চাকরিতে ‘ছাত্রলীগ কোটা’!

বুয়েট মিলনায়তনে গত ১১ জুন ছাত্রলীগের দুই দিনব্যাপী বর্ধিত সভায় ওবায়দুল কাদের। ছবি: ফোকাস বাংলা

বুয়েট মিলনায়তনে গত ১১ জুন ছাত্রলীগের দুই দিনব্যাপী বর্ধিত সভায় ওবায়দুল কাদের। ছবি: ফোকাস বাংলা

প্র্থম আলো :

কী দিনই-না এসেছে! এখন নাকি উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সবশেষ শ্রমশক্তি জরিপ এ কথাই বলছে (১২ জুন ২০১৭, সমকাল)।

বোঝাই যাচ্ছে, উচ্চশিক্ষিত তরুণদের এখন বড্ড অকাল যাচ্ছে। পড়ালেখা শেষে তাঁরা কাজ করতে আগ্রহী। কিন্তু কাজ মিলছে না। বসে থাকতে হচ্ছে। এতে তাঁদের দক্ষতা কমছে। বিপথগামী হওয়ার প্রবণতাও আছে।

উচ্চশিক্ষিত তরুণদের এমন যখন দুঃসময়, ঠিক তখন একটা আশার বাণী শোনা গেল। টাকা-চাকরি যা দরকার, তার ব্যবস্থা হবে। তবে একটু কথা আছে। প্রস্তাবটি সবার জন্য উন্মুক্ত নয়।

দুনিয়াটা বড় কঠিন জায়গা। এখানে সবার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয় না। বেশির ভাগ মানুষকে নিজের ভাগ্য নিজেকেই গড়ে নিতে হয়। একটা চাকরি, বিশেষ করে সরকারি চাকরির জন্য সাধারণ ছাত্রদের কতই-না পরিশ্রম করতে হয়। তাঁরা জানেন, তাঁদের টাকাওয়ালা ‘মামা-খালু’ নেই। রাজনীতি না করায় মাথার ওপর নেই ক্ষমতাসীন দলের লিডারের ‘ছায়া’। পড়ার টেবিলেই তাঁরা জীবন-জীবিকার উপায় মেলাতে চান। বইয়ের পাতায় চোখ রেখে তাঁদের দিনরাত্রি একাকার হয়। এত সাধনার পরেও যে ‘সোনার হরিণ’ ধরা দেবে, তার নিশ্চয়তা নেই।

তবে ছাত্রলীগ হলে ভিন্ন কথা। অন্তত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সাম্প্রতিক বক্তব্যে তেমনটাই মনে হয়। ছাত্রলীগের উদ্দেশে তিনি প্রকাশ্যে বলেছেন, ‘টাকার দরকার হলে আমার কাছে আসবে। …যখন ছাত্রত্ব চলে যাবে, বেকার হবে, চাকরির জন্য প্রয়োজন হবে, আমার কাছে আসবে (১২ জুন ২০১৭, প্রথম আলো)।’

১১ জুন বুয়েট মিলনায়তনে ছাত্রলীগের দুই দিনব্যাপী বর্ধিত সভায় এমন ‘উদ্দীপনামূলক’ প্রস্তাবের সঙ্গে কিছু শর্তও জুড়ে দিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী। শর্ত হলো পরীক্ষা দিয়ে রিটেনে না টিকে ‘ছাত্রলীগ করেছি’ বললে হবে না। নিয়মমতো পরীক্ষায় টিকে ‘যোগ্য’ হলে চাকরির বিষয়ে অবশ্যই দেখবেন তিনি।

ওবায়দুল কাদের আগেভাগেই তাঁর বক্তব্যকে ‘দলীয়’ উল্লেখ করে ‘দায়মুক্তির’ একটা সুযোগ খোলা রেখেছেন। কিন্তু দল ও সরকারে ওবায়দুল কাদেরের যে অবস্থান, তাতে তাঁর বক্তব্য নিছক ‘দলীয়’ তকমার মধ্যে আবদ্ধ থাকে না। খুব স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে তাঁর বক্তব্য তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। প্রথম আলোয় এ-সংক্রান্ত সংবাদের নিচে হাবিবুর রহমান নামের একজনের প্রশ্ন ছিল, ‘আমরা কোথায় যাব?’ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য নিয়ে ফেসবুকেও তুমুল বিতর্ক লক্ষ করা গেছে। অনেকেই তাঁকে সবার মন্ত্রী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক-বর্তমান অনেক নেতা-কর্মীকেই চিনি, জানি। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য নিয়ে ছাত্রলীগের ভেতরেই সন্দেহ-সমালোচনা আছে। ব্যক্তিগত আলাপচারিতার পাশাপাশি ফেসবুকের মতো জনপ্রিয় জনপরিসরে আকারে-ইঙ্গিতে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যের বিরুদ্ধে মনোভাব প্রকাশ হতে দেখা গেছে।

ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, মুক্তির সংগ্রামসহ বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে লেপটে থাকা ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগে মেধাবীদের অভাব আগেও ছিল না, এখনো নেই বলে বিশ্বাস করি। ছাত্রলীগ একটা প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান থেকে আসা তরুণেরা শুরু থেকেই নিজেদের যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। দেশ-বিদেশে সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। কারও ‘বিশেষ সুপারিশ’ ছাড়াই বিসিএসে তাঁদের সাফল্য অর্জনের ভূরি ভূরি নজির আছে।

ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য ‘দলীয়’ হোক, আর যা-ই হোক, তিনি আদতে ছাত্রলীগেরই ক্ষতি করলেন। সাধারণ ছাত্রদের এমন কথাও বলতে শুনেছি, ওবায়দুল কাদের তো এবার আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ছাত্রলীগ কোটা’ চালুর ঘোষণা দিলেন।

ছাত্রলীগের যে ছেলে বা মেয়েটি পরীক্ষা দিয়ে রিটেনে টিকবে, ভাইভায় পাস করার যোগ্যতাও তাঁর থাকার কথা। মন্ত্রীর কাছে ধরনা দেওয়ার দরকার তাঁর পড়বে না। চাকরির জন্য ডেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মেধারও অবমূল্যায়ন করেছেন ওবায়দুল কাদের।

এখন যে বিষয়টি হবে, মেধার জোরে ছাত্রলীগের কেউ চাকরি পেলেও এই নিয়োগে সন্দেহের সিল লেগে থাকবে। আর আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ দল কখনো ক্ষমতায় এলে তখন এই নিয়োগপ্রাপ্তদের সামনে আসল বিপদটা হাজির হতে পারে।

চাকরিতে ‘ছাত্রলীগ কোটা’ কারও জন্যই মঙ্গলজনক হবে না। ন্যায় ও সমতার স্বার্থে মেধার ভিত্তিতেই সব নিয়োগ হওয়া উচিত। এতে আওয়ামী লীগের ভোট বাড়বে বৈকি কমবে না।

সাইফুল সামিন: সাংবাদিক


শেয়ার করুন