জুলুম ও মজলুম সম্পর্কে আল কুরআন

পুরাতন আর নতুন মিলে আট-নয় লাখ আরাকানি মুসলমান শরণার্থী নিজেদের জান বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। গোটা দুনিয়ার মানুষ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও দুর্বৃত্ত মগেরা একজোট হয়ে রোহিঙ্গা মুসলমানদের গুলি করে মারছে, গলা কেটে মারছে, হাত-পা কেটে টুকরা টুকরা করছে, জীবন্ত নারী-পুরুষ শিশুদের জ্বলন্ত আগুনে জ্বালিয়ে দিচ্ছে, গ্রামের পর গ্রাম আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিচ্ছে, নারীদের ধর্ষণ করছে, সহায়সম্পদ লুট করে নিচ্ছে। ওরা মুসলমানদের বলছে, তোরা শিগগিরই এ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যা, দেরি করলেই গুলি করব, গলা কাটব।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, যারা মুসলমানদের আরাকান থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে আরাকান কিন্তু তাদের দেশ নয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুসলমানরাই সে দেশে বাস করে আসছে। ১৭৮৪ সালে বর্মি রাজা ভোদাপায়া আরাকান দখল করে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে আর প্রচার করা শুরু করে যে, রোহিঙ্গারা বহিরাগত। এরপর থেকে দফায় দফায় কয়েক লাখ মুসলমানকে আরাকান থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে।
কয়েক দিন আগে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের এক জরুরি বৈঠকে মিয়ানমারের হত্যাযজ্ঞের ঘটনার নিন্দা জানানো হয়েছে এবং উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এর মানে, যখন লাখ লাখ মানুষকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হলো, হাজার হাজার লোককে হত্যা করা হলো, তখন বিশ্বে শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সর্বোচ্চ দায়িত্বে অধিষ্ঠিত পাঁচটি দেশ বহু প্রতীক্ষিত বৈঠকে মিলিত হয়ে একমত হয়ে বলল, ‘আমরা এ কাজের জন্য নিন্দা জানাচ্ছি, উদ্বেগ জানাচ্ছি।’ (ওম শান্তি, ওম শান্তি, জগতের সব প্রাণী সুখী হোক)। তাহলে জাতিসঙ্ঘকে কী বলে আখ্যায়িত করতে হবে? দুনিয়ার সব মানুষের আশা-ভরসার স্থল ও ন্যায্য বিচারের শক্তিধর আদালত, না অপদার্থ কুচক্রীদের নিষ্ফল চাপাবাজির নাট্যশালা।
আরাকানের মুসলমানদের নিধনযজ্ঞে আমাদের দেশের পাশের মোড়ল এমনই আহøাদিত হলো যে, সে আনন্দের আতিশয্যে বাড়িতে টিকতে না পেরে মিয়ানমারে উড়ে গেল। সু চির পিঠ চাপড়িয়ে বলল, কাজের কাজ করেছ, বিধর্মীদের মেরে তাড়িয়েছ, এ কাজে আমি পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছি। এমনকি জাতিসঙ্ঘের এই ৭২তম সাধারণ অধিবেশনের সময়ে পাশের মোড়ল ঘোষণা করল যে, তার দেশে আশ্রয় নেয়া চল্লিশ হাজার রোহিঙ্গাকে দেশ থেকে বের করে দেয়া হবে, কারণ এরা নাকি জঙ্গি। এভাবে নির্যাতিত, নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমতকে বিভ্রান্ত করার জন্য অং সান সু চির সাথে আমাদের পাশের মোড়ল একযোগে কাজ করছে। সাপ হয়ে কাটছে আর ওঝা হয়ে কিছু ত্রাণ নিয়ে আসছে।
ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা স্পষ্টই প্রমাণ করছে, সমস্যার সমাধান জাতিসঙ্ঘ করবে না। তারা সমস্যা জিইয়ে রেখে মানুষের দুর্বলতা আর দুর্দশা নিয়ে বছরের পর বছর খেলতে থাকবে। তাহলে এখন প্রশ্ন, মুসলমানদের সমস্যার সমাধান কোথায় পাওয়া যাবে?
পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের চেয়েও বড় আশ্চর্যের বিষয় এই যে, মুসলমানরা প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে কমপক্ষে ২৯ বার আল্লাহর কাছে এই আকুতি জানান যে, ‘হে আল্লাহ, তুমি আমাদেরকে গজবপ্রাপ্ত (ইহুদি) আর পথহারা (খ্রিষ্টানদের) পথে পরিচালিত করো না।’ কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, নামাজের সময়টুকু বাদে বেশির ভাগ মুসলমানের গোটা জীবনটা ইহুদি-নাসারাদের বুদ্ধি, পরামর্শ, উপদেশ, শিক্ষা-সংস্কৃতি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। মুসলমানরা ইহুদি-নাসারাদের পদে পদে অনুসরণ করছে। তারা যা যা করছে মুসলমানরাও তাই করছে। মুসলমানরা জাহিলিয়াতের এমন স্তরে এসে পৌঁছেছে যে, আপনি যদি মধুর সুরে পড়েনÑ তুয়্মিনূনা বিল্লাহি ওয়া রাসূলিহি…ওয়া আনফুসিকুমÑ তাহলে আপনাকে সম্মান করা হবে, হয়তো বা দাওয়াত করে খাওয়ানো হবে, না হয় বখশিশ দেয়া হবে। কিন্তু যদি আপনি বলেনÑ ‘তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ওপরে ঈমান আনো এবং তোমাদের মাল দিয়ে ও জান দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করো, তাহলে আপনাকে জঙ্গি বলে ঘোষণা দিয়ে গুলি করে মারা হবে।’ উপযুক্ত দুটোই কিন্তু একই কথা, একটি আরবিতে, একটি বাংলায়। তার মানে, জিহাদের আয়াত তিলাওয়াত করে নেক হাসিল করো, কিন্তু সেটা বুঝতে চাইলে আর বোঝাতে চাইলেই গুলি করো।
জিহাদের মধ্যেই নিহিত আছে মুসলমানদের জন্য মান, মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব, রাজত্ব ও আধিপত্য। বাস্তবে জিহাদ করা তো পরের কথা, মুসলমানরা যদি জিহাদের জন্য সদা প্রস্তুত হয়ে থাকে তাহলে দুনিয়ার সব শক্তি তাদের ভয় করবে, কোনো প্রকার জুলুম করার সাহস করবে না। আল কুরআনের অনেক আয়াতে আল্লহ তায়ালা মুসলমানদের জিহাদ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন, উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করেছেন। মহান আল্লাহ বলেছেন, হে ঈমানদারগণ! তোমাদের হয়েছে কী যে, যখন তোমাদেরকে আল্লাহর পথে বের হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয় তখন তোমরা আরো জোরে মাটি কামড়ে ধর। তোমরা কি আখেরাতের স্থলে দুনিয়ার জীবনকেই বেশি পছন্দ করো? আখেরাতের তুলনায় পার্থিব জীবনের ভোগসামগ্রী তো অতি সামান্য। তোমরা যদি যুদ্ধাভিযানে বের না হও, তাহলে তোমাদেরকে ভয়াবহ শাস্তি দেয়া হবে, আর তোমাদের স্থলে অন্য সম্প্রদায়কে আনা হবে (অথচ) তোমরা তাঁর কোনোই ক্ষতি করতে পারবে না। আল্লাহ সব বিষয়ে সর্বশক্তিমান। যুদ্ধাভিযানে বেরিয়ে পড়, অবস্থা হালকাই হোক আর ভারীই হোক (অস্ত্র কম থাকুক আর বেশি থাকুক) আর আল্লাহর রাস্তায় তোমাদের মাল দিয়ে আর তোমাদের জান দিয়ে জিহাদ করো, এটাই তোমাদের জন্য সর্বোত্তম, তোমরা যদি জানতে! (সূরা তাওবা : ৩৮, ৩৯, ৪১) তোমাদের কী হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর পথে এবং অসহায় নারী-পুরুষ আর শিশুদের (রক্ষার) জন্য লড়াই করবে না, যারা দোয়া করছেÑ ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এ জালিম অধ্যুষিত জনপথ হতে মুক্তি দাও, তোমার পক্ষ থেকে কাউকেও আমাদের বন্ধু বানিয়ে দাও এবং তোমার পক্ষ থেকে কাউকেও আমাদের সাহায্যকারী করে দাও’ (সূরা নিসা : ৭৫)। আমরা বলে থাকি, ওরা বিরাট দেশ, বিরাট সেনাবাহিনী, নানান অস্ত্রে সজ্জিত, যুদ্ধে আমরা কি ওদের সাথে পারি? শুনুন আল্লাহ কী বলেন : হে নবী! যুদ্ধের ব্যাপারে মুমিনদেরকে উদ্বুদ্ধ করো। তোমাদের মধ্যে ২০ জন ধৈর্যশীল থাকলে তারা ২০০ জনের ওপর জয়ী হবে এবং তোমাদের মধ্যে (ওইরূপ) ১০০ জন থাকলে তারা এক হাজার কাফেরের ওপর বিজয়ী হবে। কেননা তারা হচ্ছে এমন লোক যারা (ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে) কোনো বোধ রাখে না। (তবে) এখন আল্লাহ তোমাদের দায়িত্বভার কমিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ তো জানেন যে, তোমাদের ভেতর দুর্বলতা রয়ে গেছে, কাজেই তোমাদের মাঝে যদি ১০০ জন ধৈর্যশীল হয় তবে তারা ২০০ জনের ওপর বিজয়ী হবে। আর যদি তোমাদের মাঝে এক হাজার (ওই রকম) লোক পাওয়া যায় তাহলে তারা আল্লাহর হুকুমে দুই হাজার লোকের ওপর জয়ী হবে। আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে (আছেন) (সূরা আনফাল : ৬৫-৬৬)।
বাংলাদেশে রয়েছে আমাদের গর্ব, একটি মহান, সুশৃঙ্খল, সুশিক্ষিত, সুগঠিত বীর সেনাবাহিনী। এই সেনাবাহিনীর অধীনে স্কুল, কলেজ, মাদরাসার লাখ লাখ শিক্ষার্থীর কম্পালসারি মিলিটারি ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
অতএব ভয়ের কোনো কারণ নেই। আমরা যদি আল্লাহর ওপর ভরসা করে ময়দানে টিকে থাকি, সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকি তবে বিজয় সুনিশ্চিত।

অধ্যাপক মোহাম্মাদ মোজাম্মেল হক

লেখক : শিক্ষাবিদ


শেয়ার করুন