‘তুরাগ একটি নদের নাম’ প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে

নদী বাঁচাতে সমন্বিত উদ্যোগ ‘রিভার টক’

মো. মনির হোসেন :

 

তুরাগ নদের বিরাজমান পরিস্থিতির ওপর ‘তুরাগ একটি নদের নাম’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন গত ৩ মে কালের কণ্ঠ’র ঢাকা ৩৬০ ডিগ্রি পাতায় প্রচ্ছদ রচনা হিসেবে প্রকাশিত হয়। তুরাগের বিপর্যস্ত সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি সাধারণ পাঠক থেকে শুরু করে নদীসংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। তেমনি একজন হলেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মো. আতাহারুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘তুরাগের এই বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে পরিত্রাণের অন্যতম উপায় হলো সরকার, জনসাধারণ, বেসরকারি সংস্থা ও তীরবর্তী মানুষের সমন্বয়ে একটি সমন্বিত উদ্যোগ। ’ আর তা বাস্তবায়নের জন্য তাঁর একান্ত চেষ্টায় নদী পরিব্রাজক দল ও ইসাবেলা ফাউন্ডেশনের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় নাগরিক সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান রিভার টক, যেখানে পাঁচ শতাধিক কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, নদী উন্নয়ন কর্মী, নদী ও প্রকৃতি গবেষক, কৃষিবিজ্ঞানী, শিক্ষক, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন। এই দেশ নদীমাতৃক দেশ। নদীই আমাদের জীবনরেখা। আর আমরা সবাই জানি, এ দেশের ভূভাগ পলি দ্বারা গঠিত। হাজার হাজার বছর ধরে নদীবাহিত পলি জমে ধীরে ধীরে সাগর থেকে জেগে উঠেছিল এই গাঙ্গেয় বদ্বীপ। এরপর উদ্ভিদ-গাছপালা জন্মে বনভূমি ও জলাভূমি তৈরি হয় এবং জলে-স্থলে নানা প্রজাতির পশু-পাখি, মাছ ও প্রাণীর আবাসন তৈরি হয়। একসময় নদীবিধৌত কর্দমাক্ত এই ভূমিতে আমাদের পূর্বপুরুষরা আবাস গড়ে তুলেছিলেন।
এই নদীমালা আমাদের আবাসভূমি গঠন করেছে, জনপদ সৃষ্টি করেছে, খাদ্য জুগিয়েছে, হাজার হাজার বছর ধরে বয়ে নিয়ে চলেছে আমাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি। নদী আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের জাতীয় সম্পদ, নদীর জল আমাদের দেহের রক্তকণিকার মতো পবিত্র! এ আমাদের তৃষ্ণা মেটায়, ফসল ফলায়, মাটিকে করে উর্বর ও সরস। নদীমাতৃক বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক নদী। দূষণে-দখলে বিপন্ন হচ্ছে অনেক নদী। তারপর বিপন্ন থেকে বিলুপ্তির পথে। প্রতিদিনই বিলুপ্তপ্রায় নদীর তালিকায় যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন নাম। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় নদীর প্রতি যত্নশীল হওয়া এবং সমগ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে নদী-ভাবনা তৈরি করা। আর সে লক্ষ্যেই রিভার টক অনুষ্ঠানের আয়োজন। এই আলোচনা অনুষ্ঠানে নদী পরিব্রাজক দলের সভাপতি মো. মনির হোসেনের সভাপতিত্বে প্যানেল অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মো. আতাহারুল ইসলাম, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান আখতারুজ-জামান খান কবীর, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর, নদী, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য গবেষক ড. আনিসুজ্জামান খান, যুক্তরাষ্ট্রের ডেলটা স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ড. এ এইচ এম আলী রেজা ও কৃষি-গণমাধ্যমকর্মী চাষী মামুন, কৃষিবিজ্ঞানী ড. পরিতোষ কুমার মালাকার ও ড. কামরুল ইসলাম মতিন।

বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান আখতারুজ-জামান খান কবীর অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, ‘ঢাকার চারপাশে নদ-নদীগুলো নিয়ে যে মহাপরিকল্পনা করা হয়েছে, তুরাগ নদও তার অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন তুরাগ নদের বিভিন্ন স্থানে পরিবেশবান্ধব নদী পর্যটনের কথা ভাবছে, যেখানে থাকবে সুন্দর ওয়াকওয়ে, রিভারসাইড গার্ডেন, থাকবে বুটিংয়ের ব্যবস্থা। মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা নদীর পাড়ে কাটিয়ে দেবে। আমি মনে করি, নদী পর্যটনের এ উদ্যোগ তুরাগ নদকে সুরক্ষার ক্ষেত্রে অনেকটা অবদান রাখবে। ’

নদী, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য গবেষক ড. আনিসুজ্জামান খান বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে আলোচিত বিষয় জলবায়ু পরিবর্তন। বিশ্বের তাপমাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীর স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট হয়ে নানা রকম বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের মতো ক্রান্তীয় জলবায়ুর দেশে বর্ধিত তাপমাত্রার প্রভাব এরই মধ্যে পড়তে শুরু করেছে। গাজীপুরও এর ব্যতিক্রম নয়। তুরাগসহ গাজীপুরের বিভিন্ন নদ-নদী, খাল-বিল যদি আমরা রক্ষা করতে না পারি, তাহলে এই এলাকার আর্দ্রতা কমে যাবে, তাপমাত্রা বেড়ে যাবে। এতে এলাকার মানুষসহ জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে। ভয়াবহ বন্যার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ডায়রিয়া ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেবে। কৃষি উৎপাদন হ্রাস পাবে। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বাড়বে। গাছপালা, লতাগুল্ম, উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে। দেখা দেবে নিরাপদ খাবার পানির তীব্র সংকট। মিঠা পানির প্রাপ্যতা হ্রাস পাবে। সর্বোপরি সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা হুমকির মুখে পড়বে। তাই এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য তুরাগসহ অন্যান্য নদ-নদী ও খাল-বিল রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি দেশের নদী, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গণমাধ্যমকেও নিয়মিত এমন প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে গণসচেতনতা ও কর্তৃপক্ষের যথাযথ দায়িত্বে অবহেলার বিষয়গুলো তুলে ধরতে হবে। ’ বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কাজী বদরুদ্দোজা চৌধুরী মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত রিভার টকের আয়োজক সহযোগী হিসেবে ছিল বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন, ট্যুরিজম অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, পাঠশালা ও কালের কণ্ঠ’র পাঠক সংগঠন শুভসংঘ।

উপস্থিত নদীপ্রেমী দর্শক, তরুণ শিক্ষার্থী, গবেষক, নদী উন্নয়ন কর্মী ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রশ্ন ও মতামতের মধ্য দিয়ে নিম্নলিখিত প্রস্তাব উঠে আসে—

১. তুরাগ বাঁচাতে অতি সত্বর নতুন করে তুরাগের সীমানা নির্ধারণ করা।

২. তুরাগ দখলদারদের তালিকা হালনাগাদ করা এবং তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা।

৩. তুরাগ দূষণকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তালিকা হালনাগাদ করা এবং তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা।

৪. দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে উচ্চ হারে ক্ষতিপূরণ আদায় করা এবং সেই টাকা তুরাগ নদ ব্যবস্থাপনায় ব্যবহার করা।

৫. তুরাগ-তীরবর্তী প্লাবনভূমি ব্যবহারে নীতিমালা কঠোর করা। প্রয়োজনে নদী রক্ষায় বিশেষ বিশেষ স্থানে প্লাবনভূমি অধিগ্রহণ করা।

৬. টেকসই নদী ব্যবস্থাপনায় জেলা প্রশাসন কর্তৃক নিয়মিত নদী পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা।

৭. তুরাগ সুরক্ষায় পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা ও সমন্বয় বৃদ্ধি করা।

প্রতিবেদনে তুরাগের বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে আমি স্তম্ভিত হয়েছি

মো. আতাহারুল ইসলাম

চেয়ারম্যান, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন

নদী বাঁচলেই বাংলাদেশ বাঁচবে। কৃষ্টি-সংস্কৃতি, সভ্যতা ও প্রাণ-প্রকৃতি টিকে থাকবে। কালের কণ্ঠ’র ‘তুরাগ একটি নদের নাম’ প্রতিবেদনে তুরাগের বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে আমি স্তম্ভিত হয়েছি। তার পরই আমরা পর পর কয়েকবার তুরাগ নদ পরিদর্শন করি। বলা যায়, তুরাগ এখন বায়োলজিক্যালি ডেথ। এ নদটিকে বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ঢাকা ও গাজীপুর জেলা প্রশাসককে নির্দেশনা দিয়েছি। তাঁরা এরই মধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। আরেকটি কথা স্পষ্ট করে বলতে চাই, তুরাগ রক্ষা ও ব্যবস্থাপনায় তুরাগপারের জনসাধারণের মতামত ও সহযোগিতা বড়ই প্রয়োজন। আজ রিভার টক অনুষ্ঠানে আপনাদের মধ্য থেকে যে প্রশ্ন ও মতামত পেয়েছি, তাতে আমি অভিভূত। আপনাদের কাছ থেকে পাওয়া মতামত ও প্রস্তাব আমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দেব। পাশাপাশি আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই, আপনাদের প্রাণের ও ভালোবাসার তুরাগ নদ সুরক্ষায় প্রশাসনিক উদ্যোগ আরো তৎপর ও বেগবান হবে। তবে আপনাদের কাছে আমার একটি অনুরোধ, আপনারা আজ যেভাবে জেগেছেন, আগামী দিনগুলোতে এভাবেই জেগে থাকবেন। আমি বিশ্বাস করি, নদীতীরবর্তী মানুষ ও তরুণরা জেগে থাকলে নদী সুরক্ষার কাজ অনেক দূর এগিয়ে যাবে। আর জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আপনাদের সহযোগিতা নিয়ে নদী সুরক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখবে।

নদী দখল ও দূষণকারীদের ব্যাপারে আমার অবস্থান জিরো টলারেন্স

ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর

জেলা প্রশাসক, গাজীপুর

পদ্মা, মেঘনা, যমুনা—এই আমাদের ঠিকানা। সোনার বাংলার পরিচিতি এই নদীমালার মাঝেই। তেমনি গাজীপুরের পরিচিতি তুরাগ নদের মাঝেই নিহিত। বিশ্ব ইজতেমার কারণে তুরাগ নদ বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিতি পেয়েছে। এই তুরাগ গাজীপুরের প্রাণ, গাজীপুরের অস্তিত্ব। তাই গাজীপুরের অস্তিত্ব ও সভ্যতা রক্ষার্থে তুরাগ রক্ষা করা অত্যাবশ্যক। তুরাগ নদের নতুন করে সীমানা নির্ধারণের কাজ শেষ হলে আমরা উচ্ছেদ অভিযানে যাব। আর এর মধ্যে যাতে নতুন দখল হতে না পারে, সে জন্য গাজীপুর জেলা প্রশাসন থেকে পরিদর্শন অব্যাহত থাকবে। দখলদারদের তালিকা হালনাগাদ হবে, দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের তালিকা হালনাগাদ হবে। নদী দখল ও দূষণকারীদের ব্যাপারে আমার অবস্থান জিরো টলারেন্স। নদী আমাদের জাতীয় সম্পদ। আর এই সম্পদ রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সবারই। কারণ জাতীয় সম্পদ রক্ষা করা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অঙ্গীকার। সবার সহযোগিতা নিয়ে অবশ্যই আমরা জাতীয় সম্পদরূপী এই তুরাগ নদ বাঁচাতে পারব।


শেয়ার করুন