চেয়ারম্যানের ভোট ওপেনে মেম্বার গোপনে!

52d83997bca56-46আব্দুল কাইয়ুম

এ যাবৎ শুনে এসেছি, বিভিন্ন নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীদের দাঁড়াতে দেওয়া হচ্ছে না। এবার শুনলাম, রাঙামাটির ১৯টি ইউপি নির্বাচনে খোদ আওয়ামী লীগের প্রার্থী দাঁড়াতে পারেননি। আজ প্রথম আলোর প্রথম পাতার এ খবরটি উদ্বেগজনক। এ জন্য নয় যে সরকারি দলের প্রার্থী দাঁড়াতে সাহস পাচ্ছেন না। ভয়ের আসল কারণ হলো, নির্বাচনে কোনো কোনো দলের সম্ভাব্য প্রার্থীকে দাঁড়াতে না দেওয়ার জন্য মূলত দায়ী করা হচ্ছিল আওয়ামী লীগকে আর এখন ওরা নিজেই সেই বিভীষিকার শিকার! তার মানে, নির্বাচনে কোনো বিরোধী প্রার্থীকে বলপ্রয়োগে দাঁড়াতে না দেওয়ার সংস্কৃতি আমাদের রাজনীতিতে ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে।
যে অস্ত্র এর আগে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ হাতে তুলে নিয়েছিল, এখন সেই অস্ত্র তাদের বিরুদ্ধেই উদ্যত!
কী হচ্ছে এসব? জিজ্ঞেস করলাম স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ, স্থানীয় সরকার কমিশনের সাবেক সদস্য তোফায়েল আহমেদকে। তিনি বললেন, এ রকমই তো হবে। কারণ, অপছন্দের প্রার্থীকে ভোটে দাঁড়াতে না দেওয়ার যে প্রক্রিয়া দেশে সচেতনভাবে চালু করা হয়েছে, তা যে শেষ পর্যন্ত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশকে ধ্বংস করবে, সে আশঙ্কার কথা আমরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছি। আজ আওয়ামী লীগ বিএনপিকে দিচ্ছে না, কাল সুযোগ পেলে বিএনপি দেবে না আওয়ামী লীগকে। আর তার আগেই এখন রাঙামাটিতে ‘স্থানীয় রাজনৈতিক দলের সশস্ত্র তৎপরতা ও হুমকি’র কারণে আওয়ামী লীগ ১৯ ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী দিতে পারছে না। বিএনপিও পারছে না ২৭ ইউনিয়নে। আর ১০টি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কোনো দলেরই চেয়ারম্যান প্রার্থী নেই। সবাই ধরাশায়ী সহিংস পরিবেশের কাছে।
নির্বাচনে সহিংসতাকে প্রশ্রয় দেওয়ার পরিণতি খুব করুণ। আওয়ামী লীগ এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। ইউপি নির্বাচনের প্রথম পর্বে ভোটের দিন, ২২ মার্চ ১১ জনের প্রাণহানি ঘটে। এর আগেও কিছু প্রাণহানি ঘটেছে। সব মিলিয়ে ২১ জন। বেশির ভাগ প্রাণহানি ও সহিংসতার পেছনে আওয়ামী লীগের লোকজনই জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। বিরোধী বিএনপি বলতে কেউ না থাকায় সরকারদলীয় লোকজনই একে অপরের বিরুদ্ধে লেগে গেছেন। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ শঙ্কিত বলে জানা গেছে (প্রথম আলো, ২৬ মার্চ ২০১৬)।
এবারের ইউপি নির্বাচনে ‘আমরা আর মামারা’ ধরনের ভোটের উপদ্রব জেঁকে বসেছে। অনেক আসনে বিএনপির প্রার্থী না থাকায় আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ ভোট হয়েছে। নিজেদের মধ্যে ভোটের লড়াইটাও অনেক ক্ষেত্রে সুষ্ঠু-সুন্দর হতে পারেনি। যেখানে যার জোর, ওরাই মাঠ দখল করে নিয়েছে। প্রতিপক্ষ দূরে সরে গেছে বা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন মুখে অনেক কথা বললেও শেষ পর্যন্ত তেমন কিছু করতে পারেনি। কারণ, কে তাদের কেয়ার করে! নির্বাচন কমিশন কাগজ-কলমে কাজ করছে মাত্র। বাস্তবে কিছু করতে চাইলেও পারবে কি না—সন্দেহ।
তবে নির্বাচনে কিন্তু মোটামুটি উৎসবের আমেজ দেখা গেছে অনেক ক্ষেত্রে। বেশ লোকজন গেছেন ভোট দিতে। নির্বাচন যদি এতই সন্ত্রাস-জর্জরিত হবে, তাহলে এত লোক ভোট দিতে গেলেন কীভাবে? এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। বিষয়টি তুললাম স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদের কাছে। তিনি খোলাসা করে বললেন, লোকজন তো গেছে মেম্বারের টানে। প্রতি ইউনিয়নে মেম্বার প্রার্থীরা তাঁদের ভাই-বেরাদর, বন্ধুবান্ধবদের সাজিয়ে-গুজিয়ে নিয়ে গেছেন ভোটকেন্দ্রে। দলে দলে তাঁরা গেছেন তাঁদের প্রিয় মেম্বার প্রার্থীদের ভোট দিতে।
কিন্তু ভোট দিতে গিয়ে দেখেন এলাহি কা-! যেখানে যে চেয়ারম্যান প্রার্থীর জোর বেশি, সেখানে তিনি বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে প্রভাব বিস্তার করে চেয়ারম্যানের ভোট প্রকাশ্যে দিতে হবে, এমন দাবি করছেন। বেশ কিছু কেন্দ্রে এ রকম হয়েছে বলে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। অনেক কেন্দ্রে ভোটাররা গিয়ে দেখেন ছড়া কেটে বলা হচ্ছে, ‘চেয়ারম্যান ভোট ওপেনে, অন্যদের ভোট গোপনে’ (প্রথম আলো, ২৩ মার্চ ২০১৬)।
তাই দেখে ভোটাররা মহা খুশি। কারণ, তাঁদের আসল উদ্দেশ্য তো মেম্বার নির্বাচন। সেটা তাঁরা মোটামুটি নির্বিবাদে দিতে পেরেছেন। চেয়ারম্যানের ভোটটি প্রকাশ্যে ভোটের বাক্সে ফেলে ভেতরে গিয়ে গোপনে মেম্বারের ভোট দিয়ে এসেছেন। পত্রিকায় প্রকাশিত এ খবরের পর বলতে হয় ভোটের বারোটা বেজে গেছে। প্রথম আলো


শেয়ার করুন