিনি নিকাহ রেজিষ্ট্রারদের (কাজী) সমাজ ও পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে চলার পরামর্শ দেন।

জেলা প্রশাসক মনে করেন, ‘হলফনামা মূলে কখনো বিয়ে হয় না। বিয়ের জন্য বর-কনের সম্মতি ও নিবন্ধনের দরকার হয়।’
এই সেমিনারে বিশেষ অতিথি হয়ে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ মুসলিম নিকাহ রেজিষ্ট্রার সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি কাজী মামুনুর রশিদ ও মহাসচিব কাজী হাফেজ সাগর আহমেদ শাহীন। এতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সমিতির কক্সবাজার জেলা সহ-সভাপতি কাজী মুজিবুর রহমান চৌধুরী বেলাল।

এছাড়াও সেমিনারে বক্তব্য রাখেন জিপি এডভোকেট মোহাম্মদ ইসহাক, এডভোকেট ফরিদুল আলম, সাংবাদিক মাহবুবুর রহমান প্রমূখ।

এই সেমিনারে সরকারের জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা ছাড়াও আইনজীবী, সাংবাদিক ও এনজিও প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।


শেয়ার করুন