টাকা নিয়েও পুরান ঢাকার বাসাবাড়ির বর্জ্য ফেলছে বুড়িগঙ্গায়

রাতের আঁধারে বা সুবিধাজনক সময়ে বর্জ্য নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছেন শ্রমিকরা * প্রতিদিন নদীতে চলাচলকারী শতাধিক লঞ্চের বর্জ্যও সরাসরি নদীতে ফেলছে * শ্যামবাজার বাদামতলীর আড়ত ও চরকালীগঞ্জের ডকইয়ার্ডের রাসায়নিক বর্জ্য ফেলা হচ্ছে
ডেস্ক নিউজঃ

পুরান ঢাকার বাসাবাড়ির বর্জ্য রাতের আঁধারে বুড়িগঙ্গায় ফেলা হচ্ছে। গৃহস্থালির বর্জ্য প্রতিদিন ডাম্পিং স্টেশনে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে প্রতিটি বাসাবাড়ি ও ফ্ল্যাট থেকে ১০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হচ্ছে। অথচ সেসব বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় ফেলা হচ্ছে। নাগরিকদের অভিযোগ, টাকা দিয়েও তারা কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছেন না।

সরেজমিন দেখা যায়, রাজধানীর লালবাগ বেড়িবাঁধ, কামরাঙ্গীরচর, শ্যামবাজার, সদরঘাট, কেরানীগঞ্জের আগানগর, তৈলঘাট ও পার গেণ্ডারিয়া এলাকা ও আশপাশের এলাকার বাসাবাড়ি থেকে সংগৃহীত বর্জ্য প্রথমে ভ্যানে করে নদীপাড়ে স্তূপ করা হয়। এরপর রাতের আঁধারে অথবা দিনের সুবিধাজনক সময়ে সেসব বর্জ্য শ্রমিকরা নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছেন। এছাড়া প্রতিদিন নদীতে চলাচলকারী শতাধিক লঞ্চের বর্জ্যও সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। শ্যামবাজার ও বাদামতলীর আড়তের বর্জ্য ও চরকালীগঞ্জের ডকইয়ার্ডগুলোর বিভিন্ন রাসায়নিক বর্জ্য নদীতে ফেলা হচ্ছে।

এলাকার একাধিক ব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধিরা জানান, নদীপাড়ে স্তূপ করা বর্জ্যরে উৎকট দুর্গন্ধে বাসিন্দা ও চলাচলকারী মানুষজন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। ময়লা ফেলার সঙ্গে জড়িতরা রাজনৈতিক দলের মদদপুষ্ট। এ কারণে কেউ প্রতিবাদ পর্যন্ত করতে পারছেন না। পরিবেশবাদীরা জানান, এছাড়া ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ও ঢাকা ওয়াসা ২৫০ ড্রেনের মাধ্যমে অন্তত ৫০ হাজার টন বর্জ্য প্রতিদিন বুড়িগঙ্গায় ফেলা হচ্ছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, কামরাঙ্গীরচরের (৫৬ নম্বর ওয়ার্ড) ফ্যান কারখানার সামনে নদীর পাড়ে প্রতিদিন প্রথমে বর্জ্য জড়ো করা হয়। এরপর সুবিধাজনক সময়ে সেসব নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া ময়লার উৎকট দুর্গন্ধে স্থানীয়দের বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়ছে। এক বাসিন্দা যুগান্তরকে বলেন, কাউন্সিলর হোসেনের ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তি এ ওয়ার্ডে ময়লার ঠিকাদার হিসাবে নিয়োগ পেয়েছে। প্রতিদিন ওয়ার্ডের ময়লা নদীপাড়ে জড়ো করে রাতের আঁধারে নদীতে ফেলা হচ্ছে।

ইসলামবাগ এলাকায় এক ব্যবসায়ী জানান, আগে সপ্তাহে ছয় দিন ময়লা (গৃহস্থালির বর্জ্য) নিলেও এখন চার দিন করে নিচ্ছে। প্রতিটি বাড়ির নিচে ড্রামে ময়লা ফেলার জন্য বলা হয়েছে। উপায় না পেয়ে বাসিন্দারা বাড়িতে ড্রামে ময়লা জমা করতে বাধ্য হচ্ছে। এতে গোটা এলাকা ডাস্টবিনে পরিণত হয়। দু-তিন দিন পুরোনো ময়লার দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছেন বাসিন্দারা। মানববর্জ্যও বুড়িগঙ্গায় ফেলা হচ্ছে। ফলে বর্জ্যরে দুর্গন্ধে বাসিন্দা ও নদী পারাপার হওয়া মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। এছাড়া নদী লাগোয়া কাঁচামালের আড়ত ও নৌযান মেরামতের বর্জ্যও ফেলা হচ্ছে। নদীদূষণ রোধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও উপেক্ষিত হচ্ছে। বুড়িগঙ্গার তীর ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।

স্থানীয় বাসিন্দা কাউসার জানান, ময়লা-বর্জ্য বাণিজ্য করে ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতা রাতারাতি নিজেদের ভাগ্য বদলে নিয়ছেন। তাদের নিয়োজিত লোকজন দিয়ে প্রতিটি বাড়ি ও ফ্ল্যাট থেকে প্রতি মাসে ১০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করছেন। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা হওয়ায় ভয়ে সাধারণ মানুষ কেউ তাদের প্রতিবাদ করেন না।

আগানগর বটতলা ঘাটে বর্জ্য ফেলা প্রসঙ্গে একাধিক মাঝি বলেন, ময়লার ইজারাদাররা অনেক ক্ষমতাশালী। আগানগর ইউনিয়নের সব বাসাবাড়ির ময়লা রাতের আঁধারে বুড়িগঙ্গায় ফেলা হলেও কেউ কোনো টুঁ শব্দটি করেন না। এ ইউনিয়নের চেয়ারম্যানও কথা বলতে পারছেন না বলে জানান তারা।

জানা গেছে, ২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করেন উচ্চ আদালত। ফলে তখন থেকে নদী দখল, ভরাট,

নদীদূষণ ফৌজদারি অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে বলে আদালত ঘোষণা দেন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেও ১৭ দফা নির্দেশনা দেন আদালত। ওই নির্দেশনা অনুযায়ী সরকার নদী দখল ও দূষণকারীদের তালিকা করে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশও করে। এছাড়া তাদের নির্বাচনে অযোগ্য ও ব্যাংক ঋণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়, দায়ীদের অর্থে নদী দখল ও দূষণমুক্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। যদিও নির্দেশনাগুলো এখন পর্যন্ত বাস্তবে প্রয়োগ হতে দেখা যায়নি।

ডিএসসিসির ৩৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুর রহমান মিয়াজী বলেন, জনগণ সচেতন না হলে নদীতে বর্জ্য ফেলা বন্ধ করা সম্ভব নয়। সিটি করপোরেশন থেকে প্রতিটি ওয়ার্ডে ময়লা ফেলার জন্য ঠিকাদার নিযুক্ত করা হয়েছে। টাকার বিনিময়ে তারা বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করলে নির্দিষ্ট স্থানে বর্জ্য পৌঁছে না দিয়ে তারা নদীতে ফেলছে। কাউন্সিলর রহমান আরও বলেন, আমরা অনেকবার বিআইডব্লিউটিএ ও লঞ্চ মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছি এবং নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা ফেলতে অনুরোধ করেছি। কিন্তু তারা কথা আমলেই নেয় না। নিয়মিত নদীতে বর্জ্য ফেলছে।

ডিএসসিসির ৫৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূরে আলম বলেন, কামরাঙ্গীচরে কোনো সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন না থাকায় বাসাবাড়ির ময়লা নদীর পাড়ে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় রাখা হয়। সেখান থেকে গাড়ি করে বর্জ্য ডাম্পিং স্টেশনে পৌঁছে দেওয়া হয়। তবে ঠিকাদারের অতিরিক্ত টাকা আদায়ের কথা তিনি অস্বীকার করেন।

ডিএসসিসির ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেনের সঙ্গে একাধিকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। পরবর্তী সময় খুদে বার্তা পাঠালেও তাতে তিনি সাড়া দেননি।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান এএসএম আলী কবীর বলেন, তাদের লজিস্টিক সাপোর্ট না থাকায় অন্য সংস্থার ওপর নির্ভর করতে হয়। এর পরও দখল ও দূষণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে তিনি জানান।


শেয়ার করুন