‘জীবনের মূল্য যে রাষ্ট্র দিতে পারে না তাকে সিভিলাইজ স্টেট বলা যায় না’

রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে তার নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা বিধান করা। আর রাষ্ট্র যদি সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় তাহলে সেটা হবে সবচেয়ে বড় রকমের ব্যর্থতা। এমন মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট রাজনৈতিক ভাষ্যকার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ।

 তিনি বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদের গুম হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে বলেন, এখন দেশবাসী চাইছে এই ব্যক্তিটি কোথায় কিভাবে আছে তার হদিস জনসমক্ষে দেয়া। সরকারের বহু গোয়েন্দা সংস্থা রয়েছে, নিরাপত্তাবাহিনী রয়েছে ফলে এসব সংস্থা তৎপর হলে সালাহউদ্দিন আহমেদকে খুঁজে বের করা খুব কঠিন কিছু নয়।

 ড.মাহবুব উল্লাহ বলেন, ধরে নেয়া যাক তার বিরুদ্ধে সরকার বা রাষ্ট্রের তরফ থেকে কোনো অভিযোগ আছে বা থাকতে পারে। তো সেজন্য তো তাকে গ্রেফতার করা হবে এবং আদালতে সোপর্দ করা হবে। কিন্তু তার মতো একজন মানুষ  যিনি একটি দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাবেক মন্ত্রী এবং এমপি তিনি একেবারে লাপাত্তা হবে যাবেন এটা মেনে নেয়া খুব কঠিন। এঘটনার পর বাংলাদেশের অনেকেই এমন ভাবছেন যে তারা নিজেরাও নিরাপদ নন।

 বিশিষ্ট এই অধ্যাপক বলেন, জীবনের চেয়ে মূল্যবান আর কিছু নয়। আর সেই জীবনের মূল্য যে রাষ্ট্র বা যে সমাজ দিতে পারে না বা সেই মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে না সেই রাষ্ট্র বা সমাজকে সিভিলাইজ স্টেট বা সমাজ বলা যায় না।  আমি যেখানে শংকিত সেটা হচ্ছে আমাদের রাজনীতিতে বা রাষ্ট্র পরিচালনায় এমন কিছু কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে তাতে ভবিষ্যতে যদি কোনো রাজনৈতিক পরিবর্তন হয় তখন যারা ক্ষমতায় যাবে তাদের অনুসারীরাও হয়তো একইভাবে প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠবে।

 আসন্ন সিটি কর্পোরেশনের সার্বিক অবস্থা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশে একটি অংশগ্রহণমূলক এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন কিন্তু আমরা আশা করতে পারি না। তারপরও আমি বলব এই নির্বাচনটা যাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয় ও সবার অংশগ্রহণমূলক হয় তার জন্য একটা সুস্থ পরিবেশ তৈরি করবে নির্বাচন কমিশন এবং সরকার। রেডিও তেহরানের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।

 পুরো সাক্ষাৎকারটি উপস্থাপন করা হলো। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

 রেডিও তেহরান: বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ নিখোঁজ হওয়ার পর ২০ দিন হয়ে গেলেও কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি। তার স্ত্রী আবেদন জানিয়েছেন যেন তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়। কিন্তু সরকার কোনো দায় নিতে চাইছে না। কিভাবে দেখবেন এ ঘটনাকে?

 ড. মাহবুব উল্লাহ : দেখুন রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে তার নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা বিধান করা। আর রাষ্ট্র যদি সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় তাহলে সেটা হবে সবচেয়ে বড় রকমের ব্যর্থতা। তো জনাব সালাহউদ্দিন আহমেদ গত ১০ মার্চ থেকে নিখোঁজ রয়েছেন। অবশ্য এর আগে তিনি ব্যক্তিগত প্রয়োজনে আত্মগোপন করেছিলেন।

 বর্তমানে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সেই পরিস্থিতিতে কারোপক্ষে বিশেষ করে যারা বিরোধী দলীয় রাজনীতি করে তাদের পক্ষে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। আর সে কারণে রাজনৈতিক গতিপ্রবাহকে অব্যাহত রাখার জন্য সালাহউদ্দিন আহমেদ যে পন্থায় কাজ করছিলেন অর্থাৎ নিজেকে গ্রেফতার থেকে বাঁচিয়ে ঝুঁকি নিয়েও দলের বিবৃতি প্রচার করছিলেন। আমরা মিডিয়ার সংবাদে দেখেছি তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছিল। এরইমধ্যে তিনি রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে গেলেন।

 তার স্ত্রীর অভিযোগ কিম্বা সংবাদপত্রেরও কিছু রিপোর্টে লেখা দেখলাম যে তাকে তুলে নেয়ার পেছনে কিছু সশস্ত্র ব্যক্তি ভূমিকা পালন করেছে। এখন দেশবাসী চাইছে এই ব্যক্তিটি কোথায় কিভাবে আছে তার হদিস জনসমক্ষে দেয়া। সরকারের বহু গোয়েন্দা সংস্থা রয়েছে, নিরাপত্তাবাহিনী রয়েছে ফলে এসব সংস্থা তৎপর হলে সালাহউদ্দিন আহমেদকে খুঁজে বের করা খুব কঠিন কিছু নয়।

 ধরে নেয়া যাক তার বিরুদ্ধে সরকার বা রাষ্ট্রের তরফ থেকে কোনো অভিযোগ আছে বা থাকতে পারে। তো সেজন্য তো তাকে গ্রেফতার করা হবে এবং আদালতে সোপর্দ করা হবে। কিন্তু তার মতো একজন মানুষ  যিনি একটি দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাবেক মন্ত্রী এবং এমপি তিনি একেবারে লাপাত্তা হবে যাবেন এটা মেনে নেয়া খুব কঠিন। এঘটনার পর বাংলাদেশের অনেকেই এমন ভাবছেন যে তারা নিজেরাও নিরাপদ নন।

 রেডিও তেহরান:  সালাহউদ্দিন আহমেদের নিখোঁজ হওয়া এবং ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার ঘটনাকে অনেকেই একইসূত্রে গাঁথা বলে মন্তব্য করেছেন। যদি তাই হয় তাহলে রাজনীতির অঙ্গনে এ ঘটনার সুদূর প্রসারি প্রভাব কি পড়বে বলে মনে হয়?

 ড.মাহবুবু উল্লাহ: এরআগে একটু কথা বলে নিতে চাই। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি মানুষের জীবনের চেয়ে মূল্যবান আর কিছু নয়। আর সেই জীবনের মূল্য যে রাষ্ট্র বা যে সমাজ দিতে পারে না বা সেই মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে না সেই রাষ্ট্র বা সমাজকে সিভিলাইজ স্টেট বা সমাজ বলা যায় না।  আমি যেখানে শংকিত সেটা হচ্ছে আমাদের রাজনীতিতে বা রাষ্ট্র পরিচালনায় এমন কিছু কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে তাতে ভবিষ্যতে যদি কোনো রাজনৈতিক পরিবর্তন হয় তখন যারা ক্ষমতায় যাবে তাদের অনুসারীরাও হয়তো একইভাবে প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠবে। আর এই প্রতিশোধ পরায়ণতা যদি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলতে থাকে তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ, সমাজের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতি  নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।

 এতে দেখা যাবে সমাজের মধ্যে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়বে। আমরা চাই না দেশ সেভাবে অস্থিরতার কবলে পড়ুক। এবারও আমরা লক্ষ্য করেছি সালাহউদ্দিন আহমেদ তো একটা পরিচিত নাম। এছাড়াও খুব বেশি পরিচিত নয় এরকম অনেকের ক্ষেত্রে বন্দুক যুদ্ধের নামে নিহত হওয়া বা হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। আর এর পরিসংখ্যান দৈনিক  কাগজে বের হচ্ছে। একদিকে যেমন পেট্রোল বোমায় অগ্নিদগ্ধ হওয়ার ঘটনা আমরা লক্ষ্য করছি পাশাপাশি এ ধরণের অন্তর্ঘাতের ঘটনাও আমরা লক্ষ্য করছি। আর এসবকিছুই কিন্তু খুবই বিপজ্জনক এবং উদ্বেগজনক।

 রেডিও তেহরান: ২৮ এপ্রিল ঢাকা মহানগরের দুটি এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। যখন বিএনপি ও ২০ দলের আন্দোলন চলছে তখন সরকার এ নির্বাচন করতে যাচ্ছে। আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

 ড.মাহবুব উল্লাহ:  আপনারা সবাই জানেন ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন আরো বহুদিন আগে হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তা হয় নি। কেন হয় নি সে সম্পর্কে ব্যাখ্যা জনগণের কাছেও যেমন স্পষ্ট ঠিক তেমনি যারা রাজনীতি করেন তাদের কাছে ও স্পষ্ট। এখন এমন সময়ে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন দেয়া হচ্ছে যখন বিরোধী শিবির অত্যন্ত অপ্রস্তুত অবস্থায় আছে এবং তারা তাদের আত্মরক্ষার জন্য ছুটে বেড়াচ্ছে; তাদের হাজার হাজার কর্মী কারারুদ্ধ অবস্থায় আছে। এরকম অবস্থা চলতে থাকলে দেশে একটি অংশগ্রহণমূলক এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন কিন্তু আমরা আশা করতে পারি না। তারপরও আমি বলব এই নির্বাচনটা যাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয় ও সবার অংশগ্রহণমূলক হয় তার জন্য একটা সুস্থ পরিবেশ তৈরি করবে নির্বাচন কমিশন এবং সরকার।

 রেডিও তেহরান:  ঢাকা সিটিতে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না। কিন্তু নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরুর আগেই তাকে ভিন্ন অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। মান্নার আটকের ঘটনাকে আপনি কিভাবে বিশ্লেষণ করবেন?

 ড.মাহবুব উল্লাহ: দেখুন মাহমুদুর রহমান মান্নার বিরুদ্ধে তো একটা অভিযোগ এসেছে। সেটার ব্যাপারে তদন্ত চলছে। এখনও জিজ্ঞাসাবাদের পর্যায়ে রয়েছে। ফলে তদন্তাধীন একটা বিষয়ে মন্তব্য করা অত্যন্ত দূরুহ। দেখা যাক তদন্তের মধ্যে কি বেরিয়ে আসে। তবে রাষ্ট্রের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা চাইবো কারো প্রতি যেন অবিচার করা না হয়। সে যেন সুবিচার পায়  এটা নিশ্চিত হোক।

 রেডিও তেহরান: মাহমুদুর রহমান মান্নাকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তার স্ত্রী মেহের নিগার। প্রশ্ন হচ্ছে- সুস্থ মানুষকে রিমান্ডে নেয়া হয় আর বের হন অসুস্থ হয়ে। রিমান্ডে এই নির্যাতনের সুযোগ কি আইন দিয়েছে? অনেক সময় এমনও দেখা যায়- আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়। এ অবস্থার অবসানে কি করণীয় আছে?

 ড.মাহবুব উল্লাহ:  দেখুন এ ব্যাপারে করণীয় হচ্ছে- আমরা জানি বহু দেশেই মামলার স্বার্থে বা তদন্তের জন্য জিজ্ঞাসাবাদের একটা ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সেই জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যে যেন অমানবিক বা অশোভন  কিছু না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। যাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে রিমান্ডে তার জীবন যাতে বিপন্ন না হয় এবং তিনি যাতে সুস্থভাবে থাকেন সেটা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে আমাদের দেশীয় আইনেও। তবে আশ্চর্য্যের বিষয় অনেকগুলো ঘটনাতে আমরা লক্ষ্য করছি রিমান্ডে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। অনেকে হাসপাতালে আসতে বাধ্য হয়েছেন। মাহমুদুর রহমান মান্নাও সেভাবে অসুস্থ হয়েছেন। জানিনা এসব ঘটনার অবসান আসলে কিভাবে ঘটবে। তবে নাগরিক হিসেবে আমাদের আকাংখা আমরা যেন সবাই সভ্য আচরণ করার চেষ্টা করি। রাষ্ট্রযন্ত্রের নিপীড়ন যেন অহেতুক কারো জীবনকে বিপন্ন বা ক্ষতিগ্রস্ত না করে সেটাই আমাদের আকাংখা। মানুষ সেটাই চাইবে।


শেয়ার করুন