নদীবন্ধু মনিরের ‘নদী ও জলে ভ্রমণ’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন

বিশেষ প্রতিবেদক:

নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীই জীবনরখো। আবহমানকাল ধরেই আমাদের জীবন-জীবিকায়, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে নদীর প্রভাব অসামান্য। নদী জনপদ তৈরী করেছে, খাদ্য যুগিয়েছে, সভ্যতার আকর দিয়েছে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থাকে করেছে সহজ এবং সাবলীল। সুতরাং নদী বাঁচলেই বাংলাদেশ বাঁচবে, নদী বাঁচলেই প্রাণের অস্থিত্ব টিকে থাকবে এবং নদী বাঁচলেই সভ্যতা ও সংস্কৃতির অগ্রগতি হবে।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীর গুরুত্ব উপলব্ধি করে যিনি নদীর সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে নদীর টানে ছুটে বেড়াচ্ছেন তিনি হলেন এই গ্রন্থের লেখক মুহাম্মদ মনির হোসেন। তিনি একাধারে লেখক, কলামিস্ট, সংগঠক, পরিব্রাজক, পরিবেশবাদী এবং নদীপ্রেমিক। তার অসংখ্য লেখায় উঠে এসেছে এ দেশের নদ-নদীর দুঃসময়ের বর্ণচিত্র এবং নদীর পুনরুজ্জীবনের কথা। নদীর পরিবেশ-প্রতিবেশ ও তার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তিনি নিরলস কাজ করে পরিচিতদের কাছ থেকে ইতোমধ্যে খেতাব পেয়েছেন নদীযোদ্ধা। জীবনানন্দ দাশ যেমন বলেছিলেন-‘নদীর শব্দ শুনি আমি। নদী তুমি কোন কথা কও!’ নদীপ্রেমী মুহাম্মদ মনির হোসেনও ঘুমে জাগরণে সতত শুনতে পান নদীর কুলকুল শব্দ, নদীর হাসি, নদীর কান্না। তাই তো বিরুদ্ধ স্রোতে দাঁড়িয়েও তিনি স্বপ্ন দেখেন এমন এক নদীমাতৃক বাংলার, যেখানে জল ও পলির আশীর্বাদে আবারও জনপদ হয়ে উঠবে সুজলা-সুফলা ও শস্য-শ্যামলা। লেখকের নদীর প্রতি এই দুর্নিবার আকর্ষণ যে কাউকে নদীর প্রতি যতœশীল এবং নদীমুখী হতে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম।
নদীর বাস্তবতা বুঝতে তিনি ইতোমধ্যে দেশে -বিদেশে অসংখ্য নদ-নদী,দ্বীপ ভ্রমণ করেছেন। এর মধ্যে নান্দনিক কিছু নদ-নদীর অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন তার প্রথম ভ্রমণগ্রন্থ ‘নদী ও জলে ভ্রমণ।’
সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতার আলোকে রচিত এই গ্রন্থটি লেখকের নদীভাবনার এক অনবদ্য ও অনন্য আকর যা পাঠান্তে পাঠক এক নতুন মাত্রায় সমৃদ্ধ হবেন। লেখকের এই নদীভাবনা, দায়িত্ববোধ ও প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানিয়ে তাঁর সুস্থ-সাবলীল দীর্ঘজীবন ও উজ্জ্বল সফলতা কামনা করেছেন মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলেই।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে কবি ও গল্পকার অধ্যাপক অসীম বিভাকরের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য কামরুন নাহার আহমেদ, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান ও নদী গবেষক অধ্যাপক ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া, ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন অধ্যাপক ড. সরওয়ার মুর্শেদ, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সচিব মো. আমিনুল ইসলাম, রিভার এন্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ, বৈশাখী টেলিভিশনের সিনিয়র নিউজ এডিটর জয় প্রকাশ সরকার, সংস্কৃতিজন ও আবৃত্তি প্রশিক্ষক লিয়াকত চৌধুরী , লেখক ও গবেষক ফয়সাল আহমেদ, বইটির প্রকাশক মোস্তফা সেলিম , লেখক মুহাম্মদ মনির হোসেন ,বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দলের সেক্রেটারি জেনারেল প্রকৌশলী মো. হাবিবুর রহমান এবং পরিবেশ ও নদী রক্ষা উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এইচ এম সুমন।
‘নদী ও জলে ভ্রমণ’ গ্রন্থের লেখক মুহাম্মদ মনির হোসেন বলেন, ‘সহ¯্রাধিক নদ-নদী বাংলাদেশকে জালের মতো ঘিরে রেখেছে। তাই এই নদীর প্রতি টান আমার আশৈশব। এই টান থেকেই একসময় ভালোবাসা এবং ভালোবাসা থেকেই গভীর মমত্ববোধে নদীর কাছে ছুটে চলা। আর এভাবেই নদীভ্রমণ আমার চেতনায় নেশার মতো মিশে যায়। পরবর্তীতে তরুণ সমাজসহ সকলকে নদীবিষয়ে আরও আগ্রহী ও উদ্যোগী করতে প্রতিষ্ঠা করি ’বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল।” এই সংগঠনের প্রত্যেকটি সদস্য নদীপ্রেমিক। তারাও সমবেতভাবে নদী রক্ষায় নদী ভ্রমণ, নদী পরিদর্শনসহ বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করে এবং নদীপাড়ের মানুষের কল্যাণে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে। এছাড়া সরেজমিন নদী বিষয়ে তথ্যসংগ্রহ করা, নদী ক্ষয়ে যাওয়া, নদী দূষিত হওয়ার ভয়াবহতা সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করে। এরই ধারাবাহিকতায় আমি এ পর্যন্ত প্রায় দুই শতাধিক ছোট-বড় নদ-নদী পরিদর্শন করেছি এবং নদীর দখল-দূষণ তথা নদীর সংকট নিয়ে ডজনখানেক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছি। এর পাশাপাশি প্রায় অর্ধশত ফিচার লিখেছি- যা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। নান্দনিক নদীভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছি শতাধিক ভ্রমণগল্প- যা বাংলাদেশ প্রতিদিন, দৈনিক সমকাল, দৈনিক কালের কণ্ঠ ও বণিকবার্তায় প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্য থেকে নির্বাচিত ২৪টি গল্প নিয়ে আমার প্রথম ভ্রমণগ্রন্থ ‘নদী ও জলে ভ্রমণ’ প্রকাশ হচ্ছে। মূলত নদীর প্রতি দায়বোধ থেকেই আমি গল্পের মাধ্যমে পাঠকদেরকেও এদেশের নদ-নদীসহ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে আরও আগ্রহী করে তোলার চেষ্টা করেছি মাত্র। আমার বিশ্বাস, এই বইয়ের পাঠক নদীবিষয়ে নানাতথ্যে সমৃদ্ধ হয়ে নদীর প্রতি আরও টান অনুভব করবে। ফলে নদীমার্তৃক পরিচয়ের সাথে প্রত্যেকের নতুন করে একটি আত্মিক বন্ধন সৃষ্টি হবে। আর আমার সার্থকতা সেখানেই।’
প্রধান অতিথির বক্তব্যে কামরুন নাহার আহমেদ বলেন, ‘নদী ও জলে ভ্রমণ’ একটি অনন্য কাজ হয়েছে, নদী সুরক্ষায় ও নদী ভাবনা তৈরীতে এ ধরনের কাজ গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
মূল আলোচনায় রিভার এন্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ভ্রমণবিষযক লেখা একধরনের ডকুমেন্টেসন। এটা ঠিক থাকলে লেখা কলোত্তীর্ন হয়। যে ভাবে ইবনে বতুতা, সেবাস্টিয়ান মানরিখ, নিকোলাই মানচ্চির ভ্রমণ বিষযক লেখা থেকে বঙ্গীয বদ্বীপের ইতিহাস ও ঢাকার ইতিহাস চিত্রায়িত হয়েছে । মুহাম্মদ মনির হোসেনের ‘নদী ও জলে ভ্রমণ’ বইতে তিনি চার দেশের নদী ও জলাভূমির সৌন্দর্য্য ও জীববৈচিত্র্যের চিত্র তুলে ধরেছেন।
প্রফেসর ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া বরেন, ‘নদী ও জলে ভ্রমণ’ গ্রন্থের লেখক মুহাম্মদ মনির হোসেনের নদীর প্রতি দরদ ও তৎপরতা বাংলাদেশে প্রকৃতই একজন নদীবন্ধু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তার এই লেখা একটিভিজমের সাথে আর একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
অনুষ্ঠানের সভাপতি কবি ও গল্পকার অধ্যাপক অসীম বিভাকর বলেন, একটা সত্য অন্তরকে স্পর্শ করলেই সেই সত্যকে ভাষায় রুপদান করা যায়।


শেয়ার করুন