‘দোজখের দেবতা’র দ্বারে নাসার নভোযান

Pluto_NH_Historic-Mission_tসিটিএন ডেস্ক:

প্লুটো। সূর্যের বিতর্কিত সন্তান। ১৯৩০ সালে আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকে তার পদবী ছিল সৌরজগতের নবম গ্রহ হিসেবে। কিন্তু নানা বিতর্কের মুখে ২০০৬ সালে গ্রহপরিবার থেকে পতন হয় প্লুটোর। সবার শেষে আবিষ্কার, সবার শেষে বহিষ্কার—লাস্ট ইন ফাস্ট আউট।

প্লুটোর পরিচয় এখন ‘বামন গ্রহ’। এই পুঁচকে গ্রহের গ্রহত্ব নিয়ে যেমন বিতর্ক ছিল, তেমনি আবিষ্কারের পর এর নামকরণ নিয়েও বেঁধেছিল ঝামেলা। অবশেষে গ্রিক পুরাণের ‘আন্ডারওয়ার্ল্ডের দেবতা’ প্লুটোর নামে এর নাম দেওয়া হয়। লাতিন সাহিত্যে প্লুটোকে বলা হয় ‘দোজখের দেবতা’। হ্যাঁ, ‍নরকের এই নৃপতির সঙ্গে ‘দেখা’ করতেই নভোযান পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসার ‘নিউ হরিজনস’ মঙ্গলবার প্লুটোর সবচেয়ে কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছবে। দূরত্ব থাকবে মাত্র সাড়ে ১২ হাজার কিলোমিটার।

বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার বিকেল ৪টা ৪৯ মিনিট ৫৯ সেকেন্ডে প্লুটোর কাঙ্ক্ষিত নৈকট্য লাভ করবে নিউ হরিজনস, যা পৃথিবী থেকে যাত্রা শুরু করেছিল ২০০৬ সালে।

এই ঘটনাকে ‘ঐতিহাসিক ও রোমাঞ্চকর’ বলে অভিহিত করেছেন নাসার এই মিশনের প্রধান গবেষক (প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর) এ্যালান স্টার্ন।

দ্য রিপোর্টকে ইমেইলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রবিবার ড. এ্যালান স্টার্ন বলেন, ‘আমরা সত্যিই জানি না, কি খুঁজে পাব। কিন্তু ইতিহাস বলছে, আমরা রোমাঞ্চিতই হব।’

২০০৬ সালের ১৯ জানুয়ারি যাত্রা শুরু করেছিল নিউ হরিজনস। তখনও কিন্তু প্লুটো গ্রহ ছিল। ওই বছর অক্টোবরে গ্রহদল থেকে পতন হয় ‘বরফি বামন’টির। কতটা বামন জানেন, আকারে প্লুটো আমাদের একমাত্র চাঁদের তিন ভাগের দুই ভাগ মাত্র। প্লুটোর নিজের চাঁদ রয়েছে পাঁচটি।

পৃথিবী থেকে প্লুটো বহু দূরে। এদের মধ্যে ন্যূনতম দূরত্ব হচ্ছে ৪৭০ কোটি কিলোমিটার (সবচেয়ে বেশি সাড়ে সাতশ’ কোটি কিলোমিটার)।

এ রকম দূরত্বে যেখানে সূর্যের আলো পৃথিবীর সাপেক্ষে হাজার ভাগের এক ভাগ মাত্র—অমন ধোঁয়াটে ধরায় অভিযাত্রাকে কীভাবে দেখছেন? এমন প্রশ্ন করা হলে বাংলাদেশের অন্যতম বিজ্ঞানচিন্তক আসিফ বলেন, ‘মহাকাশে অভিযাত্রার সম্প্রসারিত করার মাধ্যমে মানুষ আসলে নিজেই ছড়িয়ে পড়তে চাচ্ছে।’

পেশাদার এই বিজ্ঞানবক্তা রবিবার টেলিফোন সাক্ষাৎকারে দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘মানবজাতি মনে করতে চায়, সে পৃথিবীর বাসিন্দা নয়, বাসিন্দা নয় সে মঙ্গলের। সে আসলে এই সৌরজগতের বাসিন্দা।’

ডিসকাশন প্রজেক্টের সহ-উদ্যোক্তা আসিফ বলেন, ‘চুরি ধূমকেতুতে পদার্পণ কিংবা কুইপার বেল্টে প্লুটো পরিদর্শন—এ সব অভিযানের মাধ্যমে মানুষ সৌরজগতে তার শক্তি পরীক্ষা করে দেখছে। সে যদি দেখে, সৌরজগতে সে-ই শক্তিমান, তাহলে সে স্বপ্ন দেখে—একদিন এই সূর্যভিটার যত্রতত্র সে ঘুরে বেড়াবে।’

নিউ হরিজনসের প্লুটো-দর্শন নিয়ে কথা বলতে যোগাযোগ করা হয়েছিল মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী সারা সিগারের সঙ্গে।

ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটির) এই অধ্যাপক রবিবার এক ইমেইলে দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘নিসন্দেহে এ এক ঐতিহাসিক অভিযান। মহাকাশ অভিযাত্রায় তাৎপর্যপূর্ণ এক পদক্ষেপ।’

নিউ হরিজনস মিশনে রয়েছে বেশ কয়েকটি যন্ত্র। এর মধ্যে অন্যতম ‘এ্যালিস’। এটা প্লুটোর আবহাওয়ায় স্পেকট্রা নিয়ে গবেষণা করবে। রয়েছে বিশেষ ক্ষমতার চোখ ‘লরি’। যান্ত্রিক এই চোখের মনি ‘২০ সেন্টিমিটার বিস্তৃত’—ইমেইল সাক্ষাৎকারে দ্য রিপোর্টকে জানিয়েছেন মিশনের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ড. হেনরি থ্রুপ (দ্য রিপোর্টকে দেওয়া বিজ্ঞানী হেনরির পুরো সাক্ষাৎকার শিগগিরই প্রকাশ করা হবে)।

লরি দিয়ে প্লুটোর সূক্ষাতিসূক্ষ বিষয়গুলো ক্যামেরাবন্দী করা হবে। আর সেই সব তথ্যচিত্র নিউ হরিজনস পাঠিয়ে দেবে পৃথিবীতে, নাসার অপেক্ষমাণ বিজ্ঞানীদের কাছে।

অবশ্য দূরত্ব এত বেশি যে, মাত্র ক’দিনে লরি যত ছবি তুলবে সেসব ঠিকমতো পৃথিবীতে পৌঁছতে এক বছর চার মাস লাগবে।

প্রসঙ্গত, এর আগে বুধ থেকে নেপচুন—পৃথিবীসহ আটটি গ্রহেই এ ধরনের অভিযান পরিচালিত হয়েছে। এবার ‘সনাতনী নয় গ্রহের’ শেষ সদস্য প্লুটোতে এই অভিযানের মাধ্যমে পূর্ণ হল সেই ধারাবাহিকতা।

সর্বশেষ ১৯৮৯ সালে নেপচুনকে খুব কাছ থেকে ঘুরে গিয়েছিল নাসার ভয়েজার-২ নভোযান।


শেয়ার করুন