জাতীয় রাজনীতিতে বিয়োগ কাহিনী : প্রেক্ষিত কক্সবাজার

-রুহুল কাদের বাবুল

রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় গুম, খুনের ঘটনা দীর্ঘদিনের। সম্প্রতি আশংকাজনক হারে বেড়েছে এ ধরনের অমানবিক দুর্বিসহ ঘনাবলীর। প্রায়শই কেউ না কেউ নিখোঁজ হচ্ছেন বা অপহৃত হচ্ছেন। নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারের অভিযোগ, আইন শৃংখলা বাহিনীর সমস্যরা তাদের স্বজনদের তুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু আইন শৃংখলা বাহিনীর সাফ জবাব, তারা তাদের গ্রেফতার বা আটক করেনি বরং অভিযোগ পাওয়ার পর অপহৃতদের উদ্ধারে তারা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। বিপরীত মুখী এমন এক অবস্থানে নিখোঁজ এসব ঘটনার রহস্য আরও ঘনীভূত হচ্ছে। এ ধরনের অগ্রহনযোগ্য ও অনভিপ্রেত বিয়োগ কাহিনীতে কালিমালিপ্ত হচ্ছে জাতীয় রাজনীতির গতি প্রকৃতি। সম্প্রতি বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব কক্সবাজারের কৃতি সন্তান সালাউদ্দিন আহমদের অপহরণ রহস্য জাতীয় রাজনীতিতে নতুন মাত্রার জন্ম দিয়েছে।

প্রায় একমাসেও খোঁজ মেলেনি পর্যটন নগরী কক্সবাজারের কৃতিসন্তান সাবেক যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী ও বিএনপির যুগ্ন মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমদের। এ ঘটনায় উদ্বিগ্ন ও ভীত সন্ত্রস্থ তার পরিবারের সদস্যরা। দিন যতই গড়াচ্ছে, পরিবার ও দলে উদ্বেগ উৎকন্টা ততই বাড়ছে। বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিরাজ করছে চরম আতংক ও অস্থিরতা। গত ১০ই মার্চ রাত ১০টার দিকে রাজধানীর উত্তরার একটি বাসা থেকে নিখোঁজ হন বিএনপির এই যুগ্ন মহাসচিব। পরিবারের অভিযোগ, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাকে তুলে নিয়ে গেছে। এ ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের একটি সার্চ কমিটি গঠন করা হলেও উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি নেই পুলিশি এই সার্চ কমিটির।

স্বামী সালাহ উদ্দিনের খোজে নানা জায়গায় ছুটোছুটি করে ক্লান্ত-দিশেহারা হয়ে পড়েছেন স্ত্রী হাসিনা আহমেদ। প্রধানমন্ত্রীর কাছেও স্মারকলিপি দিয়ে স্বামীকে ফিরে দিতে আকুতি জানিয়েছেন তিনি। স্বামীকে ফেরৎ পেতে ধর্ণা দিচ্ছেন আইনজীবী ও রাজনীতিবিদদের কাছেও। কিন্তু কারও থেকেও কোন আশার বাণী পাওয়া যাচ্ছে না।

সম্প্রতি বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক বলেছেন, বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন আহমদ সম্পর্কে পুলিশ অবশ্যই জানে। কিন্তু কিছুই বলছেনা। তার নিখোঁজের বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক ও কলংকজনক বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ডঃ মিজানুর রহমান বলেছেন, বিএনপির যুগ্নমহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমদকে উদ্ধার করে জনসম্মুখে এনে পুলিশকে প্রমাণ করতে হবে যে, তাকে আটক করা হয়নি।

কক্সবাজারের এই কৃতিপুরুষ ১৯৬২ সালের ৩০ জুন পেকুয়ার সিকদার পাড়ায় জন্মগ্রহন করেন। তার পিতা মাওলানা সাইদুল হক। তিনি একজন শিক্ষক ছিলেন। ১৯৮৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে এল এল এম পাশ করে ৭ম বিসিএস পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হয়ে ১৯৮৮ সালে শিক্ষানবিশ সহকারী কমিশনার (ম্যজিস্ট্রেট) হিসেবে বগুড়ায় যোগ দেন। ১৯৯১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সহকারী একান্ত সচিব হিসবে নিযুক্ত হন। ১৯৯৫ সালে সরকারি চাকুরি ছেড়ে বিএনপির সভাপতি মনোনীত হন। বিএনপির প্রার্থী হিসাবে কক্সবাজার Ñ১ চকরিয়া-পেকুয়া আসন হতে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে ৪ দলীয় ঐক্যজোটের প্রার্থী হিসাবে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। তিনি পেকুয়ার নতুন উপজেলা স্থাপন, পেকুয়া হাসপাতাল, চকরিয়া পৌরসভা, শহীদ জিয়াউর রহমান উপকূলীয় কলেজ, শহীদ জিয়া ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউট পেকুয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ ব্যাপক উন্নয়নে ভূমিকা রাখেন।

অপরদিকে,
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিক রাখার দায়ে অপহৃত হয়ে ফিরে আসেননি কক্সবাজারের আর এক কৃতি সন্তান মৌলভী ফরিদ আহমদ। তিনি ১৯২৩ সালে রামু উপজেলার ধলিরছড়ায় জন্মগ্রহন করেন। নাদেরুজ্জামান মাষ্টার হচ্ছেন তার পিতা। ১৯৫২ সালে কক্সবাজার পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের মনোনয়নে রামু-উখিয়া টেকনাফ এলাকা থেকে প্রাদেশিক সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালে দ্বিতীয় গনপরিষদ সদস্য ও পার্লামেন্টারি পার্টির চিফ হুইফ নির্বাচিত হন। ১৯৫৭ সালে ইসমাইল ইব্রাহীম মন্ত্রীসভার শ্রমন্ত্রী মনোনীত হন। ১৯৬২ ও ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের তৃতীয় ও চতুর্থ জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালে ইরানে ও ১৯৫৭ সালে লন্ডনে আন্তর্জাতিক শ্রম-সংস্থার সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত ভিপি ছিলেন ১৯৪৫-১৯৪৬ সালে এবং নির্বাচিত ভিপি ছিলেন ১৯৪৬-১৯৪৭ সালে। তিনি পাবলিক সার্ভিস কমিশনে বাংলাকে অন্যতম সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি প্রদানে কর্তৃপক্ষের অস্বীকৃতির প্রতিবাদে ৮ জানুয়ারী ১৯৪৮ সালে ঢাকা কলেজের ইংরেজী বিভাগের প্রভাষকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্নে দুঃসাহসী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫২ সালে মহল বিশেষের সাজানো অস্ত্র মামলায় প্রথম গ্রেপ্তার হন তিনি। ১৯৬৪ সালে জননিরাপত্তা আইনে দ্বিতীয় বার গ্রেপ্তার হন। সাংবাদিকতা ও সাহিত্য ক্ষেত্রেও তাঁর বিশেষ কৃতিত্ব আছে। তার প্রকাশিত গ্রন্থঃ মোহাম্মদ আলী ক্লে (১৯৬৫) কারাগারে সাতাশ দিন (১৯৬৭) এবং দি সান বিহাইন্ড দ্যা ক্লাউডস (১৯৭১)। ১৯৭১ সালের ১৮ই ডিসেম্বর ঢাকার তার এক বন্ধুর বাসভবন থেকে তিনি অপহৃত হয়ে আর ফিরে আসেন নি। একই ধরনের ভাগ্যবরণের অজানা আশংকায় দিনাতিপাত করেছে এখন বিএনপির যুগ্নমহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমদের পরিবার, দলীয় নেতা-কর্মী এবং কক্সবাজারের সাধারণ মানুষ। আল্লাহ আমাদের সহায় হউন। জাতীয় রাজনীতির বিয়োগ কাহিনীর এধরনের জঘন্য ষড়যন্ত্র হতে কক্সবাজার বাসী মুক্তি চায়। এই আশা আমাদের সবার।


শেয়ার করুন