দেশব্যাপী অস্ত্র উদ্ধার অভিযান সীমান্তে কঠোর নজরদারি

বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার হচ্ছে কিনা তা নিয়ে তদন্ত চলছে * রেজিস্ট্রেশনবিহীন মোটরসাইকেল আটকের নির্দেশ

ফাইল ছবি

ডেস্ক নিউজঃ

তৃতীয় ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতা রোধে কঠোর অবস্থানে সরকার। রক্তপাতহীন ভোট করতে দেশে অবৈধ অস্ত্র ও গুলি প্রবেশ রোধে সীমান্তে কঠোর নজরদারির জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের পাশাপাশি নির্বাচনে বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। এছাড়া আটক করতে বলা হয়েছে চোরাই ও রেজিস্ট্রেশনবিহীন মোটরসাইকেল। গত দুই ধাপে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সহিংস ঘটনায় দেশি অস্ত্রের পাশাপাশি পিস্তল এবং রাইফেল ব্যবহার হয়েছে। এসব ঘটনায় ৫৯ জন মারা গেছেন, আহত হয়েছেন ১২শ।

এতেই মূলত সরকারের টনক নড়েছে। এ পরিস্থিতিতে ৬৪ জেলার পুলিশ সুপার ও ইউনিটপ্রধানকে চিঠি দিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান শুরুর নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে ১৫ নভেম্বর থেকে দেশব্যাপী অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান শুরু হয়েছে। পিরোজপুরে এক চেয়ারম্যান প্রার্থী বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার করায় তাকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি হায়দার আলী খান যুগান্তরকে জানান, সারা দেশেই আমাদের অভিযান চলছে। প্রাথমিকভাবে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত এ অভিযান চলবে। প্রয়োজনে বিশেষ অভিযানের মেয়াদ বাড়ানো হবে। তিনি বলেন, অভিযান সফল করতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে বিভিন্ন ইউনিটপ্রধান এবং সব জেলার এসপিদের বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী অবৈধ অস্ত্র, মাদক, চোরাই ও রেজিস্ট্রেশনবিহীন মোটরসাইকেল আটক ও উদ্ধার করা হচ্ছে। বৈধ অস্ত্র ও গুলির অবৈধ ব্যবহার হচ্ছে কিনা সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখছে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা।

তবে এ উদ্ধার অভিযান ফলপ্রসূ হবে না বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, নির্বাচনের আগে বৈধ অস্ত্র জমা নেওয়া প্রয়োজন ছিল। এরপর অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান শুরু হলে এর সুফল পাওয়া যেত। সীমান্তে নজরদারির বিষয়ে তারা বলেন, প্রথম ধাপের নির্বাচনের আগে এটা করা উচিত ছিল। কারণ দেশে অবৈধ অস্ত্রের বড় বড় চালান আসে সীমান্তের ওপার থেকে।

এ চ্যানেলগুলো বন্ধ এবং বৈধ অস্ত্র জমা নেওয়ার পর উদ্ধার অভিযান শুরু হলে তা কার্যকর হতো। তারা বলেন, এখন অস্ত্র উদ্ধারের জন্য দৃশ্যমান বড় ধরনের সমন্বিত অভিযান চালাতে হবে। অপরাধীদের গ্রেফতারের পর কোনো দিকে না তাকিয়ে সাজা দিতে হবে। এতে তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে সহিংসতা অনেকটা কমে আসতে পারে।

এ প্রসঙ্গে সাবেক আইজিপি একেএম শহীদুল হক যুগান্তরকে বলেন, ভোট শুরু হওয়ার পর অস্ত্র উদ্ধার অভিযান শুরু করে কোনো লাভ হবে না। কারণ এজন্য দরকার প্রো-অ্যাকটিভ পুলিশিং। গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। প্রার্থীদের নিয়ে বসতে হবে। যাদের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার আশঙ্কা আছে তাদের চিহ্নিত করে নোটিশ দিতে হবে, সতর্ক করতে হবে।

পর্যাপ্ত চেকপোস্ট বসাতে হবে। গত দুটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পুলিশ এ ধরনের কোনো প্রো-অ্যাকটিভ কাজ করেছে বলে চোখে পড়েনি। কেবল ট্রেডিশনাল কাজ করেছে। এ কারণে নির্বাচনে সহিংসাতা এড়ানো যায়নি। এবার পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান চালানোর ঘোষণা দেওয়া হলেও এটা খুব একটা কার্যকর হবে বলে মনে হয় না।

কারণ যাদের কাছে অস্ত্র আছে, পুলিশ তাদের চিহ্নিত করতে পারেনি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চিহ্নিত হলেও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, গত ধাপের ইউপি নির্বাচনে মাদারীপুরের কালকিনিতে শতাধিক বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের কাছে এ বিষয়ে আগাম তথ্য ছিল না । এটা নিঃসন্দেহেই গোয়েন্দা ব্যর্থতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, তৃতীয় ধাপের নির্বাচনেও হতাহতের আশঙ্কা আছে।

সূত্র জানায়, গত দুই ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে অবৈধ অস্ত্রের যথেচ্ছ ব্যবহার হয়েছে। গুলির ঘটনার পাশাপাশি ঘটেছে বোমা বিস্ফোরণও। এতে ব্যাপক হতাহত হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত দুই ধাপের ইউপি নির্বাচনে হতাহত হয়েছেন প্রায় এক হাজার ২০০ জন। নিহত হয়েছেন ৫৯ জন। এমন প্রেক্ষাপটে আগামী ২৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে তৃতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচন। প্রথম ধাপের নির্বাচন হয় ২১ জুন ও ২০ সেপ্টেম্বর। আর দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচন সম্পন্ন হয় গত ১১ নভেম্বর।

সূত্র আরও জানায়, দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচন ঘিরে যশোরের শার্শা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম, সিলেটের গোয়াইনঘাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার তেলটুপি ও ভারতের মিজোরাম সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অস্ত্রের চালান বেশি এসেছে। তাই এবার যাতে সীমান্ত দিয়ে কোনো অবৈধ অস্ত্র ও গুলির চালান প্রবেশ না করে, সে বিষয়ে বিশেষ নজর দিতে সীমান্তবর্তী জেলার এসপিদের বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

বিশেষ অভিযানের প্রথম দুদিনে কত অস্ত্র-গুলি উদ্ধার করা হয়েছে বা কতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে সে বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ কর্মকর্তা হায়দার আলী খান বলেন, এখনো পর্যাপ্ত তথ্য পুলিশ সদর দপ্তরে আসেনি। দেশে কী পরিমাণ বৈধ, অবৈধ অস্ত্র ও গোলা-বারুদ আছে- জানতে চাইলে বলেন, এই মুহূর্তে এই তথ্যটি আমার কাছে নেই। তিনি বলেন, আমাদের অভিযান কেবল অবৈধ অস্ত্র, গোলা-বারুদের বিরুদ্ধে।

তবে কোথাও যদি বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার হয় সেখানে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছি। পিরোজপুরে এক চেয়ারম্যান প্রার্থী বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার করায় তাকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। গত দুই ধাপের নির্বাচনে বৈধ অস্ত্র-অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার কেমন হয়েছে তা শনাক্তে তদন্ত চলছে। তদন্তের পর এ নিয়ে বিস্তারিত বলা যাবে। হায়দার আলী খান বলেন, গত দুই ধাপের নির্বাচনে পিস্তল এবং দেশীয় অস্ত্র বেশি ব্যবহার হয়েছে।

নির্বাচনের সময় সাধারণ বৈধ অস্ত্র জমা নেওয়া হয়। গত দুই ধাপের নির্বাচনে বৈধ অস্ত্র জমা নেওয়া হয়েছে কী? তৃতীয় ধাপের নির্বাচনকে ঘিরে এ বিষয়ে পুলিশের সিদ্ধান্ত কী-জানতে চাইলে ডিআইজি হায়দার বলেন, বিষয়টির সমন্বয় করেন নির্বাচন কমিশন এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। গত দুই ধাপের নির্বাচনে কোনো অস্ত্র জমা নেওয়া হয়েছে বলে আমার জানা নেই। তিনি বলেন, নির্বাচনের সময় পুলিশ কাজ করে নির্বাচন কমিশনের অধীনে। সামনের নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন যদি এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত দেয় তাহলে পুলিশ তা বাস্তবায়ন করবে।

এ বিষয়ে সাবেক আইজিপি মোদাব্বির হোসেন চৌধুরী বলেন, নির্বাচন একটি রাজনৈতিক বিষয়। রাজনৈতিক কারণেই সহিংসতা হয়। আমি রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। তবে এটুকু বলতে চাই, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া নির্বাচনি সহিংসতা বন্ধ করা সম্ভব নয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্থানীয় নির্বাচনে গোষ্ঠীগত হানাহানি বেশি হয়। অতীতেও হয়েছে। এখন কেন বেশি হচ্ছে তা সবাই কমবেশি জানেন। তাই সমস্যার মূলে গিয়ে সমাধান বের করে আনতে হবে।

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন যুগান্তরকে বলেন, অস্ত্র উদ্ধার হলো র‌্যাবের অন্যতম প্রধান ম্যান্ডেট। সব সময়ই আমরা এ সংক্রান্ত অভিযান পরিচালনা করি। গত দুদিনেও বেশ কয়েকটি অস্ত্র উদ্ধার করেছি। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪৭৮টি অভিযানে ৬-৬টি আগ্নেয়াস্ত্র ও পাঁচ হাজার ২৯৯ রাউন্ড গোলা-বারুদ উদ্ধার করা হয়েছে।

এসব অভিযানে ৪৭৮ জন অস্ত্রধারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া অস্ত্রের কারখানাও আবিষ্কার করেছি। তিনি বলেন, গত দুই ধাপের নির্বাচনে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার এবং হানাহানির ঘটনা নির্বাচন কমিশনের নজরে এসেছে। আমাদের নজরেও এসেছে। নির্বাচনকালীন আমরা রিটার্নিং অফিসার এবং ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে দায়িত্ব পালন করি। র‌্যাব মূলত স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে তিন নম্বর লেয়ারে কাজ করে। প্রথম লেয়ারে পুলিশ ও আনসার এবং দ্বিতীয় লেয়ারে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশে (বিজিবি) থাকে। তৃতীয় ধাপের নির্বাচন সুষ্ঠু করতে আমরা নির্বাচন কমিশনকে সব ধরনের সহায়তা করতে প্রস্তুত আছি।

র‌্যাব পরিচালক বলেন, তৃতীয় ধাপের নির্বাচনকে ঘিরে কোনো বিশেষ মহলের কাছে অস্ত্র আছে এ সংক্রান্ত তথ্য এই মুহূর্তে র‌্যাবের কাছে নেই। তবে র‌্যাব এ বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়েছে। কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেলে আমরা অভিযান চালাব। তিনি বলেন, প্রত্যেক নির্বাচনের আগমুহূর্তে নির্বাচন কমিশন বেশকিছু কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে। ওইসব কেন্দ্রে আমাদের বিশেষ নজরদারি থাকবে। পাশাপাশি বাড়তি ফোর্স মোতায়েন করা হবে।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) কামরুজ্জামান বলেন, তৃতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে যাতে একটি অবৈধ অস্ত্রেরও ব্যবহার না হয় সে ব্যাপরে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে মাঠ পর্যায়ে কড়া বার্তা দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনে আমরা প্রাণহানি দেখতে চাই না। কোনো সংঘর্ষও দেখতে চাই না। তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে যে কোনো মূল্যে অবৈধ অস্ত্রের যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধ করা হবে।


শেয়ার করুন