জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি

চকরিয়ায় আড়াই মাসে ১০ খুন

এ.এম হোবাইব সজীব, চকরিয়া:

কক্সবাজারের চকরিয়ার বিভিন্ন ইউনিয়নে ও জেলার বিভিন্ন স্থানে আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটেছে। খুন, অপহরণ, ডাকাতি ও ছিনতাই নিত্য মাথা চড়া দিয়ে দাঁড়িয়েছে। ফিল্মী স্টাইলে খুন করা হচ্ছে আওয়ামীলীগ নেতাসহ সাধারণ মানুষকে। জ্যালজ্যান্ত মানুষ উধাও হচ্ছে। গত মে মাস থেকে ৪ জুলাই পর্যন্ত সময়ে আনসার কমান্ডার ও পশুচিকিৎসক এবং আওয়ামীলীগ নেতা ও প্রবাসীসহ ১০জন নির্মমভাবে খুন হয়েছেন।
চকরিয়া, মহেশখালী, রামু, টেকনাফ ও সদরে কমান্ডে স্টাইলে এসব হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ঘরের ভেতর ও যানবাহন থেকে অপহরণের শিকার হয়েছেন প্রবাসীসহ ডজনাধিক ব্যক্তি। তাদের কাউকে প্রশাসন উদ্ধার করতে পারেনি। মুক্তিপণ দিয়েই মুক্ত হয়েছেন সকল অপহৃতরা। পাশাপাশি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েকটি। ঘটনার পর স্ব স্ব এলাকার দায়িত্বরত পুলিশ ডাকাত কবলিত এলাকায় গিয়ে ডকাতদের গ্রেফতার না করে খালি হাতে ফিরে। পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তা ব্যক্তিদের নির্লিপ্ততা ও অপরাধী লালনই এসব ঘটনা ক্রমে বাড়ছে বলে মনে করছেন বোদ্ধামহল। ফলে আতংকে দিনাতিপাত করছে কক্সবাজার জেলাবাসী।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের পরিসংখ্যান মতে, ৩০ জুন রাত ১১টার দিকে চকরিয়ার বদরখালীতে ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরু হুদা সিকদারকে গলা কেটে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। তাকে সবার সামনে বাজার থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয় বলে দাবি করেছেন নিহতের ছেলে ব্যবসায়ী মুহাম্মদ শাহাজাহান।
গত ৩ জুলাই রাত ১০টার দিকে দ্বীপ উপজেলা মহেশখালী কুতুবজোম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সোনাদিয়া ওয়ার্ডের চারবারের নির্বাচিত মেম্বার আব্দুল গফুর ওরফে নাগু মেম্বারকে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা।
এ ঘটনার ৪ ঘন্টার মাথায় টেকনাফ উপজেলা সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি সাবেক ইউপি সদস্য সিরাজুল ইসলামকে নিজ বাড়িতে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। টেকনাফ সদরের পল্লান পাড়ার বাসায় অতর্কিত ঢুকে মুখোশপরিহিত দূর্বৃত্তরা ঘুমন্ত সিরাজুকে গুলি করে পালিয়ে যায়। এসময় তার স্ত্রী ইয়াছমিন আক্তারও গুলিবিদ্ধ হন।
একই ভাবে গত ২২ এপ্রিল টেকনাফে বাড়ীতে ঢুকে দুর্বৃত্তরা গুলি করে মুহাম্মদ হাশেম (৩৫) নামে এক যুবককে খুন করে। রাত সাড়ে ৯ টার দিকে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের হাজমা পাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত হাশেম সদর ইউনিয়নের নাজিরপাড়ার নজির আহমদের ছেলে।
নাগু মেম্বার খুনের ১২ ঘন্টা পার না হতেই ৪ জুলাই বেলা ১০টার দিকে একই ইউনিয়নের প্রবাসী শহিদুল্লাহ (২৯) গুলি ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে খুনের শিকার হয়েছেন। তিনি কুতুবজোম ইউনিয়নের কামিতাপাড়া গ্রামের মো. জহিরুল ইসলাম খলিলের ছেলে। অপরদিকে, গত ১ জুলাই কক্সবাজার শহরের নতুন জেলখানার পেছনের সিকদার ঘোনা এলাকা থেকে কক্সবাজার শহরের দক্ষিণ রুমালিয়ারছড়ার দীল মোহাম্মদের ছেলে মোহাম্মদ ইসমাইলের গুলিবিদ্ধ মরদেহ জেলা কারাগারের অনতিদূরে উত্তরণ আবাসিক এলাকায় পাওয়া গেছে। পরে স্থানীয় লোকজন পুলিশকে খবর দিলে লাশ উদ্ধার করা হয়।
রামুর পাহাড়ি জনপদ ঈদগড়ে ১৫ জুন দুর্বৃত্তের গুলিতে খুন হন শরীফ পাড়ার ফয়েজ আহমদ মিয়াজীর ছেলে গ্রাম্য পশু চিকিৎসক মহি উদ্দিন। নির্মিতব্য একটি বাড়ির ভেতর গভীর রাতে তাকে গুলি করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নেয়ার পথে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৮টায় তিনি মারা যায়। হত্যার ১২ ঘন্টার মাথায়, ঈদগড়ের ছগিরাকাটায় নিজ বাড়ি থেকে অপহৃত হন জিয়া উদ্দিন বাবলু (৩০) নামে এক প্রবাসী। তিনি স্থানীয় কৃষক হাফেজ আহমদের ছেলে। দেন দরবার শেষে এক লাখ টাকা পরিশোধ করার পর শুক্রবার রাত সাড়ে নয়টায় ঈদগড়-বাইশারী সড়কের ব্যাঙডেবা এলাকার পাহাড় থেকে বাবুলকে মুক্তি দেয় অপহরণকারিরা। এমনটি জানিয়েছিলেন ইউপির ছগিরাকাটা এলাকার সদস্য মনিরুজ্জামান।
এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে, ২৫ জুন রাত ৮টারদিকে ঈদগড়-ঈদগাঁও সড়কের হিমছড়ি ঢালায় যাত্রীবাহী বেশ কয়েকটি যানবাহনে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ডাকাতদল যাত্রীদের সর্বস্ব লুটে নিয়ে যাওয়ার সময় এক বাসের ৪ যাত্রী ঈদগড় করলিয়ামুড়া গ্রামের রশিদ আহাম্মদের ছেলে মনিরুল হক খোকন (৩২), ছগিরাকাটা গ্রামের আব্দু জব্বরের ছেলে ছাগল ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন (৪০) ও ব্যাঙডেভা গ্রামের আনছার আলীর ছেলে নবী আলম (৩০) এবং ঈদগাঁওর ইসলামাবাদ খোদাইবাড়ী গ্রামের মৃত ছৈয়দ আহমদের ছেলে ব্যবসায়ী মোহাম্মদ কালুকে অপহরণ করে গভীর জঙ্গলে নিয়ে যায়।
পরে দেন দরবার করে নির্ধারিত পরিমাণ মুক্তিপণ দিয়ে ১২ ঘন্টা, ২৪ ঘন্টা ও ৪৮ ঘন্টাপর অপহৃতরা ঘরে ফিরেছেন।
ঈদগড় আর আর এফ পুলিশ ক্যা¤েপর আইসি মোহাম্মদ হাসেম ডাকাতি ও অপহরণের কথা স্বীকার করে প্রিয় চট্টগ্রামকে বলেছিলেন, রাত ৮ টা পর চলাচল করায় যাত্রীরা দুর্ভোগে পড়েছেন। তাই তিনি রাত ৮টায় পুলিশ ডিউটি চলে আসার পর ঈদগাঁও-ঈদগড় সড়কে যাতায়ত বন্ধ রাখতে যাত্রীদের অনুরোধ জানান।
অপরদিকে, কক্সবাজারের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ানক ঘটনা ঘটে গত ১৩ মে। শুক্রবার টেকনাফ মুচনী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আনসার ব্যারাকে সশস্ত্র দুর্বৃত্তদল হামলা চালিয়ে ক্যাম্পের আনসার কমান্ডার আলী হোসেন (৫৫) কে গুলি করে হত্যা করেন। এসময় হামলাকারিরা আনসারদের ব্যবহৃত ১১টি সরকারি অস্ত্র ও ৬৯০ পিস বুলেট লুট করে নিয়ে যায়। পুলিশ লুন্ঠিত অস্ত্র উদ্ধার কিংবা অপরাধী ধরতে কার্যত ব্যর্থ হয়। দৃশ্যত কোন সফলতা না পেয়ে তারা ক্যাম্প এলাকায় সভা করে বলে আরএসও এ হামলা চালিয়েছে এবং অস্ত্র গুলো মিয়ানমার নিয়ে গেছে। এ তথ্য প্রচারের পর প্রশ্ন উঠে-তাহলে সীমান্ত প্রহরায় বিজিবি কি ব্যর্থ? না হলে লুণ্ঠিত এসব অস্ত্র মিয়ানমার যায় কিভাবে? তবে পরবর্তীতে র‌্যাব-৭ আনসার ক্যাম্প লুটের ঘটনায় ৩০ জুন ৫জনকে আটক করে। তাদের মাঝে দু’জন আরএসও সদস্য রয়েছে বলে সেদিন জানানো হয়।
যেদিন এসব রোহিঙ্গাদের আটক করা হয়, সেদিন কক্সবাজারের রামুর ঈদগড়ের সীমান্তবর্তী ইউনিয়ন নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারীতে ওয়ার্ড আওয়ামীলীগ সহ-সভাপতি মং শৈহ্লা মারমা (৫৫) কে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। রাত ১০ টার দিকে বাইশারী বাজারের উত্তর পাশে ইউনিয়ন পরিষদ এলাকায় হত্যার ঘটনা ঘটে। এর আগে, ১৪ মে একই এলাকার উপরশাখ পাড়ায় উ গাইন্দ্যা (৭০) নামের এক বৌদ্ধ ভিক্ষুকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ভিক্ষু হওয়ার আগে তার নাম ছিলো, মং শৈ উ চাক। গ্রাম থেকে একটু দূরের বিহারে একাই থাকতেন তিনি।
গত ১৪ জুন কক্সবাজার সদরের ইসলামাবাদ শাহফকির বাজার এলাকায় এক সালিশ বৈঠকে মুখোশধারী দুর্বৃত্তরা গুলি চালিয়েছে খুন করে সদ্য প্রবাস ফেরত আবছার কামাল (৩৫) কে। তিনি সদরের উপকূলীয় ভারুয়াখালীর হাজিপাড়ার নজির আহমদের ছেলে। রাত পৌনে ১২ টার দিকে এ হামলার ঘটনা ঘটেছে।
চকরিয়ায় গত ২ জুলাই শবে কদরের রাতে ফরিদুল আলম নামের এক ঠিকাদারের বাড়ির দরজায় কলিং বেল টিপে ভেতরে ঢুকে একদল সশস্ত্র ডাকাত অস্ত্রের মূখে লুটে নিয়ে গেছে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা। রাত সাড়ে ৯টার দিকে উপজেলার লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের জিদ্দাবাজার এলাকায় ঘটেছে এ ঘটনা। একই কায়দায় চকরিয়া পৌর শহরের হাসপাতাল পাড়ার মা ভবনের মালিক সৌদি প্রবাসী মাহবুবের বাড়ীতে মুখোশ পরিহিত সশস্ত্র ডাকাতদল হানা দেন ঈদের দিন সকালে পরিবারের সকল সদস্যকে অস্ত্রের মূখে জিম্মি করে রুমে আটকিয়ে রেখে নগদ ২ লাখ টাকা ২৫ ভরি স্বর্ণালংকার বাড়ীর মূল্যবান জিনিস পত্র নিয়ে চম্পট দেয়।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্বৃত্ত কর্তৃক এসব হত্যা ও ডাকাতি এবং অপহরণ ঘটনা ছাড়াও পারিবারিক কলহে খুন হয়েছেন আরো কয়েকজন। ঘটেছে ছিনতাই এবং অপরাধ মূলক নানা ঘটনা। যা সাধারণ মানুষকে আতংকিত করে রেখেছে। জেলার ক্রমে বাড়তে থাকা অপরাধ সম্পর্কে জেলাবাসীর মনে আতংক এবং পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সচেতন সবার মনে ক্ষোভ বিরাজ করছে। তবে এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে অনেক সমাজ সচেতন ব্যক্তিও নাম প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে অস্বীকৃতি জানান। তাদের মতে পুলিশের কর্মকান্ড ও অপরাধ লালন নিয়ে ওপেন কথা বললে যেকোন মুহুর্তে খড়গ আসতে পারে। সময়টা ভাল যাচ্ছে না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, অনেক থানা ও তদন্ত কেন্দ্রের পুলিশের সাথে এলাকার অপরাধ নিয়ন্ত্রকারির ‘দহরম’ সম্পর্ক রয়েছে। যেকোন অপরাধের পর তাদের মাধ্যমে অপরাধির পক্ষ হয়ে তদবির করার কারণে আড়াল থেকে যায় অপরাধ কর্ম। যা পুরো জেলার আট উপজেলাতেই বিদ্ধমান। ক্ষেত্র বিশেষে জেলা পুলিশের কর্তা ব্যক্তির সাথেও অপরাধীর গড়ফাদার ও নিকটাত্মীয়রা ‘উষ্ণ’ সম্পর্ক বজায় রাখেন। তাই সব ধরণের অপরাধী বীরদর্পে অপকর্ম করে ছাড় পাচ্ছে।
এসব বিষয় চিন্তা করে আইনশৃংঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথের সু-দৃষ্টি কামনা করেছেন সচেতন মহল।


শেয়ার করুন