দুর্গোৎসব সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত

photoমুহম্মদ নূরুল ইসলাম:
বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এ দেশে সব ধর্মের মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয় ধর্মীয় উৎসবগুলো। বিশেষ করে হিন্দু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শারদীয় দুর্গোৎসব, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সাংগ্রেং বা নববর্ষ ও ওয়া¹ে (প্রবারণা উৎসব) এবং মুসলমানদের ঈদ-উল ফিতর ও ঈদ-উল-আযহা। ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের লোকেরা এসব উৎসবে একত্রিত হয়ে উৎসবকে আরো প্রাণবন্ত করে তোলে। অনস্বীকার্য যে, আমাদের সমাজেও এক ধরনের আসুরিক শক্তি বিরাজিত। একশ্রেণির সুবিধাবাদী রাজনীতিক, উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠি এসবের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে সম্প্রীতিতে আঘাত করার অপচেষ্টা করে থাকে। যে কারণে মানুষে মানুষে এত ভেদাভেদ, রেষারেষি, মারামারি, কাটাকাটি। এ অপশক্তির অকল্যাণকর কাজে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। এ ধরনের কর্মকাণ্ড কোনো জাতির জন্য শুভফল বয়ে আনে না। কিন্তু এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ দরকার। আমরা চাই সমাজ-সংসার-রাষ্ট্র থেকে সব অশুভ, অপশক্তির বিনাশ হোক। দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন অটুট হোক, দূর হোক জাতি-বর্ণ প্রথাসহ সব বিভেদনীতি। শক্তিশালী হোক মিলন ও সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির ধারা।
বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দুর্গাপূজা এখন আর শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। শারদীয় দুর্গোৎসব বাঙালি হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হলেও উৎসবকে ঘিরে সব ধর্মের মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ লক্ষ্য করা যায়। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকেও শারদীয় উৎসব গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। দেবী দুর্গার শ্রীমূর্তি দর্শনে সব বর্ণ-ধর্মের মানুষের আনাগোনায় মুখর হয়ে ওঠে পূজামণ্ডপগুলো। ধূপের ধোঁয়া, শঙ্খ, উলুধ্বনি আর ঢাকের বাদ্যে এ উৎসব পরিণত হয় মহোৎসবে। উৎসব মানুষের মনকে কলুষমুক্ত করে প্রফুল্ল করে তোলে। পূজাও উৎসবমুখর পরিবেশ মানুষকে উদার হতে শেখায়। এ সময় সব বাধা, ব্যবধান ও বিভেদের প্রাচীর ছোট হয়ে আসে। সব ধর্মের মানুষের পারস্পরিক সম্প্রীতির উন্নয়ন এবং জাতিগঠনে পূজা উৎসবকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় বিশ্বাস, প্রাচীনকালে দুর্গা দেবী শক্তিদেবী হিসেবে পূজিত হলেও ভক্তের অন্তরের কাছে তিনি চিরকালই মাতৃরূপিণী। পেশিশক্তি, ধন ও বিদ্যাশক্তি লাভের সঙ্গে নতুন যে শক্তি যুক্ত হয়েছে তা হলো প্রেমভক্তি। ভক্তির এ মনোভাব সম্পূর্ণরূপে প্রতিফলিত হয় মাতৃরূপিণী দেবী দুর্গার মৃন্ময়ী মূর্তিতে। দুর্গা হচ্ছে মূলত দুর্গতিনাশিনী দেবী, শিবপতœী ভগবতী। জগতের সব ধরনের আসুরিক শক্তি বিনাশপূর্বক দেবী দুর্গা মানবহৃদয়ে সততা, শক্তি ও প্রেমভক্তিরস জাগ্রত করেন। সঙ্গত কারণে দেবী দুর্গা কখনো শক্তিরূপিণী, মাতৃরূপিণী, ধনরূপিণী আবার কখনো শত্রুবিনাশিনী হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন, বোধনের মধ্য দিয়ে দেবীর মর্তে আগমন, আর বিসর্জনের মাধ্যমে কৈলাসধামে ফিরে যাবেন তিনি। তিনিই আদ্যাশক্তি, মহামায়া, শিবানী, ভবানী, দশভুজা ও সিংহবাহনা। মানবের কল্যাণে এবং অশুভর ওপর শুভর বিজয়কে তিনি নিশ্চিত করেন। অশুভ শক্তির প্রতীক অসুরদের দলপতি মহিষাসুরকে বধ করে দেবী দুর্গা দেবকুলকে রক্ষা করেছিলেন। এর মধ্য দিয়ে নিশ্চিত হয়েছিল অন্যায় ও অশুভ শক্তির পরাজয়, ন্যায় ও শুভশক্তির জয়। তিনি মানুষকে মহৎ হতে প্রাণিত করেন। মানুষের মনের দৈন্য ও কলুষ দূর করেন। বাঙালির সাংস্কৃতিক মিলনসূত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এ পূজা দেশাত্মবোধও জাগিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষ করে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনা সমুন্নত রাখার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই শারদীয় দুর্গোৎসব।
মহিশুরেই আর্বিভাব দেবী দুর্গা
আধুনিক ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের আদি নাম মহিশুর। উপমহাদেশীয় ইতিহাসের অন্যতম মহানায়ক টিপু সুলতানের স্মৃতি ধারণ করে মহিশুর নামটি আমাদের কাছে অতি পরিচিত এবং প্রিয়। মহিশুর নামটি কিন্তু অনেক অনেক কালের পুরোনো। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে পৌরাণিক কাহিনি। মহিশুর নামের উৎপত্তি দেবী দুর্গার হাতে নিহত মহিষাসুর থেকে।
কথিত আছে প্রবল পরাক্রান্ত মহিষাসুরের উৎপাতে দেবতাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়লে তাকে দমন করার জন্য দেবী দুর্গা চণ্ডী বা চামুণ্ডা রূপে আবির্ভূত হন। এই অসুর বা অপশক্তিকে যুদ্ধে হত্যা করে চামুণ্ডা দেবকুল তথা সৃষ্টিকে রক্ষা করেন। দক্ষিণ ভারতে প্রচলিত পুরাণ-কথায় জানা যায় দুর্গা আর মহিষাসুরের এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল মহিশুর নগরের কাছে চামুণ্ডা পাহাড়ে। স্থানটি তাই সেই আদিকাল থেকেই এক তীর্থভূমি। সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত আছে চামুণ্ডশ্বরী মন্দির আর মহিষাসুরের সুবিশাল মূর্তি।
তাহেরপুর থেকে শুরু দুর্গোৎসব
বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার তাহিরপুরের প্রসিদ্ধ রায় বংশ। কামদেব ভট্ট মনুসংহিতার বিখ্যাত টিকাকার কুল্লুক ভট্ট তাহিরপুরের রায় বংশের আদি পুরুষ। এই বংশের বিখ্যাত সন্তান কংস নারায়ণ রায়। এই কংস নারায়ণ রায় পরবর্তীতে রাজা উপাধী পান। তাঁর সময়ই বাংলার শত বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির শুভ্র আকাশ আচ্ছন্ন হয় ঘন কালো মেঘে। নিদারুণ ঝঞ্ঝায় আক্রান্ত হয় অসাম্প্রদায়িক দেশ। বাংলার মসনদে অধিষ্ঠিত নবাব সুলেমান কররানির সেনাপতি কালাপাহাড়ের অত্যাচার, নিপিড়ন, হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠার কারণে হিন্দু সম্প্রদায় নিমজ্জিত হয় রক্তগঙ্গায়। তাদের ধন, প্রাণ, ধর্মবিশ্বাস বিপন্ন হয়, ভূলুণ্ঠিত হস্তধ্বংস হয় দেববিগ্রহ, দেবালয়।
তরুণ কংস নারায়ণ রায় তখন নবাব সরকারের অধীনে ফৌজদারের পদে অধিষ্ঠিত। তিনি কালাপাহাড়ের অত্যাচারের প্রতিবাদ করলেন। প্রতিকার প্রার্থনা করলেন নবাব সুলেমান কররানির কাছে। কিন্তু নবাব কংস নারায়ণ রায়ের প্রার্থনায় কর্ণপাত করলেন না।
পাঠান নবাবের এমন আচরণে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ হলেন বাঙালি জমিদার কংস নারায়ণ রায়। নবাব সরকারের সংসর্গ সঙ্গে সঙ্গেই পরিত্যাগ করলেন তিনি। বাংলাকে কালাপাহাড়ের অত্যাচার থেকে মুক্ত করতে এবং হৃত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পুনঃপ্রতিষ্টায় সিন্দুরীর জমিদার ঠাকুর কালীদাস রায়, সাঁতোরের জমিদারপুত্র গদাধর সান্ন্যাল ও দিনাজপুরের রাজভ্রাতা গোপীকান্ত রায়ের সঙ্গে বৈঠক করলেন কংস নারায়ণ রায়। অতিশয় সংগোপনে ও পূর্ণ সতর্কতা বজায় রেখে তাঁরা উপস্থিত হলেন দিল্লিতে।
দিল্লির সম্রাট আকবর তখন নবীন বাদশাহ। নিখিল ভারতে মোগলের একচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপনের স্বপ্ন তাঁর দুই চোখে। কংস নারায়ণ রায় সম্রাট আকবরকে বললেন, ‘বাংলাদেশে রাজত্ব করা প্রতিটি রাজবংশই এ পর্যন্ত হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়কে সমদৃষ্টিতে দেখেছে। তারা কখনো কারও ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করে নি। হিন্দুর মন্দির ও মুসলমানের মসজিদ বাংলায় অদ্যাবধি কোনো বিদ্বেষ সৃষ্টি করে নি। কিন্তু পাঠান শাসনামল সম্প্রীতির সেই নীতি থেকে বিচ্যুত করছে বাংলাকে। নবাবের সেনাপতি কালাপাহাড় মেতে উঠেছেন বিনষ্টের হোলিখেলায়। হে মোগল সম্রাট, আপনি বাংলা ও বাঙালিকে সাম্প্রদায়িক অনাচার ও অত্যাচার থেকে রক্ষা করুন!’
কংস নারায়ণ রায়ের কথা শুনে সম্রাট আকবর বাংলা অভিযানের জন্য প্রস্তুত হলেন। ইতোমধ্যেই সুলেমান কররানির মৃত্যু হলো। বাংলার মসনদে আরোহণ করলেন সুলেমান কররানির পুত্র দাউদ খাঁ। মোগল-পাঠান যুদ্ধ শুরু হলো। যুদ্ধে পতন হলো কালাপাহাড়ের। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে রাজমহলের কাছে যুদ্ধে মোগলদের কাছে সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত ও নিহত হলেন দাউদ খাঁ। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হলো বাংলায়।
একদিন রাজা কংস নারায়ণ রায় পণ্ডিতদের সভায় বললেন, ‘আমি একটি মহাযজ্ঞে ব্রতী হতে চাই। আপনারা আমাকে শাস্ত্রানুমোদিত একটি মহাযজ্ঞের নির্দেশ ও ব্যবস্থা দিন।’
বাসুদেবপুরের ভট্টাচার্যরা বংশানুক্রমে তাহিরপুরের ভূস্বামীদের কুলপুরোহিত ছিলেন। এই বংশের বিখ্যাত তান্ত্রিক রমেশ শাস্ত্রী তখন বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত। রাজা কংস নারায়ণ রায়ের সেই সভায় রমেশ শাস্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন।
রাজা কংস নারায়ণ রায়ের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, ‘শাস্ত্রে বিশ্বজিৎ, রাজসুয়, অশ্বমেধ ও গোমেধ এই চারটি মহাযজ্ঞের বিধি আছে। কিন্তু প্রথম দুটি যজ্ঞের অধিকারী দেশপতি সার্বভৌম সম্রাট। যেহেতু তুমি সম্রাটের অধীন একজন ভূস্বামী, তাই ওই দুই যজ্ঞের অধিকারী তুমি নও। শেষের দুটি যজ্ঞ অশ্বমেধ ও গোমেধ কলিতে নিষিদ্ধ এবং উভয় যজ্ঞই ক্ষত্রিয়ের করণীয়, ব্রাহ্মণের নয়।’
রমেশ শাস্ত্রী উত্তর দিলেন, ‘আছে। কলিতে একমাত্র মহাযজ্ঞ হচ্ছে দুর্গোৎসব। এই যজ্ঞ সব যুগে সব জাতিই করতে পারে। এই এক যজ্ঞে সব যজ্ঞের ফল লাভ হয়। সত্য যুগে সুরথ রাজা এই যজ্ঞে ব্রতী হয়ে কাম্য লাভ করেন। ত্রেতা যুগে শ্রীরামচন্দ্র রাবণ বধের উদ্দেশ্যে অকালে এই মহাযজ্ঞ করেছিলেন। তদাবধি শাস্ত্রপুরাণের মধ্যেই এই যজ্ঞ আবদ্ধ হয়ে আছে। যদি তোমার সাহস থাকে, রাজসিকভাবে তুমি দুর্গোৎসব যজ্ঞে ব্রতী হতে পারো।’
রাজা কংস নারায়ণ রায় তা-ই করলেন। রাজসিকভাবে শুরু করলেন দুর্গোৎসব যজ্ঞ। তান্ত্রিক রমেশ শাস্ত্রীর বিধানে প্রণীত হলো শাস্ত্রানুমোদিত আধুনিক দুর্গোৎসব পদ্ধতি। পরিবারসমন্বিতা প্রতিমায় বাংলাদেশেই প্রবর্তিত হলো প্রথম শারদীয় দুর্গোৎসব।
লেখক : সাংবাদিক, লোকগবেষক, সভাপতি, কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমী, আহবায়ক, কক্সবাজার ইতিহাস গবেষণা পরিষদ।


শেয়ার করুন