ফরিদুল মোস্তফা খান :
থানায় দায়িত্বরত ওসির আস্কারায় একজন ক্যাশিয়ারের বেপরোয়া চাঁদাবাজির কারণে বন্ধ হচ্ছে না সীমান্ত জনপদ টেকনাফের আদম ও ভয়ংকর মাদক ইয়াবা ব্যবসা।
শুধু তাই নয়, কনষ্টেবল মামুন নামের ওই ক্যাশিয়ার ও একই থানায় কর্মরত আরো কয়েক অসৎ পুলিশ সদস্যের কারণে দেশের সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত সীমান্ত ঘেঁষা উক্ত জনপদের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নজিরবিহীন ভেঙ্গে পড়েছে। চোরাচালান প্রতিরোধে সরকার টেকনাফে একটি স্থলবন্দর প্রতিষ্ঠা করলেও ক্যাশিয়ার মামুনকে নগদ মাসোহারা দিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা দিন দিন জমজমাট চোরাচালানে মেতে উঠেছে। ফলে সরকার একদিকে বন্দরের রাজস্ব আদায়ে যেমন ব্যর্থ হচ্ছে, অপরদিকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পবিত্র পোশাক পরে এসব দুর্নীতিবাজরা অল্পদিনেই বিশাল বিত্ত বৈভবের মালিক বনে যাচ্ছেন। বিষয়টির সত্যতা মেলাতে টেকনাফে কর্মরত বর্তমান ওসি মোঃ আতাউর রহমান, ক্যাশিয়ার মামুন ও এই থানায় কর্মরত বিতর্কিতদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি অত:পর স্বনামে বেনামে তাদের খোলা ব্যাংক একাউন্ট এবং স্থাবর-অস্থাবর সহায় সম্পত্তির খোঁজ নিলে সত্যতা মিলবে বলে মনে করেছেন সচেতন মহল।
তারা অবশ্যই এ ব্যাপারে জরুরী ভিত্তিতে তদন্তপূর্বক কার্যকর ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সকল গোয়েন্দা সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট উচ্চ পর্যায়ের তড়িৎ হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
ওয়াকিবহাল সূত্র জানায়, প্রায় ৮/৯ মাস আগে জেলা পুলিশের জন্য সবচেয়ে রসালো টেকনাফ থানায় যোগদানকৃত ওসি মোঃ আতাউর রহমান ও তার আশির্বাদপুষ্ট কনষ্টেবল মামুনের বর্তমান অনৈতিক উপার্জন মাসে প্রায় ৫০ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
জানা গেছে, ম্যাচ পরিচালনার অজুহাতে দাপ্তরিক নিয়মবহির্ভূত উক্ত ক্যাশিয়ার মামুনকে দিয়ে ওসি থানা এলাকার বিভিন্ন অপরাধীদের কাছ থেকে ব্যাপক চাঁদাবাজী করানোর পাশাপাশি বিভিন্ন সময় জব্দকৃত ভয়ংকর মাদক ইয়াবা ট্যাবলেটগুলো বিক্রি করান। একই সাথে ক্যাশিয়ার মামুন থানা এলাকার চিহ্নিত নয়টি নৌ-পথে মালেশিয়াগামী মানবপাচারকারী অঘোষিত ঘাট থেকে জনপ্রতি ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
কনষ্টেবল পদে কর্মরত উক্ত মামুন ওসির আশির্বাদে একদিনও ইউনিফর্ম না পরে সিভিলে মোটর সাইকেল যোগে রাত-দিন ২৪ ঘন্টা উপজেলার চিহ্নিত মানবপাচারের ঘাট ও ইয়াবা হাট খ্যাত কোলারপাড়া, শাহপরীরদ্বীপ, জাইল্যা পাড়া, সাবরাং নয়াপাড়া, হ্নীলা চৌধুরী পাড়া, ওয়াব্রাং, পুরান পল্লান পাড়া, নাজিরপাড়া, কেরুনতলী, হেচ্ছার খাল, ট্রানজিট ঘাটসহ থানা এলাকার বিভিন্ন মানবপাচার ও তালিকাভূক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ীদের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নাম ভাঙ্গিয়ে মাসিক, সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক মাসোহারা আদায়ে ব্যস্ত থাকেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমে তিনি থানার ম্যাচ ও ওসির বাসার বাজার করেই উপজেলার চিহ্নিত অপকর্মের হাটগুলোতেই চাঁদাবাজিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সকাল পেরিয়ে দুপুর, সন্ধা ক্ষেত্র বিশেষ গভীর রাত অবধি সীমান্তের চোরাকারবারী, মানবপাচারকারী, ইয়াবা ব্যবসায়ী, জুয়াড়ী, পতিতাসহ যেখানে যেখানে তার সাথে মাসোহারার চুক্তি আছে, তিনি তীর্থের কাকের মত সেখানেই লেগে থাকেন। নিজ বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তার নাম ভাঙ্গিয়ে চাঁদা আদায়ে নাছোঁড়বান্দা উক্ত ক্যাশিয়ার মামুনকে কেউ যদি চাঁদা না দেন, তার উপর নেমে আসে আকাশের যত তারা পুলিশের তত ধারা।
অভিযোগ উঠেছে, চাঁদা আদায়ে ব্যর্থ হয়ে উক্ত ক্যাশিয়ার যদি তার নিয়োগদাতা ওসি আতাউর রহমানকে কারো বিরুদ্ধে নালিশ দেন সাথে সাথে শুরু হয় পুলিশী অভিযান। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, গত কয়েক মাসের ব্যবধানে ওসির নির্দেশে থানা এলাকায় বিভিন্ন স্থানে পুলিশ অভিযান চালিয়ে লেদার ক্রসফায়ারে নিহত বহুল আলোচিত তালিকাভূক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী নুর মোহাম্মদের ভাই মামুনকে আটক করে রাতের অন্ধকারে ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়ে নগদ ২২ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে পরবর্তীতে আদালতে চালান দেয়। গত মাসে অপর তালিকাভূক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী নাইট্যংপাড়ার সোনামিয়ার পুত্র বহুল আলোচিত শাহআলমকে ধরে এনে মোটা অংকের উৎকোচের বিনিময়ে থানা থেকেই ছেড়ে দেন। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে নাজির পাড়ার আরেক ইয়াবা ব্যবসায়ী ভুট্টোকে আটক করে জটিল মামলায় চালানের হুমকি দিয়ে নগদ ৫ লাখ টাকা উৎকোচ নিয়ে পরের দিন ৫৪ ধারায় আদালতে চালান দেন। একই দিন বিকেলে ভুট্টো জামিন নিয়ে বীর দর্পে টেকনাফে ফিরে আসেন। এছাড়া বাসস্টেশনের মুদির দোকানদার হামিদ হোসেনকে ধরে এনে তার সৌদি প্রবাসী ভ্রাতাগণ এবং হামিদ হুন্ডি ব্যবসা করে বলে হুমকি দিয়ে পুলিশ মোটা অংকের উৎকোচ হাতিয়ে নেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সূত্র মতে আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ওসি আতাউর রহমানের ছত্রছায়ায় ক্যাশিয়ারের দায়িত্বরত মামুনের বিরুদ্ধে প্রাপ্ত চাঁদাবাজির অভিযোগের মধ্যে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর বিষয় হচ্ছে তার কাছে বিকাশের একাউন্ট সম্বলিত অগণিত মোবাইল সিম রয়েছে। উক্ত সিমগুলো দিয়ে তিনি হরদম সীমান্তের উপারে অবস্থানরত বাঘা বাঘা ইয়াবা সম্রাট ও আদমপাচারকারীদের উৎকোচ আনেন।
সভ্যতার ইতিহাসে টেকনাফ থানা পুলিশে চলমান এমন বর্বরতার বিষয়টি টেকনাফের সচেতন মহলে মুখে মুখে হলেও সংশ্লিষ্ট মহলের নীরবতায় ভূক্তভোগীরা হতাশাব্যক্ত করে বলেছেন, এই ওসির আমলে মাত্র কয়েকমাসের ব্যবধানে হোয়াইক্যং পুলিশ ফাঁড়িতে কর্মরত দুইজন এসআই উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে হাতে নাতে ইয়াবাসহ ধরা পড়ে তাৎক্ষণিক প্রত্যাহার হন। অথচ এসব ইয়াবা ব্যবসায়ী পুলিশ সদস্যদের ইনচার্জ হিসেবে তিনি এর দ্বায় কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। ভুক্তভোগীরা বলছেন ওসির অনৈতিক উপার্জিত এসব টাকার ভাগ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মুখোশ পরা দায়িত্বশীলদের কাছে সময়মত পৌছে যায়া বলে তিনি এখওন বহাল তবিয়তে রয়েছেন।
কক্সবাজার ও টেকনাফে কর্মরত কয়েকজন দায়িত্ব গোয়েন্দা কর্মকর্তা এ প্রতিবেদনককে জানান, টেকনাফ পুলিশে ঘুঁষের হাটের বিষয়টি যেখানে জানানো দরকার সেখানে জানানো হয়েছে।
এদিকে উল্লেখিত সব অভিযোগের ব্যাপারে টেকনাফের ওসি আতাউর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি এসব ব্যাপারে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
অভিযুক্ত ক্যাশিয়ার মামুন ও নিজের কু-র্কীতির কথা অস্বীকার করে বলেন, ক্যাশিয়ারী কতে আমি মোটেও রাজি নই। ওসি সাহেবের অনুরোধে ছাড়তে পারছি না। চাঁদাবাজি করি না, শুধু ম্যাচ চালায়।
নবাগত অতিরিক্ত পুলিশ পুলিশ জানান, আমিতো একেবারেই নতুন আসছি। থানার কোনো ক্যাশিয়ার কথার কথা না। তারপরও যদি থেকে থাকে অবশ্যই আমি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেব।
সন্ধ্যায় বাড়ে থানায় ভিড় কমে রাতে!
দীর্ঘদিন ধরে টেকনাফ থানায় চলমান ঘুষ, দুর্নীতি ও মানুষ হয়রানির বিষয়টি অগণিত ভূক্তভোগীর কাছ থেকে শোনার পর বিষয়টি সরেজমিনে অনুসন্ধানে সম্প্রতি একরাতে প্রতিবেদক টেকনাফ থানা পরিদর্শনে গেলে দেখা যায়, এ যেন জন উপকারের থানা নয়। পুরো দৃশ্যটি যেন মাছের বাজারের মত। দালাল ও তদবিরবাজদের পাশাপাশি এলাকার দাগী ও চিহ্নিত চোরাচালানী, মানবপাচারকারী ও ইয়াবা ব্যবসায়ীরা থানায় গিজ গিজ করছে। খাকী পোশাক পরা কেউ কেউ মানুষ ধরে আনছে, আর হাজতে ঢুকাচ্ছে। দালালরা একবার ওসির রুম, একবার ক্যাশিয়ার মামুন, আরেকবার দায়িত্বশীল পুলিশ অফিসাদের কাছে ধর্না দিচ্ছে। দরদাম ঠিক হলে যার ভাগ্য ভাল তার মুক্তি মিলছে। আবার কেউ কেউ মামলা রেকর্ড করাতে ওসি ও মুন্সির সাথে দরদাম ঠিক করতেছে। ডিউটি অফিসারকে নগদ কিছু না দিলে একটি সাধারণ ডায়েরীও লিপিবদ্ধ হচ্ছে না।