ডাকসুর পুননির্বাচনের আন্দোলনেও থাকছেন নূর


ছাত্রলীগ সভাপতির সঙ্গে আলোচনায় নরম সুর দেখানোর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বাম জোটসহ অন্যদের সঙ্গে বৈঠক করে ডাকসুতে পুনর্নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের কর্মসূচিতে একাত্ম হলেন নবনির্বাচিত ভিপি নূরুল হক নূর।

নিজের সহকর্মীদের চোখে ‘বিতর্কিত’ এই নির্বাচনে জয়ী নূর ভিপি পদে শপথ নেওয়ার ইচ্ছার কথা সাংবাদিকদের জানিয়ে বলেছেন, “সাধারণ শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে ডাকসুর ভিপি হিসাবে আমিও থাকব।”

ভোটের পর মঙ্গলবার ঘটনাবহুল দিনের শেষভাগে টিএসসিতে বাম জোটের সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি বলেন, “সোমবার নির্বাচন চলার সময়ই ছাত্রলীগ ছাড়া আমরা সব প্যানেল নির্বাচন বর্জন করেছিলাম।

“আজও সেই দাবি জানাচ্ছি নির্বাচন বাতিল করে পুনঃতফসিল ঘোষণা করতে হবে। ৩১ মার্চের মধ্যে নতুন নির্বাচন দিতে হবে।”

এই দাবিতে বুধবার উপাচার্যকে স্মারকলিপি দেওয়া হবে বলে সাংবাদিকদের জানান বাম জোটের ভিপি প্রার্থী ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি লিটন নন্দী।

তিনি বলেন, “আগামীকাল দুপুর ১২টায় আমরা সবাই রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হব। সেখান থেকে মিছিল নিয়ে উপাচর্যের কার্যালয়ে গিয়ে নির্বাচন বাতিলের দাবিতে স্মারকলিপি দেব।”

এরপর তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে জানান লিটন।

“১১ মার্চের নির্বাচন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। এ নির্বাচনকে আমরা পাঁচটি প্যানেল ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি। আংশিক নয়, পুরো নির্বাচন বাতিল করে পুনরায় তফসিল করার দাবি আমরা পুনর্ব্যক্ত করছি। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট যারা ছিল, তাদের সবাইকে পদত্যাগ করতে হবে।”

সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ এবং প্রগতিশীল ছাত্র জোট ও সাম্রাজ্যবিরোধী ছাত্র ঐক্যের সঙ্গে এই কর্মসূচিতে ডাকসু নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী স্বতন্ত্র জোট, স্বাধিকার স্বতন্ত্র পরিষদ, ছাত্র ফেডারেশনও রয়েছে।

২৯ বছর পর সোমবার অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার আগেই কারচুপির অভিযোগ তুলে নতুন করে ভোটগ্রহণের দাবি তুলেছিল এই সংগঠনগুলো। মঙ্গলবার ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে বিক্ষোভের ডাকও দেয় তারা।

এরপর গভীর রাতে ফল ঘোষণার পর দেখা যায়, ডাকসুতে ২৫টি পদের ২৩টিতে সরকার সমর্থক ছাত্রলীগ জিতলেও ভিপিসহ দুটি পদে জয় পেয়েছে কোটা সংস্কার দাবির আন্দোলনকারীদের প্যানেল। রোকেয়া হল ছাড়া অন্য ছাত্রী হলগুলোতেও জেতে তারা।

ভোট চলাকালে সোমবার দুপুরে রোকেয়া হলে গিয়ে নূর ছাত্রলীগের হামলার শিকার হন বলে তার অনুসারীদের অভিযোগ। সেখান থেকে তাকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

রাতে হাসপাতালে ভিপি নির্বাচিত হওয়ার খবর পেয়ে মঙ্গলবার সকালে সাধারণ শিক্ষার্থী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আনন্দ মিছিলে যোগ দিতে ক্যাম্পাসে আসেন নূর।

মঙ্গলবার দুপুর ১টা ১৫ মিনিটে ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আনন্দ মিছিলে নেতৃত্ব দেন ডাকসুর নবনির্বাচিত ভিপি নুরুল হক নূর। ছবি: মাহমুদ জামান অভি
মঙ্গলবার দুপুর ১টা ১৫ মিনিটে ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আনন্দ মিছিলে নেতৃত্ব দেন ডাকসুর নবনির্বাচিত ভিপি নুরুল হক নূর। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

সেই মিছিল শেষে টিএসসিতে মারধরের শিকার হন নবনির্বাচিত ভিপি নূর, যার জন্য ছাত্রলীগকেই দায়ী করেন তিনি।

দুপুরে ওই হামলার পর ক্যাম্পাসে মিছিলের পর নূর সাংবাদিকদের বলেন, “ভিপি ও সমাজসেবা সম্পাদক পদ ছাড়া বাকি সবগুলোতে আমি দ্রুত পুনর্নির্বাচন দাবি করছি। ভিপি হিসেবে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আমি সবাইকে নিয়ে আন্দোলন করব।”

নির্বাচন বাতিল করে পুনঃতফসিল না দিলে ছাত্র ধর্মঘট অনির্দিষ্টকালের জন্য চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণাও দেন তিনি।

‘কারচুপি’র মধ্যেও নিজের জয়ের প্রসঙ্গে নূর বলেন, “গোটা নির্বাচনে প্রশাসন ছাত্রলীগের সহকর্মী হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু ভিপি পদে ভোটের ব্যবধান এত বেশি ছিল যে, অনেক হারানোর চেষ্টা করেও তারা আমাকে হারাতে পারেনি।”

টিএসসিতে হামলার জন্য ছাত্রলীগকে দায়ী করে নূর বলেন, “এই হামলা ছাত্রলীগই করেছে। সন্ত্রাসী হামলাকারীদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি। একইসঙ্গে তাদের ক্যাম্পাস থেকে চিরতরে বের করে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।”

টিএসসিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার অপেক্ষায় ছিলেন নূরুল হক নুর। দুপুর ১টা ৪৫ মিনিট তার উপর হামলা হয়। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

হামলার পর উত্তেজনার মধ্যে বিকালে টিএসসি মিলনায়তনে ছাত্রলীগ সভাপতি ও ভিপি পদে পরাজিত প্রার্থী রেজওয়ানুল হক শোভনের সঙ্গে করমর্দন ও কোলাকুলি হয় নূরের। তার আগ পর্যন্ত নূরকে ‘শিবির’ চিহ্নিত করে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের দাবিতে মিছিলও করছিল ছাত্রলীগ।

ভোট বর্জন করা প্যানেলগুলোর নেতাদের সঙ্গে নূর যখন টিএসসিতে ছিলেন, তখন সেখানে শুভেচ্ছা জানাতে উপস্থিত হন ছাত্রলীগ সভাপতি শোভন।

শোভন সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিলে নূর সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা চাই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ছাত্র সংগঠন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে। ছাত্র-শিক্ষকদের সমন্বয়ে আমরা একটি উন্নতমানের শিক্ষাবান্ধব ক্যাম্পাস গড়ে তুলব।”

অনির্দিষ্টকালের ক্লাস বর্জন কর্মসূচি থেকে সরে আসার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, তবে যে নির্বাচন হয়েছে, তাতে শিক্ষার্থীদের ‘আশা পূরণ’ না হওয়ায় প্রশাসনকে পুরো বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানাচ্ছেন তিনি।

দুপুরে টিএসসিতে ছাত্রলীগের হামলার বিষয়ে নূর বলেন, “আমি শোভন ভাইকে বলেছি। তিনি কী ব্যবস্থা নেন, সেটার জন্য অপেক্ষা করছি।”

ছাত্রলীগ সভাপতির সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর ভোট বর্জনকারী প্যানেলের নেতাদের সঙ্গে ফের বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সামনে আসেন ইংরেজির শিক্ষার্থী নূর; বলেন, ডাকসু নির্বাচনের ফল বাতিলের দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনে তিনিও থাকছেন।

তিনি বলেন, “শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হিসেবে আমি বলতে চাই, যেহেতু আরও অনেক প্যানেল নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, আমরা তাদের দাবির সঙ্গে একমত। এ নির্বাচন পুনরায় হতে হবে এবং নির্বাচনে যারা দায়িত্ব পালন করেছে তাদের পদত্যাগ করতে হবে; অন্যদের অধীনে আমরা নির্বাচনে অংশ নেব।

“হাই কোর্টের আগের নির্দেশনা অনুসারে ৩১ মার্চের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন হওয়ার কথা। সেই সময়ের মধ্যেই নির্বাচন হোক।”

নির্বাচনে অনিয়মের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “আমি নিজেও প্রত্যক্ষ করেছি, কুয়েত-মৈত্রী হলে ব্যালটে সিল মেরে রাখা হয়েছে এবং রোকেয়া হল ও সুফিয়া কামাল হলে অনিয়মগুলো ঘটেছে।

“ছেলেদের হলগুলোতে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রদের জোর করে লাইনে দাঁড় করানো হয়েছে। ভোট দেওয়ার পরেও অনেকে লাইনে ছিল, যাতে অন্য ছেলেদের লাইনে পেছনে দাঁড়িয়েই থাকতে হয়। এ কারণে ভোটারদের অনেকে বিরক্ত হয়ে চলে যায়।”

সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, “নির্বাচনে অনিয়ম হয়েছে, সব পদ নেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু সাধারণ ছাত্ররা একচেটিয়া ভোট দিয়েছে ভিপি ও সমাজসেবা পদে; যে কারণে তারা ইঞ্জিনিয়ারিং করেও ওই দুই পদ নিতে পারেনি।”

ধর্মঘট প্রসঙ্গে নুর বলেন, ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব করছি। তাদের সুবিধার্থে কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছি। তবে সাধারণ শিক্ষার্থী ও সংগঠন যদি ফের কোনো কর্মসূচি দেয়, তাহলে সমর্থন দেব।”

রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষকে লাঞ্ছিতের অভিযোগে মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, “মিথ্যা অভিযোগে মামলা দেওয়া হয়েছে। আমরা খুব অবাক হয়েছি। রোকেয়া হলে প্রাধ্যক্ষের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হয়েছে, কোনো লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটেনি।”

ভিপি পদে পুনর্নির্বাচনের দাবিতে মঙ্গলবার সকালে বিক্ষোভে নূরুল হক নূরকে ‘শিবির’ আখ্যা দিয়ে স্লোগান তুলেছিলেন ছাত্রলীগের অনেকে
ভিপি পদে পুনর্নির্বাচনের দাবিতে মঙ্গলবার সকালে বিক্ষোভে নূরুল হক নূরকে ‘শিবির’ আখ্যা দিয়ে স্লোগান তুলেছিলেন ছাত্রলীগের অনেকে

ছাত্রলীগের সভাপতি শোভনের সঙ্গে কোলাকুলির প্রসঙ্গে নূর বলেন, “তাদের (ছাত্রলীগের) মুখে মধু, অন্তরে বিষ। তাদের বিশ্বাস করাটা খুব টাফ।”

ছাত্রলীগের হাতে আগেও হামলার শিকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “বেগম রোকেয়া হলে ছাত্রলীগ আমাদের মেরেছে। গত ৩০ জুনও তারা আমাকে মেরেছিল। আজকেও শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হিসেবে আমি টিএসসিতে এসেছি, কিন্তু আমাকে তারা ধাওয়া দিয়েছে।

“ক্ষমতাসীনরা যখন সুবিধাজনক মনে করে, যখন আমাদের লাগে, তখন বুকে টেনে নেয়। আবার যখন মনে করে আমরা শত্রু, তখন মার দেয়।”

অনশনে ৪ শিক্ষার্থী

১১ মার্চের ভোট বাতিল করে ডাকসুর পুননির্বাচনের দাবিতে অনশনে বসেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষার্থী।

ডাকসু নির্বাচনের ফল বাতিল করে পুনঃতফসিল ঘোষণার দাবিতে মঙ্গলবার রাতে রাজু ভাস্কর্যের সামনে আমরণ অনশনে বসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষার্থী।
ডাকসু নির্বাচনের ফল বাতিল করে পুনঃতফসিল ঘোষণার দাবিতে মঙ্গলবার রাতে রাজু ভাস্কর্যের সামনে আমরণ অনশনে বসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষার্থী।

মঙ্গলবার রাত ৮টায় রাজু ভাস্কর্যে এই কর্মসূচি শুরু করেন দর্শন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র অনিন্দ্য মন্ডল, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র শোয়েব মাহমুদ, পপুলেশন সায়েন্সের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মাঈন উদ্দীন এবং কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র তাওহীদ তানজিম।

এদের মধ্যে অনিন্দ্য জগন্নাথ হল সংসদে প্রগতিশীল ছাত্র ঐক্যের প্যানেল থেকে সদস্য প্রার্থী ছিলেন; শোয়েবও একই প্যানেল থেকে শহীদুল্লাহ হল সংসদে সাহিত্য সম্পাদক প্রার্থী ছিলেন; তাওহীদ স্বতন্ত্র জোটের প্যানেল থেকে ডাকসুর পরিবহন সম্পাদক প্রার্থী ছিলেন।

এই চার বন্ধু দাবি আদায়ে আমরণ অনশন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তারা পুনর্নির্বাচনের দাবি জানানোর পাশাপাশি ১১ মার্চের ভোটে দায়িত্ব পালনকারী সবাইকে সরিয়ে দেওয়ার দাবিও তুলেছেন।


শেয়ার করুন