জলে জ্বলছে জীবন

প্রথম আলো :

ঘরের সামনে হাঁটুপানিতে এই কিশোর। আজ বৃহস্পতিবার ডেমরার পশ্চিম বামৈল ব্যাংক কলোনি এলাকা থেকে তোলা। ছবি: আসাদুজ্জামান
ডেমরার পশ্চিম বামৈল এলাকার হাসিনা বানুর ঘরের ভেতর হাঁটুসমান পানি। বৃহস্পতিবার দুপুরে দেখা যায়, বালতি দিয়ে ঘর থেকে পানি বের করছেন। পানি ঠেকানোর জন্য ঘরের দরজায় ইট দিয়ে উঁচু করেছেন। কিন্তু পানি থামাতে পারছেন না। ঘরের সামনে কোমরপানি। বারবার সেচেন আর বারবার পানি ঢোকে। ইতিমধ্যে পানি তার ফ্রিজ নষ্ট করে ফেলেছে। কোনোমতে ইট দিয়ে খাট উঁচু করে কষ্ট করে সেখানে থাকেন। খাটই এখন শোয়া ও খাবারের একমাত্র জায়গা।

হাসিনা বানুর মতো ডেমরা ও যাত্রাবাড়ীর লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে মানবেতর জীবন করতে বাধ্য হচ্ছেন। এক মাস আগে থেকে এসব এলাকার ঘরে ঘরে পানি উঠলেও গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন তাঁরা। বন্ধ হয়ে গেছে স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন দোকানপাট। অধিকাংশ রাস্তায় হাঁটুর ওপরে পানি জমেছে। ওই পানিতে এখন রিকশা ছাড়া আর কোনো যানবাহন চলতে পারছে না। চরম ভোগান্তিতে এসব এলাকার মানুষ। সাপসহ বিভিন্ন কীটপতঙ্গ ঘরে ঢুকে পড়ায় আতঙ্কে এলাকার লোকজন। ঘরে তালা মেরে বহু বাড়িওয়ালা এলাকা ছেড়েছেন। ভাড়াটেরাও বাসা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। পানিবন্দী এসব এলাকার লাখো মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এলাকাবাসীর ভাষ্য, এই পানিবন্দী জীবন আর সহ্য হচ্ছে না।

জলবন্দী জীবনে কষ্টের রান্না। ছবিটি আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর রহমতপুর এলাকা থেকে তোলা। ছবি: হাসান রাজা
ডেমরার পশ্চিম ট্যাংরা এলাকার বাসিন্দা হাসনাত আলী বললেন, ‘আর কত কষ্ট করতে হবে আমাদের? ঘরে পানি, বাইরে পানি, রাস্তায় পানি। পানি আর পানি। পানিতে ঘরের সব আসবাব নষ্ট করে দিয়েছে। এত কষ্টের জিনিস যখন পানিতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তখন অনেক খারাপ লাগে।’ ডেমরা ও যাত্রাবাড়ীর জলাবদ্ধ এলাকা ঘুরে দেখা গেল, অধিকাংশ ঘরে হাঁটুপানি। ডুবে গেছে রান্নাঘর। ছোট্ট ছোট্ট শিশুরা ঠাঁই নিয়েছে খাটের ওপর। রাফসান আহমেদ ডেমরার একটি স্কুলের প্রথম শ্রেণির ছাত্র। সে থাকে ডেমরার পশ্চিম বামৈল এলাকায়। ১৫ দিন ধরে স্কুলে যাচ্ছে না। তার বাবা আফসার হোসেন বললেন, দিনের পর দিন রাস্তায় যদি হাঁটুর ওপরে পানি জমে থাকে তাহলে স্কুলে কীভাবে ছেলেকে নিয়ে যাবেন। ঘরের ভেতরও একই অবস্থায়। এত টুকু বাচ্চা নিয়ে কত যে কষ্ট, তা কাউকে বোঝানো যাবে না।

এলাকাবাসী জানালেন, জলাবদ্ধ এলাকায় রোগের প্রকোপ বেড়েছে। বহু লোক পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। দেখা গেল, এসব এলাকার অধিকাংশ শৌচাগার পানির তলে। বিভিন্ন কারখানার রাসায়নিক পানি মিশেছে। কালো দুর্গন্ধযুক্ত এসব পানিতে চর্মরোগে আক্রান্ত হয়েছেন অনেকে। ডেমরার রসুল নগরের বাসিন্দা হালিমা বেগম বললেন, এভাবে কী মানুষ বেঁচে থাকতে পারে? আর কত দিন এভাবে থাকতে হবে? স্থানীয় জনপ্রতিনিধি সারুলিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আর কত দিন মানুষ পানিবন্দী হয়ে থাকবে। দুই-আড়াই মাস হয়ে গেল। এবারের টানা বৃষ্টিতে মানুষ আর বসবাস করতে পারছেন না। ঘরে ঘরে হাঁটু ও কোমরপানি। ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে পারছে না।’ ডেমরার শামসুল হক খান স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মাহবুবুর রহমান মোল্লা বলেন, কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে স্কুলে পানি উঠেছে। পানির কারণে স্কুল দুদিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। রাস্তায় রাস্তায় পানি। স্কুল-কলেজগামী ছাত্রছাত্রীরা অবর্ণনীয় কষ্টে আছে।

বৃষ্টির পানিতে কেন এসব এলাকায় পানি জমে যাচ্ছে—কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেল, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা ও সিদ্ধিরগঞ্জের অধিকাংশ খাল ময়লা-আবর্জনা ফেলে ভরাট করে ফেলা হয়েছে। অতিরিক্ত বৃষ্টির হলে পানি সরতে পারছে না। যে কারণে পানি জমে জমে এলাকাগুলোতে জলাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। আবার অনেক এলাকার খাল দখল করে সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে দোকানপাট, ঘরবাড়ি। এতে এলাকার পানি আর খাল দিয়ে পানি সরতে পারছে না। খালগুলোর এমন অবস্থার কারণে মূলত এই জলাবদ্ধতা। এসব এলাকার পানি বিভিন্ন খাল দিয়ে গিয়ে জমা হয় নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইলে। সেখানে আছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ডিএনডি পাম্পহাউস। পানি সেচের জন্য আছে চারটি পাম্প। এসব পানি সেচ দিয়ে ফেলা হয় নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে।

পাউবোর ঢাকা নারায়ণগঞ্জ ডেমরা সেচ প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু তালেব প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৯৪৫ সালে চারটি পাম্প বসানো হয়েছিল। তখনকার উদ্দেশ্য ছিল কৃষিজমিতে সেচ দেওয়া। এত বছরে এসব এলাকায় যত ঘরবাড়ি হয়েছে, কলকারখানা হয়েছে, এগুলোর তরল বর্জ্য অপসারণে যে সক্ষমতা দরকার, তা আমাদের নেই। এর সঙ্গে যখন বৃষ্টির পানি যোগ হয়, তখন আমাদের আরও বেশি সমস্যা হয়। যে পরিমাণ পানি এখানে আসছে, তা সরানো সম্ভব হচ্ছে না। যে কারণে এলাকায় জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। মানুষ ভোগান্তির মধ্যে পড়ছে।’

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (ঢাকা ডিভিশন-১) আবদুল আওয়াল মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক দিনের বৃষ্টিতে যে পরিমাণ পানি যাত্রাবাড়ী ও ডেমরা এলাকায় জমে, তা সেচতে সাত দিন সময় লাগে। যে কারণে বৃষ্টি হলে এলাকায় জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে।’ পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই কর্মকর্তা বলেন, এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ২০২০ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ হতে পারে। এর আগ পর্যন্ত ডেমরা-যাত্রাবাড়ী এলাকার মানুষের কষ্ট স্বীকার করতেই হবে।’


শেয়ার করুন