চট্টগ্রামে জনশক্তি রপ্তানিতে ধস

foriegn-workersসিটিএন ডেস্ক :

মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চট্টগ্রাম জেলা থেকে জনশক্তি রপ্তানিতে ব্যাপক ধস নেমেছে। ২০১৩ সাল থেকে জনশক্তি রপ্তানির হার পূর্বের বছরগুলোর তুলনায় এক তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে।

বৈশ্বিক মন্দা, বাংলাদেশ সরকারের সাথে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সরকারের সাথে দূরত্ব, জেলা কোটার বাধ্যবাধকতা, প্রশিক্ষণের অভাবে দক্ষ-আধা দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হওয়া ও বেসরকারি উদ্যোগে জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ থাকায় চট্টগ্রামে এই ধস নেমে এসেছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

তবে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি বলছেন, চট্টগ্রামসহ দেশে জনশক্তি রপ্তানিতে যে ধস নেমেছে সেটি কাটিয়ে উঠতে সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে। জেলা কোটা বাদ দেয়া হয়েছে এবং বিদেশি দেশগুলোর সাথে জি টু জি পদ্ধতিতে শ্রমিক নেয়ার প্রথাটিও তুলে দেয়া হচ্ছে।

চট্টগ্রাম জেলা কর্মসংস্থান কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বৈধ অভিবাসী রয়েছে প্রায় ৯১ লাখ। এরমধ্যে শুধুমাত্র ১৫ লাখই হচ্ছে চট্টগ্রাম জেলার। ৯১ লাখ অভিভাসীর মধ্যে প্রায় শতকরা ৯০ ভাগই সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কর্মরত রয়েছে। এছাড়া হাজার দশেক অভিবাসী অবৈধভাবে মধ্যপ্রাচ্যে রয়েছে বলে জানা গেছে।

বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলাসহ কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী জেলা থেকেই প্রায় ৫০ লাখ অভিবাসী বিদেশে কাজ করছে। গত তিন বছর আগেও যেখানে শুধুমাত্র চট্টগ্রাম জেলা থেকে বছরে ৭০ হাজারের ওপরে অভিবাসী বিদেশে গেছেন, সেখানে ২০১৫ সালে এসে সেই সংখ্যা ২৫ হাজারের ঘরে নেমে এসেছে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চট্টগ্রাম থেকে বৈধভাবে বিদেশেগামী অভিবাসীর সংখ্যা ২০১১ সালে ৭৩ হাজার ৩২৩ জন, ২০১২ সালে ৭০ হাজার ৩০৭ জন, ২০১৩ সালে ২৬ হাজার ২২৬ জন, ২০১৪ সালে ২৭ হাজার ৭২৪ জন ও ২০১৫ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত ১৭ হাজার একজন।

Saudi-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির বড় বাজার হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ কয়েকটি দেশ। এসব দেশে নতুন জনশক্তি রপ্তানি একেবারেই কমে গেছে। এসব দেশগুলো বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক না নিয়ে পাকিস্তান, ভারতসহ অন্য দেশগুলো থেকে শ্রমিক নেয়া শুরু করেছে। এর কারণ হিসেবে সেখানে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের নানান অপকর্মে জড়িয়ে পড়া ও ভিসার অপব্যবহার, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা, বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা, নতুন বাজার ধরতে বাংলাদেশ সরকারের তৎপরতার অভাবকেই দায়ী করা হচ্ছে।

এছাড়া বেশ কয়েকটি শ্রমশক্তি আমদানিকারক দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি ও দুর্বল কূটনৈতিক তৎপরতাকেও দুষছেন অনেকে। অবশ্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণেও জনশক্তি রপ্তানি কিছুটা কমেছে। সৌদি আরব ও আরব আমিরাতে দীর্ঘ দিন ধরে জনশক্তি রপ্তনি বন্ধই ছিল। এখন সীমিত আকারে শ্রমিক রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি হলেও সেই দেশের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না বাংলাদেশ সরকার।

এছাড়া কুয়েতে গত কয়েক বছর ধরেই জনশক্তি রপ্তানি প্রায় বন্ধ রয়েছে। মালয়েশিয়ায় সরকার টু সরকার বা জিটুজি পদ্ধতিতে যে জনশক্তি রপ্তানি হচ্ছে তা খুবই ধীরগতিতে। কাতারসহ অন্যান্য দেশেগুলোয় ব্যাপক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সেখানে রপ্তানির পরিমাণ খুবই কম। ফলে চাকরির সন্ধানে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই সাগরপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড পাড়ি দিচ্ছে হাজার হাজার শ্রমিক।

এছাড়া বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে গিয়ে সেখানে প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশের শ্রমবাজার দখল করে নিয়েছে বলে তথ্য দিয়েছেন স্বয়ং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় এ দেশের পাসপোর্ট নিয়ে প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার দখল করে নিয়েছে। এসব রোহিঙ্গাদের স্বভাবটাই হচ্ছে উগ্র। তারা যে কোনো জায়গায় গিয়ে ঝগড়া-ফ্যাসাদে জড়িয়ে পড়ে। আর বিদেশে বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে যাওয়ায় তাদের কুকর্মের দায়টা আমাদের ঘাড়ে এসে পড়ে।’

বিদেশে চট্টগ্রামের জনশক্তি রপ্তানিতে ধস প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক কূটনীতিক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বাংলামেইলকে বলেন, ‘তিনটি কারণে চট্টগ্রামসহ সারাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানিতে ধস নেমেছে। প্রথম কারণ হচ্ছে- সরকারের কূটনৈতিক দুর্বলতার কারণে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিদেশের শ্রমবাজার আমাদের দখল থেকে অন্যদের দখলে চলে যাচ্ছে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে- সরকার মালয়েশিয়া, সৌদি আরবসহ আরো কয়েকটি দেশে সরকার টু সরকার বা জিটুজি পদ্ধতিতে জনশক্তি রপ্তানি করতে যাচ্ছে। এর ফলে আগে যেভাবে ভিসার টাকা জোগাড় করে বিশেষ করে প্রবাসী অধ্যুষিত চট্টগ্রাম থেকে জনশক্তি রপ্তানি হতো এখন অন্য জেলা থেকেও সমহারে শ্রমিক নেয়ার ফলে চট্টগ্রামের সুযোগটা সংকুচিত হয়ে পড়েছে। তৃতীয় কারণটি হচ্ছে- বেসরকারি জনশক্তি রপ্তানিতে সরকার অনুউৎসাহিত করার ফলে বিদেশের শ্রমবাজার দখলে সরকার সেভাবে সফল হচ্ছে না।’

এ সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তরা বিদেশে শ্রমবাজার তৈরির নামে যেসব বিদেশ সফর করে সেগুলো অনেকটা আনন্দ ভ্রমণের মতো হয়। কিন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যখন বিদেশে বাজার খুঁজতে বের হয় তারা যে কোনোভাবেই হোক সেখান থেকে চাহিদাপত্র জোগাড় করে নিয়ে আসবেই। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তারা বিষয়টিকে সেভাবে নেয় না। এসব কারণে চট্টগ্রাম থেকে জনশক্তি রপ্তানিতে ধস নেমেছে।’

Katar-চট্টগ্রাম জেলা কর্মসংস্থান কার্যালয়ে সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ জহিরুল হক মজুমদার বাংলামেইলকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম থেকে যেসব শ্রমিক বিদেশে যান, তার ৯৮ ভাগ শ্রমিকই যান সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কাতার, ওমান ও কুয়েতে। এরমধ্যে বড় দেশগুলো অনেকদিন বন্ধ থাকায় সেই প্রভাবটাও পড়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি দেশ শ্রমিক নেয়া শুরু করলেও তাদের চাহিদা আমরা সেভাবে পূরণ করতে পারছি না। যেমন বাংলাদেশ থেকে প্রাথমিকভাবে ৩ হাজার চালক ও নির্মাণ শ্রমিক নেয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে সৌদি আরব সরকার। কিন্তু হাজার হাজার আগ্রহী প্রার্থী সৌদি আরব যেতে নাম নিবন্ধন করলেও সেখান থেকে চালক হিসেবে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়ে ভিসার অপেক্ষায় রয়েছেন মাত্র ৯৭ জন আর নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন মাত্র ৩৪ জন। এর মাধ্যমে বুঝা যাচ্ছে কেনো চট্টগ্রাম থেকে জনশক্তি রপ্তানিতে ধস নেমেছে।’

এ সমস্যা থেকে উত্তরণে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি বলেছেন, ‘বিদেশে দক্ষ ও আধাদক্ষ শ্রমিকের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তবে এদেশের বেশিরভাগই শ্রমিক অদক্ষ। সেজন্য আমরা সরকারি উদ্যোগে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেছি। এখন থেকে ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে লোক পাঠানো হবে। দেশের প্রতিটি উপজেলায় ট্রেনিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হবে। চট্টগ্রামেও দুটি ট্রেনিং সেন্টার থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের দক্ষ করে তুলা হচ্ছে।’

তবে জনশক্তি রপ্তানির এই ধসকে তেমন একটা নেতিবাচক হিসেবে না দেখে এটিকে বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নতি হিসেবেই দেখছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের রিচার্স অব ব্যুরোর পরিচালক অধ্যাপক ড. সালেহ জহুর।

তিনি বাংলামেইলকে বলেন, ‘গত এক দশক আগেও চট্টগ্রাম থেকে যেভাবে মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক যেতো এখন সেভাবে যাচ্ছে না। এর কারণ হচ্ছে- দেশে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা ও মাথাপিছু আয় বাড়ছে। মানুষ এখন বিদেশমুখি না হয়ে সামান্য পুঁজি দিয়েই ব্যবসা শুরু করে দিচ্ছে। সবাই মিনি এন্টারপেইনার হিসেবে গড়ে উঠছে। এছাড়া যারা আগে বিদেশে গিয়ে টাকা পয়সা আয় করেছে তাদের সন্তানদের তারা লেখাপড়া শিখিয়ে বিদেশে শ্রমিক হিসেবে না পাঠিয়ে দেশেই বিভিন্ন চাকরিতে প্রবেশে উৎসাহিত করছে। বিশেষ করে চট্টগ্রামের মানুষের আয় ও শিক্ষার হার আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। ফলে এখন আগের মত সেভাবে কেউ শ্রমিক হিসেবে বিদেশে কাজ করতে ইচ্ছুক না। তারা সামন্য পুঁজি থাকলেই নিজেদের মত করে ব্যবসা শুরু করে দিচ্ছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘এরপরও এখনো অনেকে বিদেশ যেতে আগ্রহী কিন্তু ভিসাসহ আনুষাঙ্গিক যে খরচ পড়ছে এই খরচও তারা বহন করতে পারছে না। এক্ষেত্রে সরকার বিনাখরচে শ্রমিক পাঠানোর যে উদ্যোগ নিয়েছে সেটি আরো কার্যকর করতে পারলে হয়তো জনশক্তি রপ্তানির এই ধসটা কমিয়ে আনা যাবে।’

সার্বিক বিষয় সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি বাংলামেইলকে বলেন, ‘চট্টগ্রামসহ সারাদেশের জনশক্তি রপ্তানির ধস ঠেকাতে আমরা বন্ধ থাকা শ্রমবাজারগুলো চালু করছি। সরকার টু সরকার পদ্ধতির বাইরেও বেসরকারি পদ্ধতিতে জনশক্তি রপ্তানির ব্যাপারেও উৎসাহিত করা হচ্ছে। এছাড়া জেলা কোটায় শ্রমিক রপ্তানির বিষয়টিও তুলে দেয়া হয়েছে।’


শেয়ার করুন