নদী দখল ও দূষণকারীদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা বিবেচনা করি না

নদী দূষণকারীদের নাম প্রকাশ করা হবে-নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান

ডেস্কঃ

দেশের নদ-নদী দূষণকারীদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তালিকাটি চূড়ান্ত করার পর নদী রক্ষা কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। এতে সরকারি-বেসরকারি যেসব প্রতিষ্ঠানের নাম আসবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেওয়া হবে স্থানীয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের। পাশাপাশি নদীর নতুন নতুন দখলদারদের তালিকাও আপডেট করা হচ্ছে। সোমবার রাজধানীর নিজ কার্যালয়ে যুগান্তরকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, নদীর ইকো-সিস্টেম রক্ষার দিকেও মনোযোগ দিয়েছে কমিশন। ইকো-সিস্টেম নষ্ট করে বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নদী দখল ও দূষণকারীদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা থাকলেও তা বিবেচনায় নেওয়া হয় না। নদী দখল-দূষণ রোধের যে লক্ষ্যে নদী রক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে তা অর্জিত হচ্ছে কি না, তা জানতে চাওয়া হয় চেয়ারম্যানের কাছে। উত্তরে ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, কোনো কমিশনই তার লক্ষ্য অনুযায়ী শতভাগ সফল হয় না। তবে নদী রক্ষা কমিশন ৫৭ হাজার নদী দখলদার চিহ্নিত করে তাদের তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে ১৪ হাজার দখলদার উচ্ছেদ করা হয়েছে। নদী থেকে দখলদার উচ্ছেদ কার্যক্রম চলমান। আমাদের নির্দেশনাগুলো মূলত জেলা প্রশাসন, ইউএনওসহ বিভিন্ন সংস্থা বাস্তবায়ন করছে। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর সীমানা কমিশন চিহ্নিত করে দিয়েছে। সেখানে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন উদ্ধার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। নদীর তীরে সীমানা পিলার স্থাপন চলছে। তবে যে বিষয়ে আমরা খুব একটা এগোতে পারেনি বা জোরালো ভূমিকা নিতে পারিনি সেটা হচ্ছে-দূষণ। এখন আমরা নদী দূষন ও নদীর ইকো-সিস্টেম যারা ক্ষতিগ্রস্ত করছে তাদের বিরুদ্ধে নামছি। তিনি বলেন, আমরা দূষণকারীদের তালিকা সংগ্রহ করছি। পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসন- দুই মাধ্যম থেকে তালিকা আনা হচ্ছে। ইতোমধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের আটটি বিভাগের মধ্যে সাতটি থেকে তালিকা এসেছে। ৬৪টি জেলা প্রশাসনের মধ্যে অন্তত ২০টি জায়গা থেকে তালিকা এসেছে। বাকিগুলো আসছে। আমরা এসব যাচাই-বাছাই করছি। পরে পুরো তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। তিনি আরও বলেন, অনেক শিল্প-কারখানা এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ইটিপি) থাকার পরও তা ব্যবহার না করে মাটির নিচে অন্য পাইপের মাধ্যমে কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি সরাসরি নদীতে ফেলছে। এ ধরনের পাইপ শনাক্ত করতে আমরা স্ক্যানার আনছি। ওই স্ক্যানার দিয়ে যেসব শিল্প-কারখানায় এ ধরনের পাইপের সন্ধান পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

নদীর ইকো-সিস্টেম নষ্ট করায় চাঁদপুরে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী। তিনি বলেন, চাঁদপুরের মেঘনা থেকে চর আলেকজেন্ডার পর্যন্ত ১১০ কিলোমিটার ইলিশের অভয়ারণ্য। অথচ সেখানে একজন জোরজবরদস্তি করে বেআইনিভাবে তিনশ থেকে চারশ ড্রেজার দিয়ে বালু তুলত। এতে সেখানকার নদীর ইকো-সিস্টেম নষ্ট হচ্ছিল। মাছের খাবার নষ্ট হচ্ছিল। সেখানকার মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা আমাকে জানিয়েছেন, ইলিশের পেটের ভেতরে মোট খাবারের ৩৭ ভাগই বালু পাওয়া গেছে। এতে মাছের আকার ছোট হয়ে আসছে। এছাড়া এভাবে বালু তোলার কারণে পানি ঘোলা হয়। এতে পানির তলদেশে সঠিকভাবে সূর্যের আলো পৌঁছতে পারে না। এসব কারণে নদীর ইকো-সিস্টেম নষ্ট হচ্ছিল। এসংক্রান্ত তথ্য জানার পর কমিশনের পক্ষ থেকে চাঁদপুর জেলা প্রশাসনকে উচ্ছেদের নির্দেশনা দেই। দুদিনের মধ্যে কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরপর আমরা সরেজমিন গিয়ে দেখেছি সেখানে বালু উত্তোলনকারী কেউ নেই। এটা আমাদের একটি বড় সাফল্য।

নদী রক্ষা কমিশন আগে কী বালু উত্তোলনের এ খবর জানত না-এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, পরিবেশসংক্রান্ত প্রায় ১৮৫টি আইন আছে। সেখানে ডলফিনের জীবনধারণ ব্যাহত হচ্ছে। সেখানকার বণ্যপ্রাণী বিভাগ কি করেছে? মৎস্য অধিদপ্তর ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কি দায়িত্ব ছিল না? সামগ্রিকভাবে তারা সবাই ব্যর্থ হওয়ায় নদী রক্ষা কমিশন উদ্যোগ নিয়ে এ বালু উত্তোলনকারীকে উৎখাত করেছে। সব বিভাগ যদি এগিয়ে আসত তাহলে এমন কাজ করতে পারত না।

নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, আমরা যদি কোনো উৎস থেকে খবর পাই যে সেখানে আবার বালু উত্তোলন শুরু হয়েছে তাহলে আমরা সরেজমিন যাব। জেলা প্রশাসনকে জিজ্ঞাসাবাদ করব কেন আবার বালু উত্তোলন শুরু হলো, কারা নেপথ্যে, কার দোষে আসলো? এটা নিয়ে রিপোর্টও দেব।

নদী দখল ও দূষণ কার্যক্রম পরিচালনায় রাজনৈতিক বা প্রভাবশালী মহল থেকে বাধা এলে কমিশন কী করবে-এমন প্রশ্নের উত্তরে ড. মনজুর আহমেদ বলেন, নদী রক্ষা কমিশন একটি অরাজনৈতিক ও আইনগত প্রতিষ্ঠান। আমরা রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা বিবেচনায় নেই না। আমরা দেখি আইন ভঙ্গ করেছে কিনা? আইন ভঙ্গ করলে মন্ত্রী হোক বা অন্য যেই হোক-আমরা তাদের আইন ভঙ্গকারী হিসাবেই দেখব। উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী আমরা নদীর অভিভাবক। চাঁদপুরের ঘটনায় কেউ কমিশনের ওপর প্রভাব বা তদবির করবে এমন সাহস কেউ পায়নি।

নদী দখলদারদের তালিকা পুরোনো। নতুন তালিকা তৈরির বিষয়ে জানতে চাইলে কিছুটা অসহায়ত্বের কথা জানান নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, জেলা প্রশাসকেরা নতুন নতুন নদী দখলদারদের তালিকা পাঠাচ্ছে। আমরা ওই তালিকা আপডেট করছি। তবে যেসব দখলদারের তালিকা আমাদের কাছে অছে তাদের অনেককে এখনও উচ্ছেদ করা হয়নি। এছাড়া কিছু বাস্তব সমস্যা আছে। নদী রক্ষা কমিশনের জনবল ও সরঞ্জাম সীমিত। সব মিলিয়ে আমাদের কাজ করতে হচ্ছে।

–যুগান্তর


শেয়ার করুন