বেড়েছে অপহরণ বাণিজ্য

নাইক্ষ্যংছড়িতে পৃথক ৭ খুনের রহস্য উদঘাটিত হয়নি

Konমো.আবুল বাশার নয়ন, নাইক্ষ্যংছড়ি :

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে ৭ খুনের রহস্য উম্মোচন হয়নি। হত্যাকান্ডে জড়িত এমন কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। সন্দেহজনক আটক ব্যক্তিদের দুর্বল তদন্তের কারনে সহসাই জামিনে এসেছে অনেকে। তবে একটি মামলা বিচারাধীন থাকলেও বাদী একাধিক নারাজি দিয়েছেন আদালতে। খুনের ঘটনায় কয়েকজনকে আটক করা হলেও প্রকৃত রহস্য উদঘাটন অন্ধকারেই থেকে যাচ্ছে। লাশের পরিচয় না পাওয়ায় কয়েকটি হত্যাকান্ডের মোটিভ উদঘাটন করা যাচ্ছে না। এছাড়াও গত এক বছরে অপহরণের পর মুক্তিপন দিয়ে ছাড়া পেয়েছে শতাধিক লোক। কিন্তু অপহরণকারী চক্রকে এখনো রুখতে পারেনি পুলিশ। এতে করে মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে। গত কয়েক বছরের তথ্য উদঘাটনে দেখা যায় উপজেলায় বেশ কয়েকটি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটলেও হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত প্রকৃত আসামীরা বরাবরের মতো জামিনে এসে বাদী পক্ষকে হুমকি দিচ্ছে।
মোহাম্মদ মিয়া: ২০১২ সনের ২৪ অক্টোবর বাইশারী ইউনিয়নের হরিণখাইয়া এলাকায় মোহাম্মদ মিয়াকে ছুরিকাঘাত ও জবাই করে হত্যা করা হয়। সে বাইশারী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহম্মদের রাবার বাগান পাহারাদার হিসেবে কর্মরত ছিল। ঘটনার তিন দিন আগে উক্ত শ্রমিককে ধরে নিয়ে যায় অপরিচিত সন্ত্রাসীরা। পরে ঐ শ্রমিককে ছুরিকাঘাত ও জবাই করে খুন করা হয় বলে পুলিশ জানায়। নিহতের স্ত্রী আজিদা বেগম জানান, তার স্বামী খুন হওয়ার কিছু দিন পর্যন্ত পুলিশ ও জনপ্রতিনিধিরা তৎপর ছিল। কিন্তু বর্তমানে মামলাটি কোন অবস্থায় আছে তিনি নিজেও জানেন না। কেউ তার খোজও নেননা বলে এ প্রতিবেদককে অভিযোগ করেন।
শাহিনুর (প্রকাশ শানু জমাদ্দার): ২০১২ সনের ২ সেপ্টেম্বর উপজেলার বাইশারী ইউরিয়নের ধৈয়ারবাপেরপাড়ায় ছুরির আঘাতে আনসার ভিডিপি কমান্ডারকে হত্যা করে দুষ্কৃতিকারীরা। এ ঘটনায় ওই দিনই শানুর ছেলে মো: নাছির বাদী হয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি থানায় চার জনকে অভিযুক্ত করে মামলা নং- ০১ তাং-২/০৯/২০১২ দায়ের করে। পুলিশ ওই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে থোয়াইছাচিং মার্মা (৩৫), চিঅং জাই মার্মা (২৫), ধুংছি মার্মা (২৮) নুরুল আবছার, (২৬) শামসুল আলম (৩২) কে গ্রেফতার করা হলেও মামলার শেষ পর্যায়ে প্রকৃত আসামীদের বাদ দেওয়া হয় বলে অভিযোগ তুলে মামলায় নারাজি দেন মামলার বাদী।
একটি বিশ্বস্থ্য সূত্র জানিয়েছে, এক প্রভাবশালী ব্যাক্তির গোপন তথ্য ফাসঁ হয়ে যাওয়ার আশংখায় কৌশলে এ দুটি হত্যাকান্ড ঘটায়। এব্যাপারে নানা বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষন এবং খোজ খবর নিলে প্রকৃত ক্লু উদ্ধার করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট মহল।
দীলিপ কুমার ভৌমিক: ২০১৫ সনের ১৩ সেপ্টেম্বর উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের একটি রাবার বাগান থেকে অজ্ঞাত এক ব্যাক্তির লাশ উদ্ধার করা হয়। ঘটনার নয় দিন পর নিহতের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি জেলার লামা উপজেলার আজিজ নগর ইউনিয়নের মিশন পাড়ার মৃত ধীরেন্দ্র দে’র পুত্র দীলিপ কুমার ভৌমিক। তবে দীলিপ কে বা কারা হত্যা করেছে তার ক্লু এখনো উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি। তবে ঘুমধুম পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ এসআই আবদুল বাসেত জানান- পূর্ব শত্রুতার জেরে কিংবা নিহত ব্যক্তির হাতে থাকা নগদ টাকা হাতিয়ে নিতে অথবা ইয়াবা লেনদেন সংক্রান্ত মোটা অংকের অর্থের কারণে এ হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটতে পারে।
মো: নোমান: ২০১৫ সনের ২২ সেপ্টেম্বর চাকঢালা-আশারতলী সড়কের চেরারকুল উচু পাহাড় এলাকা থেকে আনুমানিক ৫০ গজ দূরবর্তী বাগান থেকে আনুমানিক ২৫ বৎসর বয়সী অজ্ঞাত এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। থানার এসআই সোলতান উদ্দীন আহসান লাশের সুরুতহাল সংগ্রহের সময় টুকরো কাগজের সূত্র ধরে তার নাম মো: নোমান হিসেবে নিশ্চিত করা হয়। তবে উদ্ধারকৃত লাশের শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। ধারনা করা হচ্ছে প্রেম সংগঠিত কারনে দুষ্কৃতিকারীরা তাঁেক হত্যা করে জঙ্গলে লাশ ফেলে যায়। এছাড়াও মো: নোমান আত্মহত্যা করেছে কিনা তাও খতিয়ে দেখছে পুলিশ। এ ঘটনার পর থেকে স্থানীয় একটি পরিবারকে হত্যা ঘটনার সাথে জড়িত হিসেবে কড়া নজরে রেখেছে পুলিশ।
সাজেদা বেগম: ২০১৫ সনের ৮ ফেব্রুয়ারী নিখোঁজের এক মাস ৬দিন পর সাপমারাঝিরি এলাকা থেকে সাজেদা বেগম নামের এক মহিলার গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। তৎ সময় ঘটনায় আব্দুর শুক্কুর (৩০) কে আটক করেছিল পুলিশ। তবে এ ঘটনার রহস্য উম্মোচন করা হয়েছে বলে দাবী করেন নাইক্ষ্যংছড়ি থানা পুলিশ।
অজ্ঞাত লাশ: ২০১৪ সনের ২০ এপ্রিল উপজেলার চাকঢালা ৬নং ওয়ার্ডের বিজিবি ক্যাম্পের দক্ষিণে বড়ছড়াপাড়া গ্রামের স্বর্গটিলা নামক এলাকা থেকে অজ্ঞাত এক পুরুষের কঙ্কালটি উদ্ধার করা হয়। সে সময় উদ্ধারকৃত ব্যাক্তির পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ।
আয়েশা বেগম: ২০১০ সনের ২৩ আগষ্ট নাইক্ষ্যংছড়ির চাকঢালায় পাহাড়ের চূড়া থেকে আয়েশা বেগম (১৮) নামে এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ঐ তরুণীর গলায় আঘাতের চিহ্ন ছিল। তৎসময় পুলিশ জানায়- দুর্বৃত্তরা আয়েশাকে গলাটিপে হত্যা করে পাহাড়ে লাশ ফেলে যায়। এসব হত্যাকান্ডের মধ্যে শাহিনুর জমাদ্দার ও সাজেদা বেগমের মামলাটি আদালতে বর্তমানে বিচারাধীন আছে।
অপহরণ: অপরদিকে নাইক্ষ্যংছড়িতে কোনমতেই থামছেনা অপহরণ বানিজ্য। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নিরাপত্তার মাঝেও প্রতিমাসে একাধিক অপহরণের ঘটনায় বর্তমানে সংশ্লিষ্টদের ভাবিয়ে তুলেছে। অপহরণকারী চক্রটির জালে আটকা পড়েছে ব্যবসায়ী, ধনী পরিবারের স্কুল কলেজ পড়–য়া সন্তান, কৃষক, গাড়ি চালকসহ অনেকে। এ সিন্ডিকেটকে পুলিশ এখনো পর্যন্ত চিহ্নিত করতে পারেনি। অপহরণের পর পুলিশ অভিযান দেখালেও প্রকৃত পক্ষে অপহরণের শিকার হওয়া ব্যাক্তিরা মুক্তিপন পরিশোধ কের ফিরে আসে। তবে পুলিশ বলছে, ‘অপহরণকারীদের চিহ্নিত করে দ্রুত গ্রেফতার করা হবে’।
তথ্যনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি বছরের ১১ অক্টোবর বাইশারী ইউনিয়নের ব্যাঙডেবা এলাকা থেকে মো ইউনুছ, মো করিম, মো: আবু বক্করকে অপহরণ করা হয়। পরে তাদের কাছ থেকে মুক্তিপন আদায় করে ছেড়ে দেওয়া হয়। এছাড়াও চলতি বছরের ১মে দোছড়ি ইউনিয়নের ওয়াচ্ছাখালি থেকে বুলবুল আক্তার (১১), ২০ আগষ্ট বাইশারী ইউনিয়নের নাজমা খাতুন রাবার বাগানের মসজিদের ইমাম মাওলানা রশিদ আহমদ (৩৯), ১২ আগষ্ট বাইশারী ইউনিয়নের রাঙ্গাঝিরি থেকে মিজানুর রহমান (২২), একই মাসে দোছড়ি ইউনিয়নে লংগদু থেকে ফরিদুল আলম (৩৫), মো. হুমায়ুন কবির, বড়ইচর এলাকা থেকে জালাল উদ্দিন (৩০), আবদুল কাদের (২৭), ৪ফেব্রুয়ারী বাইশারী ইউনিয়নের লেদুরমু থেকে ছালেহ আহামদ (৩৫) ও রাজিব (১৫), ৩০ এপ্রিল বাইশারী ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ি চাইল্যাতলী থেকে মো. শাহজালাল (২২), ৫মে ঈদগড় বাজার থেকে যাত্রী নিয়ে রাঙ্গা ঝিরি যাওয়ার পথে মিজানুর রহমান (২২) ও সর্বশেষ গত সোমবার বাইশারী ইউনিয়নের কাগজিখোলা থেকে ছৈয়দ বাবর (৩০) সহ অন্তত শতাধিক স্থানীয় বাসিন্দাকে অপহরণ পূর্বক মুক্তিপন আদায় করেছে।
সাম্প্রতিক কয়েকটি হত্যাকান্ডের বিষয়ে ৩০ সেপ্টেম্বর বুধবার নাইক্ষ্যংছড়ি থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো: আবুল খায়ের উপজেলা পরিষদের মাসিক আইন শৃঙ্খলা সভায় বলেন- তথ্য প্রযুক্তির এ সময়ে হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত কেউ রেহাই পাবেনা। বিগত সময়ের মত ব্যাপক ধরপাকড়ক আর মারধর করে খুনের রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব নয়। সাম্প্রতিক দুটি হত্যাকান্ডের বিষয়ে পুলিশ প্রযুক্তি ব্যবহার করে তদন্তে অনেক দূর এগিয়েছে। তবে তদন্তের স্বার্থে তিনি সভায় হত্যাকান্ডের প্রকৃত ঘটনার বিষয়ে বর্ণনা করেননি।


শেয়ার করুন