থামছে না পাসপোর্ট কার্যালয়ের দুর্নীতি

‘ঘাটে ঘাটে’ টাকা দেন শওকত কামাল

Shawkatশাহেদ ইমরান মিজান, সিটিএন:
‘দালালমুক্ত’ হয়েছে! দুর্নীতির তদন্তও হয়েছে। কিন্তু চিত্র সেই আগের মতোই। বরং অনেক ক্ষেত্রে বেড়েছে এর মাত্রা। বলা হচ্ছে কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ের কথা। যেখানে পেটের দায়ে বিদেশ গমনেচ্ছুক খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ দিনের পর দিন, বছরের পর অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার। আগামীতেও কোন ভরসা হবে না এই বিদেশ গমনেচ্ছুকদের। কেননা সেই দুর্নীতির কুশলীবদের কিছু হচ্ছে, হবেও না! তারা উচ্চ বাবুদের আশির্বাদপুষ্ট হয়ে টিকে আছে, টিকে থাকবে। বহালতবিয়তে লুটে যাবে কোটি কোটি টাকা। দীর্ঘ অনুসন্ধানে কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ের এমন চিত্রই খুঁজে পাওয়া গেছে।
দীর্ঘদিন ধরে পাসপোর্ট কার্যালয়ের কর্মকর্তা আর দালাল চক্র মিলে পাসপোর্ট বানানো সাধারণ মানুষের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। কিন্তু ভাগবাটোয়ারা নিয়ে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে এখন দৃশ্যমান কোন দালাল নেই! তবে রাহুমুক্ত হয়নি জনগুরুত্বপূর্ণ এই সরকারি দপ্তরটি। এখন দালাল না থাকলেও অনিয়ম থেকে নিস্তার পাচ্ছে না সেবাপ্রার্থীরা। দালালচক্র না নিলেও এজেন্ট পদ্ধতিতে ঠিক সব টাকা পকেটস্থ করছে অসাধু কর্মকর্তারা।
খোঁজ নিয়ে গেছে, গত ১ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ের দুর্নীতির তদন্তে আসেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় টিম। সেই সময় ভুক্তভোগী ও সাধারণ মানুষের জবানবন্দীতে দুর্নীতি সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ হয়ে যায়। সেই সময় অভিযুক্ত হন বতর্মান সহকারী পরিচালকের দায়িত্বেরত শওকত কামাল ও সদ্য শাস্তিমূলক বদলী হওয়া প্রধান সহকারী আবু হেনা মোস্তফা কামাল। কিন্তু ‘যে লাউ সে কদু’। সে সময় অভিযোগ উঠে তদন্ত টিমের প্রধান কর্মকর্তা আবু সাইদ মোটা অংকের টাকায় ম্যানেজ হয়ে যায়। তাকে ম্যানেজ করতে শওকত কামাল কেন্দ্র থেকে স্থানীয় পর্যায়ে অনেক রাঘব বোয়ালকে ব্যবহার করেছেন। তাই ভুক্তভোগীদের আশ্বস্ত করে গেলেও শওকত কামালসহ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি তদন্ত টিম। বরং শওকত কামালের সাথে মাসোহারার চুক্তি করে যান তদন্ত টিমের প্রধান কর্মকর্তা আবু সাইদ- এমন অভিযোগ সবর্ত্র। তাই এখনো থামেনি বহুল আলোচিত পাসপোর্ট কার্যালয়ের দুর্নীতি।
অনুসন্ধান ও সরেজমিন ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিনের অনিয়ম-দুর্নীতির এখনো বিরাজমান রয়েছে পাসপোর্ট কার্যালয়ে। অনেক ক্ষেত্রে অনিয়মের মাত্রা বেড়েছে- এমনটি চিত্র দেখা গেছে।
সুত্র মতে, একটি পাসপোর্ট বানাতে ব্যাংকে জমা দিতে হতো ৩ হাজার টাকা। ৩ হাজার টাকার সময়ে একটি পাসপোর্টের বিপরীতে অতিরিক্ত গুণতে হতো আরো ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। এই টাকা থেকে চ্যানেল ফি নামে পাসপোর্ট কার্যালয়ের কর্মকর্তারা নিতো ১২০০ টাকা, ভেরিফিকেশন জন্য ডিসবি পুলিশ সদ্যরা নিতো ১ হাজার ৫০০ টাকা। অবশিষ্ট টাকা চলে যেত দালালের পকেটে। বর্তমানে ব্যাংক ফি ৩ হাজার ৪৫০ উন্নীত করা হয়েছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ঘুষের টাকাও। সেবাপ্রার্থীকে ঘুষের আগের ৩ হাজার স্থলে এখন গুণতে হচ্ছে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত। পাসপোর্ট অফিস ‘দালালমুক্ত’ হওয়ায় দালালদের বাদ দিয়ে এখন এই ৪ হাজার টাকাই ভাগাভাগি করে নিচ্ছে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশে অনেক পাসপোর্ট আবেদনকারী ঘুষ নেয়ার অভিযোগ করেছেন।
সব কিছুর দেখভাল করছে সহকারী পরিচালকের দায়িত্বে থাকা শওকত কামাল। তার কঠোর সহযোগী হিসেবে রয়েছেন ডাটা এন্ট্রি অপারেটর রাসেল মাহমুদ চৌধুরী। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গা, দাগী অপরাধীসহ অবৈধ লোকজনকে পাসপোর্ট করে দিচ্ছে বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
অভিযোগ রয়েছে, শওকত কামাল নিজেকে চট্টগ্রাম মেয়র আ.জ.ম নাসির উদ্দীনের কাছের মানুষ বলে দাবী করেন। অন্যদিকে রাসেল মাহমুদ চৌধুরী নিজেকে সুমন নামে এক সাবেক কেন্দ্র্রীয় ছাত্রলীগের নেতার মামা দাবী করে দাপট দেখান। তারা এসব কথা বলে বীরদর্পে বিচরণ করছে। তারা দু’জন হুংকার দিয়ে বলে ‘আমরা কি জিনিস তা কক্সবাজারের মানুষকে দেখিয়ে ছাড়বো’।
‘ঘাটে ঘাটে’ টাকা দেন শওকত কামাল: এত আন্দোলন-সংগ্রামের পরও কেন পাসপোর্ট কার্যালয় দুর্নীতিমুক্ত হয়নি তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য! বেরিয়ে এসেছে শওকত কামাল দুর্নীতিকে ঢাকা দিতে ‘ঘাটে ঘাটে’ টাকা বিলি করেন। রাজনৈতিক নেতা, একশ্রেণির কথিত সাংবাদিক ও প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের লোকজনকে মাসিক ভিত্তিতে নির্দিষ্ট হারে টাকা বিলি করেন তিনি। এই তালিকায় রয়েছে কক্সবাজারের কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনীতিক। প্রশাসনের উচ্চ পর্যায় কয়েকজন কর্মকর্তাকে টাকা দেয়া হয়। চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট কর্মকর্তাকেও দেয়া হয় টাকা। এছাড়া পাসপোর্টের কেন্দ্রীয় দপ্তর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তরেরও দেন মোটা অংকের টাকা। এসব স্থলে টাকা দিয়ে বহাল তবিয়তে দুর্নীতি করে যাচ্ছে শওকত কামাল।
অনিয়ম যখন নিয়ম: ২০০৯ সালে কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকে অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয় কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়। কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ যোগসাজসে একশ্রেণীর বখাটে টাইপের লোকজন পাসপোর্ট বানিয়ে দেয়ার বদৌলতে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার আয়োজন শুরু করে। এর বিরুদ্ধে অনেক প্রতিবাদ হলে তা থামানো তো যায়নি বরং এই অনিয়ম প্রক্রিয়া বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। অনেক সময় অনিয়মের দায়ে কর্মকর্তারা বদলী হলেও রোধ হয়নি অনিয়ম। এক পর্যায়ে এই গুরুতর অনিয়ম নিয়মেই দাঁড়িয়ে গেছে। এই নিয়ম ভাঙার কোন প্রক্রিয়া নেই। বর্তমান সহকারী পরিচালকে দায়িত্বে থাকা শওকত কামাল টাকার বিনিময়ে অনিয়মকে নিয়মের কাঠামো বন্দি রেখেছেন।
এ ব্যাপারে জানতে অভিযুক্ত শওকত কামালের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করেও তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
জেলা প্রশাসক মো: আলী হোসেন বলেন, ‘আমি কালকেই (আজ) সে ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’
উল্লেখ্য, কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে সারাবছর প্রকাশ্যে ঘুষের লেনদেন চলে । এর ফলে বিদেশগমণে ইচ্ছুক সাধারণ মানুষ পাসপোর্ট করতে গিয়ে সবসময় ভোগান্তির শিকার হয়। অনেক সময় টাকা দিলেও মিলছে না পাসপোর্ট নামের সোনার হরিণ।


শেয়ার করুন