কালেরকন্ঠ :
দীর্ঘ অবহেলা ও অস্বীকৃতির পর অবশেষে বাংলাদেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক মানের উন্নয়ন ঘটতে চলেছে। দেশের বেশির ভাগ রেললাইন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের। চীনের সহায়তায় এবার সেগুলো হালনাগাদ হতে যাচ্ছে। স্টেশন ও ওয়ার্কশপগুলোর পুনঃসংস্কার, নতুন ট্রেন ক্রয় এবং হাজার হাজার কিলোমিটার নতুন লাইন স্থাপনে চীন বাংলাদেশকে ৩০ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দিবে। প্রাচীন সিল্করুটের পুনরুজ্জীবন ঘটানোর মাধ্যমে পুরো এশিয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে যে উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে চীন তার অংশ হিসেবেই বাংলাদেশকে এই সহায়তা দিচ্ছে দেশটি।
এক প্রতিবেদনে এমনটাই জানিয়েছে নিউ ইয়র্কভিত্তিক অর্থ ও বাণিজ্যবিষয়ক সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ।
চীন বাংলাদেশকে ২ শতাংশ সুদে ৯ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিবে। যা ১৫ বছর মেয়াদে শোধ করা যাবে। তবে এ জন্য আরো ৫ বছর অতিরিক্ত সময়ও দেওয়া হতে পারে। তাদের হাতে আসা এ-সংক্রান্ত ডকুমেন্ট থেকে এমনটাই জানা গেছে বলে জানিয়েছে ব্লুমবার্গ।
ব্লুমবার্গ জানায়, গত বছর দুটি বৈঠকে বাংলাদেশের রেল খাতের উন্নয়নে চীনের অর্থায়নের বিষয়টি আলোচিত হয় বলে জানিয়েছেন ওই বৈঠকগুলোতে উপস্থিত কয়েকজন কর্মকর্তা। তবে বৈঠকগুলো গোপনীয় ছিল বলে তারা নিজেদের নাম প্রকাশে অপরাগতা প্রকাশ করেছেন।
দেশের প্রধান প্রধান শিল্পাঞ্চল ও ভারতীয় সীমান্তের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার যোগাযোগ গড়ে তুলতে অন্তত ছয়টি রেল প্রকল্প নির্মাণের জন্য নগদ অর্থ সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। বিদ্যমান রেললাইনগুলোর উন্নয়ন এবং নতুন নতুন ব্রিজ নির্মাণের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি এই অঞ্চলের শীর্ষে উঠবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গত ৩ মে বাংলাদেশ সরকার ১৭২ কি. মি. (১০৭ মাইল) এর একটি রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে। এতে ব্যয় হবে ৩৫০ বিলিয়ন টাকা (৪.৫ বিলিয়ন ডলার)। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ঢাকার সঙ্গে যশোর জেলার রেল সংযোগ স্থাপিত হবে। যার ফলে প্রথমবারের মতো রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগ গড়ে উঠবে।
দীর্ঘতম ব্রিজ
ইতিমধ্যেই এই প্রকল্পের জন্য গৃহীত পরিকল্পনার অধীনে চীন বাংলাদেশকে ২৪৭ বিলিয়ন ডলার টাকার সহজ শর্তের ঋণ সহায়তা দিবে। এর মধ্যে ৬.১৫ কিলোমিটারের পদ্মা সেতু প্রকল্পটিও রয়েছে। চীনের মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কম্পানি ১২১ বিলিয়ন টাকার একটি চুক্তির অধীনে এর কাজ শেষ করবে। এটিই হবে বাংলাদেশে ওই কম্পানিটির সবচেয়ে বড় প্রকল্প।
২০১৮ সালে পদ্মা ব্রিজটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার চার বছর পর যশোর রেললাইনের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এই দুটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে, দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির গতি বছরে ১.৫-১.৭৫ পয়েন্ট বেড়ে যাবে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
এ ছাড়াও চীনের কাছ থেকে অন্যান্য রেললাইনের উন্নয়নের জন্যও বাংলাদেশ অর্থ সহায়তা চেয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ৪ বিলিয়ন ডলারের একটি দুই ট্র্যাকের রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পও রয়েছে। এটি দেশের দীর্ঘতম একক রেলওয়ে প্রকল্প।
বিনিয়োগ বাড়ছে
২০১০ সাল থেকেই বাংলাদেশের জিডিপি ৬ শতাংশ হারে বাড়ছে। এর ফলে এখন জিডিপির ৩৪ শতাংশই বিনিয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে। আগে এর পরিমাণ ছিল জিডিপির ২৫ শতাংশ। এতে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি ৮ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। এমনটাই পূর্বাভাস দিয়েছেন ঢাকাভিত্তিক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ।
একটি চিঠিতে ব্লুমবার্গ দেখতে পায়, বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তার মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে একটি রেল প্রকল্পের জন্য চীনের ঋণ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, ২০৩০ সালের মধ্যে ২০ বছর মেয়াদি এক মহাপরিকল্পনার অধীনে ২৩৫টি রেল প্রকল্পে ২.৩৪ ট্রিলিয়ন টাকা ব্যয় করবে বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশে ২,৮৭৭ কি. মি. সচল রেলপথ রয়েছে। চলতি বছরের শেষদিকে এর সঙ্গে আরো ৩৭৫ কি. মি. যুক্ত হবে।
বাধাগ্রস্ত চীন
তবে প্রাচীন সিল্করুটের পুনরুজ্জীবনে চীন যে উচ্চাভিলাষী মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে তা বাস্তবায়ন অতটা সহজ হবে না। কারণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব বেড়ে চলায় ভীত হয়ে মহাদেশটির অনেক দেশই চীনের বিরুদ্ধাচরণ করছে।
সম্প্রতি থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক থেকে দেশটির উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় শহর নোং খাই পর্যন্ত একটি রেললাইন নির্মাণে সহায়তার চেষ্টা করে ব্যার্থ হয় চীন। থাই সরকার এতে রাজি হয়নি।
এমনকি বাংলাদেশেও চীন একটি প্রকল্পে অর্থায়ন করতে চেয়ে ব্যার্থ হয়েছে। ২০১৪ সালে চায়না রেলওয়ে গ্রুপ দোহাজারি থেকে কক্সবাজার হয়ে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী গুনদুম পর্যন্ত ১২৯ কিলোমিটারের একটি রেলপথ নির্মাণের সমঝোতা স্মারক সই করে। কিন্তু ওই প্রকল্পে অর্থায়নের দায়িত্ব এখন এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এডিবির কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র। ওই প্রকল্পের এক তৃতীয়াংশ খরচ বাবদ এডিবি ১.৫ বিলিয়ন ডলার দিবে। তবে চীনা কম্পানিগুলোর ওই প্রকল্পে অর্থায়নের সুযোগ রয়েছে বলেও জানা গেছে।
সিপিডির গবেষণা প্রধান খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ”বাংলাদেশ মূলত কোনো একটি বিশেষ দেশ বা পক্ষের কাছেই সবকিছুর দায়িত্ব তুলে না দিয়ে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছে।”
প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাপানকে ছাড়িয়ে চীন এশিয়ার বৃহত্তম উন্নয়ন-সহায়তা সরবরাহকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
গত বছর চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ৩.৪ কি. মি. একটি দীর্ঘ টানেল নির্মাণের অনুমতি পায় চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কম্পানি। চট্টগ্রামে দেশের বৃহত্তম বন্দরে ১.১ বিলিয়ন ডলারের একটি সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের অধীনে ওই টানেলটি নির্মিত হবে।