জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব,কক্সবাজারে সুপেয় পানির সংকট

নিজস্ব প্ররতিবেদকঃ

কক্সবাজারে সুপেয় পানির সংকট, বাড়ছে ভোগান্তিনলকূপে অল্প পানি মিললেও তা লবণাক্ত, খাওয়ার অনুপযোগী
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়েছে প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর। শুষ্ক মৌসুম আসতে না আসতেই কক্সবাজারের সর্বত্র সুপেয় পানির সংকট দিন দিন প্রকট হচ্ছে। জেলা শহরসহ ৮ উপজেলার ৭২ ইউনিয়নের সিংহভাগ এলাকাতেই দ্রুত নেমে যাচ্ছে ভূ-গর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তর।

জেলার সরকারি প্রায় ৩০ হাজার নলকূপের এক হাজার ১৫৯টি অকেজো হয়ে পড়েছে। পানি উঠছে না আরও প্রায় হাজার খানেক নলকূপে। দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়াতে এ সংকট তীব্র। ভোগান্তি বেড়েছে বিশ্বের বৃহৎ মানবিক আশ্রয়ণ এলাকা টেকনাফ-উখিয়াতেও। অনাবৃষ্টি ও অতি তাপমাত্রার ফলে এ ভোগান্তি বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী ঋত্বিক চৌধুরী। কক্সবাজার শহর ও টেকনাফে গাড়িতে করে কিছু এলাকায় সন্ধ্যায় খাবার পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। সার্ফেস ওয়াটারের ব্যবস্থা করা সম্ভব না হলে আগামীতে এ ভয়াবহতা আরও বাড়তে পারে বলে মনে করেন তিনি।

কক্সবাজার পৌরসভার জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল বিভাগের মতে, কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য অগভীর নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে। কক্সবাজারে সুপেয় পানির স্তর প্রতিবছর ১০ থেকে ১১ ফুট হারে নিচে নামছে। গত ১০ বছর আগেও শহরের টেকপাড়ায় ১২০ থেকে ১৫০ ফুটের মধ্যে ভূ-গর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তর পাওয়া যেতো। অথচ এখন পানির জন্য যেতে হয় তিনশ ফুটের বেশি গভীরে। গত কয়েক বছরে কক্সবাজার সাগরপাড়ের কলাতলী এলাকায় ভূ-গর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তর ১০ থেকে ১৫ ফুট নিচে নেমেছে। ফলে অকেজো হয়েছে সাগরপাড়ের ৩ শতাধিক আবাসিক হোটেলের অসংখ্য পানির পাম্প। ভূ-গর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে এমন অবস্থা বলে মনে করছে কক্সবাজার পরিবেশ অধিদফতর।

কুতুবদিয়ার সমাজকর্মী হাছান মাহমুদ সুজন জানান, উপজেলার উত্তর ধূরুং, দক্ষিণ ধূরুং, লেমশীখালী, কৈয়ারবিলসহ বড়ঘোপ ইউনিয়নের প্রায় এলাকার হস্তচালিত টিউবওয়েল থেকে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে উত্তর ও দক্ষিণ ধূরুং ও লেমশীখালীর বিভিন্ন এলাকায় এ সমস্যা বেশি দেখা দিচ্ছে। বিগত বর্ষায় বেড়িবাঁধ ডিঙিয়ে প্লাবিত হয়েছিল পুরো উত্তর ধূরুং ইউনিয়ন। ফলে সেখানকার প্রতিটা বসত ভিটার পুকুর লবণাক্ত পানিতে তলিয়ে যায়। কিছু পুকুরে সামান্য মিঠা পানি থাকলেও শুকিয়ে যাওয়ার কারণে তা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

একই অবস্থা উপকূলীয় পেকুয়া, মহেশখালীর বিভিন্ন ইউনিয়ন, চকরিয়া, কক্সবাজার সদরের উপকূলীয় পোকখালী, বৃহত্তর গোমাতলী, খুরুশকুল, রামু, জোয়ারিয়ানালা, উখিয়ার উপকূল, টেকনাফের সিংহভাগ এলাকায়।

কক্সবাজার পৌর ৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়মী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু আহমেদ জানান, গত জানুয়ারি থেকে বাঁকখালী তীরের অন্তত ২০টি গ্রামের কয়েকশ নলকূপের পানি পাওয়া যাচ্ছে না। অল্প পরিমাণ নলকূপে পানি মিললেও তা লবণাক্ত, খাওয়ার অনুপযোগী। ফলে প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ টাকা দিয়ে বোতলজাত পানি কিনে খেতে হচ্ছে।

টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র আবদুল্লাহ মনির বলেন, পৌর এলাকার মাটির নিচে রয়েছে জমাট বাঁধা পাথর। পাথর ভেদ করে স্থাপন করা নলকূপের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আয়রন থাকে। ফলে লোকজনকে পাহাড়ি ছড়া, ঝর্ণা ও পাতকুয়ার পানির ওপর নির্ভর করতে হয়। পৌরসভার বাস স্টেশন, কায়ুখালীপাড়া, চৌধুরীপাড়া, পল্লানপাড়া, নাইট্যংপাড়ার লোকজন স্থানীয় পাহাড়ি ঝর্ণার পানি সংগ্রহ করে চাহিদা মেটাচ্ছেন।

কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) চেয়ারম্যান লে. কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমেদ বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে খোলা জায়গা ও জলাধার কমে যাওয়া এবং ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরে অতিরিক্ত চাপের কারণে এই সঙ্কট, যা আমাদের জন্য অশনি সংকেত। এখনি প্রস্তুতি না নিলে আগামীতে সমস্যাটা মারাত্মক আকার ধারণ করবে।

কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলন ও কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, পর্যটন জোনসহ জেলার নানা এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে বোম-মটর সংযুক্ত গভীর নলকূপ বসানো হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী দেড় হাজার থেকে দুই হাজার ফুট দূরত্বের মধ্যে একেকটি গভীর নলকূপ স্থাপনের কথা। কিন্তু হোটেল মালিকরা মাত্র ৫০ ফুটের মধ্যেই একাধিক নলকূপ বসিয়েছে। এছাড়া নির্বিচারে গাছপালা ধ্বংস করা ও ব্যাপকভাবে পাহাড় কাটার কারণে এ বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। মৌসুম ভেদে পানি সংকটের কারণে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিঘ্নিত হচ্ছে।

কক্সবাজার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী ঋত্বিক চৌধুরী বলেন, পৃথিবীতে পানির মাত্র ২ দশমিক ৫ শতাংশ মিঠাপানি। এ মিঠাপানির ৩০ দশমিক ১ শতাংশ পানি থাকে ভূ-গর্ভে। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি মাঠ-ঘাট, রাস্তা, জলাশয় ভেদ করে মাটির নিচে জমা হয় ও সারাবছর আমাদের পানির চাহিদা মেটায়। সূক্ষ্ম বালিকণা ভেদ করে মাটির নিচে জমা হয় বলে এ পানি বিশুদ্ধ।

তিনি বলেন, বর্তমানে দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে, দেশে ক্রমাগত ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নেমে যাচ্ছে। অপরিকল্পিত নগররায়নের ফলে অধিকাংশ এলাকা এখন কংক্রিটের শহর। ফলে মাটি ভেদ করে পানি নিচে পৌঁছাতে পারছে না। বৃষ্টির পানি খাল বা নদী-নালায় চলে যাচ্ছে। বর্ষাকালে সামান্য বৃষ্টিতেই বন্যা দেখা দেয়।

তার মতে, ভূ-গর্ভস্থ পানির বিকল্প হিসেবে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে, পুকুর-লেক বা নদী বৃদ্ধি করে ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে হবে। অতিমাত্রায় পানি তুললে এই উৎসটি আর নবায়ন যোগ্য থাকে না। মেরিন ড্রাইভ সড়কের কলাতলীর দরিয়ানগর ঝর্ণা, হিমছড়ি ঝর্ণা, টেকনাফের শীলেরছড়া, দইঙ্গাকাটা পাহাড় বাহিত পানি সংরক্ষণ করে ব্যবহার উপযোগী করলে পানির সংকট কিছুটা হলেও কমিয়ে আনা সম্ভব।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগের এক জরিপে বলা হয়েছে, ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা না হলে প্রতিবছর ১০ মিটার করে পানির স্তর নিচে নেমে যাবে। অথচ সত্তরের দশকে যেখানে ভূ-গর্ভস্থ পানিতল ভূ-পৃষ্ঠ থেকে এক মিটারেরও কম গভীরতায় ছিল, বর্তমানে তা সর্বোচ্চ ৭০ মিটার পর্যন্ত নেমে গেছে।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জরিপ অনুযায়ী, দেশে মোট নদীর সংখ্যা ৩১০টি। অনেকের মতে, বাংলাদেশে ছোট-বড় প্রায় ৬০০টি নদী রয়েছে। এর মধ্যে ৫৭টি নদী আন্তর্জাতিক, যার ৫৪টিই এসেছে ভারত থেকে নেমে। বাকি ৩টি এসেছে মিয়ানমার থেকে। সর্বশেষ হিসাবে দেখা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশের প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কিলোমিটার নদীপথ নাব্যতা হারিয়েছে।


শেয়ার করুন