তৈল মর্দনের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি!

rony222গোলাম মাওলা রনি 

তৈল মর্দনের অর্থ বোঝে না এমন লোক বর্তমান সমাজে নেই বললেই চলে। তেলের বাহারি ব্যবহারের হাজারো উপকার নিয়ে লিখতে গেলে বিরাট এক মহাকাব্য তৈরি হয়ে যাবে। তেল কত প্রকার এবং কী কী অথবা তেল কোন কোন অঙ্গে কিরূপে মর্দন করলে কতটুকু সুফল পাওয়া যাবে তাও ইদানীংকালের তেলবাজরা মোটামুটি জেনে ফেলেছেন। তারা হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর তৈল রচনাটির কয়েকটি লাইন প্রায় মুখস্থ করে ফেলেছেন এবং বংশপরম্পরায় নিজেদের আওলাদ ও আওলাদদের কেউ তা মুখস্থ করার জন্য ওসিয়ত সম্পন্ন করেছেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেন— ‘বাস্তবিক তৈল সর্বশক্তিমান, যাহা বলের অসাধ্য, যাহা বিদ্যায় অসাধ্য, যাহা ধনের অসাধ্য, যাহা কৌশলের অসাধ্য— তাহা কেবল তৈল দ্বারা সিদ্ধ হইতে পারে।’ তিনি আরও বলেন— ‘যে তৈল দিতে পারিবে তাহার বিদ্যা না থাকিলেও প্রফেসর হইতে পারে। আহাম্মক হইলেও ম্যাজিস্ট্রেট হইতে পারে, সাহস না থাকলেও সেনাপতি হইতে পারে এবং দুর্লভ রাম হইয়াও উড়িষ্যার গভর্নর হইতে পারে।’
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর জন্ম হয়েছিল ব্রিটিশ ভারতে ১৮৭৭ সালে এবং তার মৃত্যুও হয়েছিল সেই আমলে অর্থাৎ ১৯৩১ সালে। ধারণা করা হয় আজি থেকে শতবর্ষ পূর্বে তিনি তৈল রচনাটি লিখেছিলেন সমসাময়িক অবস্থার অধঃপতিত চিত্র ফুটিয়ে তোলার জন্য। তিনি তৈলের ব্যবহারের নানা দিক আলোচনা করেছেন বটে। তবে কখন এবং কোন প্রযুক্তিতে তেল মর্দন করতে হবে সে ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু না বলে শুধু ইঙ্গিতে বলেছেন— ‘কিন্তু তৈল দিলেই হয় না, দিবার পাত্র আছে। সময় আছে, কৌশল আছে।’ তিনি তৈলদানের একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার কথা বলে গিয়েছেন। লোকজন গত একশ বছর ধরে শাস্ত্রী বাবুর তৈল রচনায় বিমুগ্ধ হয়ে সমাজ এবং রাষ্ট্রের সর্বস্তরে তেলের বিস্তার ঘটিয়েছেন মারাত্মক এবং আশঙ্কাজনকহারে; কিন্তু তেল প্রয়োগ সংক্রান্ত প্রযুক্তির অভাবে প্রায়ই নানান অঘটন ঘটতে দেখা যাচ্ছে। গত একশ বছরে কোনো জনদরদি একটিও তৈলদানের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেননি। কারণ সবাই তৈল মর্দন করতে এবং তৈল মর্দন পেতে সীমাহীন আবেগ-উল্লাস হৃদয়ে ধারণ করেন বটে কিন্তু প্রকাশ্যে বলে বেড়ান— আমি কোনো তেল মারামারিতে নেই অথবা আমাকে তেল মারার সাধ্য কোনো বাপের বেটা বা বেটির নেই। কাজেই তৈলদানের বিদ্যালয় যে ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষক-শিক্ষিকা পাওয়া দুষ্কর হবে তা যেমন আমি বুঝি তেমনি শাস্ত্রী বাবুও বুঝেছিলেন।
২০১৬ সালের বাংলাদেশে চলতে ফিরতে চারদিকে যে তেলের বন্যা দেখা যাচ্ছে তাতে যদি সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা না হয় তাহলে যে কোনো মুহূর্তে তেলসংক্রান্ত মহাবিপর্যয় বা সুনামি দেখা যেতে পারে। তেলের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, তেল মর্দনের সনাতনী পদ্ধতি এবং মর্দনে ব্যবহার্য তেলের গুণগতমানের কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা বা গাইড লাইন না থাকার কারণে তৈলজাত রোগবালাই মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে সর্বত্র ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে। তৈল রোগে আক্রান্ত ক্ষমতাবান বৃদ্ধ নাতনির বয়সী যুবতীর সঙ্গে প্রকাশ্যে তিড়িং বিড়িং করে নাচছেন— অকালপক্ব বালক গলায় রুদ্রক্ষের মাল্য ধারণ করত : নিজেকে সিদ্ধি বাবা বলে প্রচারে নেমেছেন। অন্যদিকে অশীতিপর বৃদ্ধা তার যুবতীকাল ফিরে পেয়েছেন বলে সকাল-বিকাল সে সাজসজ্জার বাহার দেখাচ্ছেন তাতে বঙ্গদেশের সামাজিক ভারসাম্য ভয়ানক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। কাজেই একজন সচেতন দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে আমার জন্য ফরজ হয়ে পড়েছে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচিত তৈল রচনাটির ২০১৬ মডেল অর্থাৎ সর্বাধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তিতে তৈল মর্দনের গুপ্তরহস্য উপস্থাপন করা।
আপনি যদি একজন অতি উত্তম আধুনিক ডিজিটাল তৈল মর্দনকারী নায়ক হতে চান তবে প্রথমেই নিজের কর্মের সপক্ষে যুক্তি দাঁড় করুন। আপনি এমন একটি জিনিস বা এমন কতগুলো ফায়দা হাসিল করতে চান— যা সোজা পথে রাতদিন পরিশ্রম করে কয়েক যুগ অপেক্ষা করার পরও পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ আপনার অলসতা, অশিক্ষা, চরিত্রহীনতা এবং নির্বুদ্ধিতা আপনার কাক্সিক্ষত মাকামে কোনো দিনই পৌঁছতে দেবে না। আপনি যা চান তা পাওয়ার জন্য অন্য যারা চেষ্টা করছেন তাদের কেউ কেউ সৎ, পরিশ্রমী, বুদ্ধিমান এবং চরিত্রবান মানুষ। কাজেই পরিশ্রম এবং প্রতিযোগিতা বাদ দিয়ে আপনি তেল মারার উপায় খুঁজতে থাকুন। এ পথেও বহুৎ ঝক্কিঝামেলা রয়েছে। আপনার মতো শত শত স্থূলবুদ্ধির বিবেকহীন ধড়িবাজ বড় বড় তেলের ড্রাম মাথায় নিয়ে নিষিদ্ধ প্রাণীর মতো গোঁৎ গোঁৎ শব্দে কাক্সিক্ষত জিনিসটি পাওয়ার জন্য দৌড়াচ্ছে। তারা সমস্বরে ইয়া তেলু, ইয়া তেলু মেরি মাকাম তো হাসিল কর দিয়া বলে কোমর দুলিয়ে এমনভাবে চলছে যে বহনকারী তেলের ড্রাম থেকে ভেজাল তেলের গাদ পড়ে পুরো রাস্তাটিকে পঙ্কিল, পিচ্ছিল এবং দুর্গন্ধময় করে দিচ্ছে। আপনি তাদের বালখিল্যময় উত্তেজনা এবং ভেজাল তেলের গাদযুক্ত ড্রাম দেখে সিদ্ধান্ত নিলেন— না, আপনি ওমনটি করবেন না। নতুন পদ্ধতিতে এবং রীতিমতো গবেষণা করে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে তেল মারার উপায় খুঁজে তারপর কাক্সিক্ষত বস্তুর পানে দৌড়াবেন।
আপনি প্রথমেই নিজের চালচলন, বাচালতা, রাগ চ-াল স্বভাব, রুচি, হাসি এবং হাঁ করে হাই তোলার অভ্যাসগুলো ভিডিও করুন। খাবার দাবার গ্রহণের, হাঁচি কাশি দেওয়ার ভঙ্গি, কেউ সুরসুরি দিলে কিরূপে লাফ মারেন তাও সতর্কতার সঙ্গে ভিডিও করুন। পেটের পাকস্থলীতে অম্ল যন্ত্রণা হলে আপনার মুখটি কেমন হয় তা যেমন আপনার জানা দরকার তেমনি পেটের ক্ষুধা, বুকের ক্ষুধা এবং চোখের ক্ষুধার কারণে স্থান কাল পাত্র ভেদে আপনার কিরূপ ভাবভঙ্গি হয় তা জেনে নিতে পারলে তৈল মর্দনে আপনি অধিকতর সফলতা লাভ করবেন। সক্রেটিসের ‘নিজেকে চেনো’ সূত্রের অনুসরণে আপনি আপনার বুদ্ধিমত্তা, বোকামি, কাজ করার ক্ষমতা এবং অক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা গ্রহণ করুন। আপনাকে মনে রাখতে হবে যে, তেল মর্দন হলো একটি ভয়ঙ্কর প্রতারণা এবং চুরি-ডাকাতি-ছিনতাইয়ের চেয়েও জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ কর্ম। এ কাজের জন্য আপনার নিখুঁত অভিনয় দক্ষতা, নির্বিচার এবং ভাবলেশহীনভাবে অনবরত মিথ্যা বলার কৌশল রপ্ত করা এবং একটি নিখুঁত শয়তানি মন ও রাক্ষসীয় মানসিকতা অর্জন করা অতীব জরুরি যার জন্য আপনার দরকার পড়বে কঠোর অনুশীলন এবং প্রশিক্ষণ।
তেল মর্দনকারী হিসেবে নিখুঁত দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা লাভের উত্তম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হলো আপনার পরিবার। মনে রাখবেন— যে কাজ আপনি পরিবার-পরিজন এবং আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে নিখুঁতভাবে করতে পারবেন না তা বাইরের লোকের সঙ্গে করা একেবারেই অসম্ভব। কাজেই মনের মধ্যে শুয়োরের মতো নোংরামি, হায়েনার মতো হিংস্রতা এবং শেয়ালের মতো ভ-ামি ধারণ করে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা এবং পিতা-মাতাকে যখন বিশ্বাস করাতে পারবেন যে আপনি হরিণ শাবকের মতো নিষ্পাপ, খরগোশ ছানার মতো শান্তশিষ্ট এবং মানব শিশুর মতো সরল ঠিক তখনই বুঝবেন তেলবাজির সফলতা আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আপনার দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য আপনজনকে ঠকানো আরম্ভ করুন। এমন কৌশলে ঠকান যাতে করে তারা কোনো অবস্থাতেই আপনার পিশাচ চরিত্রের সন্ধান যেন টের না পায়। আপনি অকারণে নির্ভুল এবং আকর্ষণীয় বিশ্বাসযোগ্য ভঙ্গিমায় মিথ্যা বলা রপ্ত করুন এবং তা সবার আগে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা এবং পিতা-মাতার ওপর প্রয়োগ করুন। মিথ্যায় বুৎপত্তি অর্জনের পর আপনি প্রতারণা শুরু করুন। আপনজনকে নির্ভুলভাবে প্রতারিত করুন, ঠকান এবং বঞ্চিত করুন। এভাবে করতে করতে একদিন আপনার হৃদয় পাষাণ হয়ে যাবে- আপনার অনুভূতিসমূহ এবং বিবেক মরে যাবে। ফলে আপনি নিখুঁতভাবে তেলবাজি করার জন্য একজন অতি উত্তম পদার্থ বলে বিবেচিত হবেন এবং তেলনায়ক হিসেবে আপনার কাক্সিক্ষত গন্তব্যের দিকে পথ চলা আরম্ভ করবেন।
তেল রাজ্যের একজন নায়ক হিসেবে আপনার জীবনের দ্বিতীয় পর্ব হবে তেল মর্দনের পাত্র কিংবা পাত্রী নির্বাচন করা। নির্বাচিত পাত্র কিংবা পাত্রীর সামনে গিয়ে তাকে খুব ভালোভাবে রেকি করুন। তার পদ-পদবি, ক্ষমতা, দুর্বলতা, আচার-আচরণ, শিক্ষা-দীক্ষা, পছন্দ-অপছন্দ সব কিছু খুব ভালো করে জেনে নিন। তার খাওয়া-দাওয়া, মুদ্রাদোষ, পোষা প্রাণী বা গৃহপালিত পশু-পাখি সম্পর্কেও আপনার সম্যক ধারণা থাকা আবশ্যক। আপনি আপনার তেল গুরুদের মর্মবাণী স্মরণ করুন। তেল তত্ত্বের গুরুদেব বলেন— তেল মর্দনকারীরা সব সময়ই নিজেকে অধিকতর জ্ঞানী ভাবে এবং যাকে তেল মারে তাকে খুব বোকা-সোকা বলে গণ্য করে। আপনি গুরুদেবের মর্মবাণীর সঙ্গে নতুন এক ডিজিটাল ফর্মুলা যোগ করুন। যাকে তেল মারবেন তাকে আপনি একটি উপাদেয় খাদ্যপণ্য ভাবুন। আপনি যদি পিজা পছন্দ করেন তবে গরম গরম পিজা মনে করে নিজের জিহ্বাটি নাড়াচাড়া করতে থাকুন। যদি বার্গার আপনার পছন্দের খাবার হয় তবে চিজ এবং সচসমেত টাটকা এবং গরম বার্গারটিকে কীভাবে কামড় দেবেন সে কথাও চিন্তা করতে পারেন। চিকেন বা মুরগির প্রতি দুর্বলতা থাকলে নিজের পছন্দ বা রুচি মোতাবেক ঝাল মশলাযুক্ত করে মুরগিটিকে রোস্ট বা ফ্রাই করে ফেলুন এবং গোল গোল চোখে সেই ফ্রাই অথবা রোস্টেড মুগরির দিকে তাকিয়ে থাকুন।
আপনার তেল মর্দনের বস্তুটিকে উপরোক্ত উপায়ে খাদ্যপণ্য ভাবার সঙ্গে সঙ্গে আপনার জিভে লালা চলে আসবে। লোভে আপনার মুখের ভিতর টস টস শব্দ শুরু হয়ে যাবে। আপনার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠবে এবং আপনাকে অনেক উৎফুল্ল দেখাবে। তেল মর্দন করার জন্য আপনি যাকে উপলক্ষে করেছেন সে আপনার সার্বিক অবস্থা দেখে মনে করবে আপনি তার একান্ত আপনজন এবং শুভার্থী। সে আপনার দিকে এমনভাবে এগিয়ে আসবে যাতে করে আপনি নিরাপদে এবং ইচ্ছেমতো তেল মারার সুযোগ পেয়ে যাবেন। তৃতীয় পর্বে এসে আপনি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে তেল মর্দনের জন্য স্থান, কাল, পাত্র ইত্যাদি বিবেচনা করবেন। আপনার তেল মর্দনের বস্তুটি যদি বাচাল হন তবে আপনার নীরবতা এবং গুরুগম্ভীরতাই উত্তম তেল বলে বিবেচিত হবে। লোকটি যদি অস্থির প্রকৃতির হয় তবে আপনি স্থির থাকুন আপনি চলতে ফিরতে কথায় কর্মে এমন বিনয়ী ভাব দেখান যাতে আপনাকে দেখলে ভ্যাদা মাছ বা বাইল্যা মাছ বলে মনে হয়। নিজের জ্ঞান গরিমা বুদ্ধিশুদ্ধি সব বালিশের মধ্যে ঢুকিয়ে শূন্য মস্তিষ্ক নিয়ে তার সামনে দাঁড়ান। তারপর নিজের পরিবারের কিংবা আত্মীয়স্বজনের দৈনন্দিন ছোটখাটো সমস্যার কথা বলে তার কাছ থেকে উপদেশ প্রার্থনা করুন।
আপনার সমস্যার কথা শুনে তিনি একদফা আপনাকে ভৎর্সনা করবেন। এ সময় আপনি মাথা নিচু করে থাকুন। সম্ভব হলে অনুশোচনার ভান করুন এবং বারবার চোখ কচ্চলাতে থাকুন। তিনি যখন উপদেশ প্রদান শুরু করবেন তখন সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চোখে-মুখে আবেগ, উৎফুল্লতা, বিনয় এবং কৃতজ্ঞতা ফুটিয়ে তুলুন। অত্যন্ত লাজুক দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকান এবং নিজের দুর্বলতা ও অক্ষমতার জন্য মৃদুস্বরে নিজেকে ধিক্কার দিন। এত চমৎকার উপদেশ কি কোনো মানুষের পক্ষে দেওয়া সম্ভব এমনটি ভেবে নিজের চোখ দুটিকে বারবার গোল গোল করে ফুটিয়ে তুলুন। এরপর উপদেশগুলো নিয়ে চলে যান এবং সময়মতো ফিরে এসে উপদেশের জাদুকরী ফলাফল তেলঝোল মেখে পুনরায় বর্ণনা করুন। দেখবেন তেল রাজ্যে আপনি চতুর্থ পর্বে উন্নীত হয়ে গেছেন। এবার আপনি তেল মর্দনের বস্তুটিকে নিজের মালিক ভাগ্যবিধাতা পীর অথবা মোরশেদ বানিয়ে নিন। কথায় কথায় কদমবুচি করুন। তার সামনে অকারণে দাঁড়িয়ে থাকুন। তার সব কথায় সায় দিন। সে রাগ হলে আপনি তাতে ইন্ধন জোগান। অর্থাৎ সে যদি কারও সঙ্গে রাগ করে উত্তেজিত হয়ে পড়ে তবে আপনি সাবধানে ফোড়ন কাটুন যেন তার রাগ বেড়ে যায় বহু গুণে। এতে লোকটি ওজন হারিয়ে ফেলবেন এবং আপনাকে অধিকতর তেল মর্দনের সুযোগ করে দেবেন।
পঞ্চম পর্বে আপনি তেল মর্দনকারীকে মালিক হিসেবে সম্বোধন করবেন এবং নিজেকে চাকর অথবা খাদেম বলে পরিচিত করে তুলবেন। আপনার মালিকের আশপাশের লোকজন আপনাকে তেলবাজ, চামচা, মদনা, রামছাগল, নেড়িকুত্তা, বিলাই, মিউমিউ ঘেউ ঘেউ ইত্যাদি নামে আড়ালে-আবডালে যতই ভৎর্সনা করবে ধরে নেবেন আপনি ততই সফল তেলবাজে পরিণত হয়েছেন। এবার আপনি আপনার মালিককে চমৎকার কিছু উপহার প্রদান করুন। উপহারগুলো যদি খাদ্য, পানীয় অথবা নিত্যব্যবহার্য বস্ত্র হয় তবে সব দিক থেকে তা উত্তম বলে বিবেচিত হবে। মালিকের স্নেহ-ভালোবাসা এবং ঘৃণার গোপন ও দুর্বলতম জায়গাগুলো খুঁজে বের করুন। তিনি যখন উৎফুল্ল থাকবেন তখন স্নেহ-ভালোবাসার বিষয়গুলো তার সামনে মেলে দরুন এবং ক্রোধের সময় ঘৃণার বিষয়গুলো নিয়ে আসুন। এতে করে আপনার মালিক কখনো খুশিতে আটখানা হয়ে ওজন হারিয়ে তিড়িং বিড়িং করে লাফালাফি শুরু করবেন। অন্যদিকে, ক্রোধের সময় উত্তেজিত হয়ে কা-জ্ঞান হারিয়ে ফেলবেন। মনে রাখবেন অতিরিক্ত খুশি কিংবা অতিরিক্ত ক্রোধের সময়কালটিই হলো আপনার জন্য তেল মর্দনের অতি উত্তম মওকা। পঞ্চম পর্ব সাফল্যজনকভাবে অতিক্রম করলেই আপনি তেল মর্দনের মধু দেওয়ার সন্ধান পেতে আরম্ভ করবেন যা আপনাকে ষষ্ঠ ধাপে পৌঁছে দেবে। এই পর্যায়ে মালিক আপনাকে স্বেচ্ছায় অনেক গোপন কথা বলবেন। নিজের গোপন অভাব, অভিযোগ এবং চাহিদা তিনি অকপটে আপনার কাছে প্রকাশ করে দেবেন। আপনি সহানুভূতি জানাতে থাকুন এবং মালিকের সব গোপন কর্মে সমর্থন দিতে থাকুন। এরপর তার গোপন কর্মে সহযোগী হয়ে যান। তার প্রয়োজনসমূহ সাপ্লাই দিন। কিন্তু সাবধান— মালিকের কোনো কিছুতেই ভাগ বসানোর চেষ্টা করবেন না। এমনকি তার ব্যবহার্য উচ্ছিষ্টসমূহকে সম্মান এবং সমীহ করুন। মালিকের সঙ্গে কূটনামী, চোগলখুরী এবং বিশ্বাসঘাতকতার কথা চিন্তাও করবেন না। তার গোপন বিষয়, দুর্বলতা ইত্যাদি আপনার একান্ত নিকটজনের কাছেও প্রকাশ করবেন না। এমনকি একান্ত বসে ওসব নিয়ে ভাববেনও না। মনে রাখবেন, মালিক যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার আনুগত্য জবান, চোখের চাহনি এবং শ্রবণ শক্তিকে তার পোষা প্রিয় কুত্তা-বিলাইয়ের মতো নিরাপদ মনে না করবেন ঠিক ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি আপনার কাছে আত্মসমর্পণ করবেন না।
তেলবাজির সর্বোচ্চ মাকাম বা স্তরকে বলা হয় সপ্তম পর্ব। এটি একটি সৌভাগ্যময় সংখ্যা। আসমান ও জমিনের রয়েছে সাতটি স্তর। আবার দোজখের সংখ্যাও কিন্তু সাত। আপনার মালিক যেদিন আপনার কাছে আত্মসমর্পণ করবেন সেদিন আপনি তেলবাজির সম্রাটে পরিণত হয়ে যাবেন। আপনার মালিক কেবল প্রকাশ্যে আপনার ওপর আধিপত্যের অভিনয় করবেন— কিন্তু একান্তে আপনিই হবেন মালিক এবং তিনি হবেন আপনার পোষা প্রাণী— ঠিক যেমনি ঘটেছিল ভারতবর্ষের অন্যতম প্রধান শক্তিশালী সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজি এবং তার সেনাপতি মালিক কাফুরের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ, প্রতিদিন
লেখক : কলামিস্ট।


শেয়ার করুন