গান্ধী পুত্র কেন ইসলাম গ্রহন করলেন 

3473_1সিটিএন ডেস্ক :

মানব ইতিহাসের শুরু থেকেই খ্যাতনামা পিতার বিদ্রোহী সন্তানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এই উপমহাদেশের দুই মহানায়ক করমচাঁদ (মহাত্মা) গান্ধী এবং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহও এর ব্যতিক্রম নয়।

পিতার বিরুদ্ধে গান্ধীর পুত্রের বিদ্রোহী বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। বিষয়টি গান্ধীকে কিছু সময়ের জন্য হলেও বেশ বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছিল। তবে এখন তা বিস্মৃত অধ্যায়।

গান্ধীর বড় ছেলে হরিলাল ছিলেন সত্যিই একটি বিদ্রোহী সত্তা। তিনি একজন পিতা ও একজন সংস্কারক হিসেবে গান্ধীর কাজে মারাত্মক ত্র“টি রয়েছে বলে জানিয়েছেন। তিনি শুধু গান্ধীকে তার সন্তানদের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন ও পিতার কর্তব্য পালনে ব্যর্থতার অভিযোগই আনেননি, সেই সাথে তিনি যে আদর্শ প্রচার করছেন তার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তিনি আলাদা রাস্তা বেছে নিয়েছিলেন।
এই বিদ্রোহী সম্পর্কের ব্যাপারে গান্ধীর নাতি (অর্থাৎ হরিলালের ভাইয়ের ছেলে) রামচন্দ্র গান্ধী বলেছেন, হরিলাল অন্য ব্যক্তিদের সন্তানদের প্রতি বাপুর অনুভূতির ব্যাপারটি বুঝতে পারেননি, যেমন নাথুরাম গডসে বুঝতে পারেনি দেশ ভাগের পর মুসলমান সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে গান্ধীর উদ্বেগের বিষয়টি।

রামচন্দ্রের এই বক্তব্যে কিছুটা সত্যতা রয়েছে। তবে হরিলালকে গডসের সাথে তুলনা করা শুধু অন্যায়ই নয়, অমানবিকও বটে। গডসের থেকে হরিলাল সব দিক থেকেই ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন।

পিতার বিরুদ্ধে হরিলালের বিদ্রোহের সূচনাটিকে অযৌক্তিক বলা যায় না। তিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য অত্যন্ত যৌক্তিকভাবেই পিতার কাছ থেকে সাহায্যের আশা করেছিলেন। কিন্তু নিজের তৈরি করা আদর্শের প্রতি অটল গান্ধী সিদ্ধান্ত নিলেন সেই অর্থ তার পরিবারের উন্নতির জন্য নয়, জনগণের কল্যাণে ব্যয় হওয়া উচিত। তাই তিনি হরিলালের অনুরোধ অগ্রাহ্য করলেন ও উচ্চশিক্ষার জন্য জনৈক পারসি যুবককে লন্ডন পাঠালেন। পিতা ও পুত্রের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টির এটাই মূল কারণ। হরিলাল এটাকে তার প্রতি একটা মারাত্মক অবিচার হিসেবে বিবেচনা করলেন এবং তা থেকেই তিনি গান্ধীর পুরো মিশনারি কর্মসূচির বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন তুলতে থাকলেন।

পিতা-পুত্রের মতভেদসহ বিস্তারিত বিষয় নিয়ে চান্দু লাল দালাল মারাঠি ভাষায় একটি গ্রন্থ লিখেছেন। গ্রন্থটি ইংরেজিতেও (Harilal Lal Gandhi: A life) অনুবাদ হয়েছে। গ্রন্থকার বস্তুনিষ্ঠভাবে পিতা-পুত্রের অবস্থান তুলে ধরেছেন। গান্ধীর ভক্ত হওয়া সত্ত্বেও তিনি বিদ্রোহী পুত্র সম্পর্কে কোনো বিরূপ ধারণা প্রকাশ করেননি।

ওই গ্রন্থে পিতাকে লেখা হরিলালের একটি বেশ বড় পত্র অন্তর্ভ্ক্তু করা হয়েছে। এখানে দক্ষিণ আফ্রিকায় ফনিক্স ইনস্টিটিউট নামে আশ্রম প্রতিষ্ঠায় গান্ধীর প্রথম পরীক্ষার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। গান্ধীর লক্ষ্য ছিল আশ্রমের অধিবাসীরা সন্ন্যাস জীবন অনুসরণ করবে। হরিলাল লিখেন, ‘আমি ফনিক্স ইনস্টিটিউট থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি, কারণ আমি সেখানে কপটতা দেখেছি…। অন্যরা তাকে… বলায় কেউই সন্ন্যাসী হয়ে যায়নি। আমি বিশ্বাস করি না লবণবিহীন খাবার কিংবা ঘি বা দুধ গ্রহণ থেকে বিরত থাকলে চরিত্র বা নৈতিকতা উন্নত হয়ে যায়।’

পরিশেষে তিনি গান্ধীর বিরুদ্ধে অভিযোগনামা উত্থাপন করেছেন : ‘আপনি কখনো আমাদের অধিকার এবং সামর্থ্যকে বিবেচনা করেননি। আপনি কখনো আমাদের ভেতরের সত্তাকে দেখতে পাননি।’ এই প্রতিবাদের পর হরিলাল সম্পর্কচ্ছেদ করে তার পিতার কাছ থেকে চলে যান এবং ভবঘুরেতে পরিণত হন। তার ভাই জানান, ‘সে দেশের চার দিকে ঘুরতে লাগল এবং মারাত্মক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়।’
আরো অনেক কিছুর মতো গান্ধী তার আত্মজীবনীতেও কিছুটা হলেও বিষয়টি সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। তিনি তার ছেলেদের পড়াশোনা সম্পর্কে লিখেন : ‘তাদের অক্ষরজ্ঞানের ব্যাপারে আমি উদাসীন ছিলাম, এ কথা বলতে পারি না। তবে তা ত্যাগ করতেও আমার সঙ্কোচ ছিল না। এই অসম্পূর্ণতার জন্য আমার ছেলেরা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারে।

বস্তুত তারা কয়েকবার নিজেদের অসন্তোষ প্রকাশও করেছে। এ বিষয়ে কিছুটা আমার নিজের দোষ স্বীকার করতে হয় তাও মানি। তাদের পুঁথিগত বিদ্যা দেয়ার ইচ্ছা আমার খুবই ছিল চেষ্টাও করতাম। কিন্তু এই কাজে সব সময় কোনো না কোনো বাধা এসে পড়ত। ফলে ঘরে আর দ্বিতীয় কোনো প্রকারে লেখাপড়ার ব্যবস্থা না হওয়ায় তাদের আমি আমার সাথে হাঁটিয়ে অফিসে নিয়ে যেতাম। অফিস ছিল আড়াই মাইল দূরে। এতে সকাল-সন্ধ্যায় তাদের ও আমার কমপক্ষে পাঁচ মাইল হাঁটার পরিশ্রম হতো। রাস্তায় চলতে চলতে তাদের কিছু শেখানোর চেষ্টা করতাম, তবে সেটাও হতো আমার সাথে অন্য কেউ না থাকলে। অফিসে তারা মক্কেল ও মুহুরিদের সংস্পর্শে আসত। তাদের যদি কিছু পড়তে দেয়া হতো, তবে পড়ত। বাজারে সামান্য কিছু কেনাকাটা করতে হলে তা করত। সবার বড় হরিলাল ছাড়া সব ছেলেই এ রকম গড়ে ওঠে। হরিলাল দেশেই থেকে গিয়েছিল। যদি আমি তাদের গ্রন্থপাঠে সাহায্য করার জন্য এক ঘণ্টা করেও সময় দিতে পারতাম, তবে তাদের আদর্শ শিক্ষা দেয়া হয়েছে বলা যেত। ওই কাজ আমি করিনি, এ জন্য আমার ও তাদের দুঃখ রয়ে গেছে। সবার বড় ছেলে এ বিষয়ে তার অভিযোগ অনেকবার আমার কাছে ও প্রকাশ্যে করেছে। অন্যরা হৃদয়ের উদারতা দিয়ে সেই ত্র“টি অনিবার্য বুঝে ক্ষমা করেছে। এই অসম্পূর্ণতার জন্য আমার অনুশোচনা নেই। আর যদি থাকেও তবে তা এটুকু যে, আমি আদর্শ পিতা হইনি।

আমার এ কথা বলার উদ্দেশ্য এই, তাদের পুঁথিপড়া বিদ্যার বলিদান আমার অজ্ঞানবশত হয়েছে, কিন্তু সৎভাবে আমি যা সেবাকাজ মনে করেছি, এই বলিদান হয়েছে তারই কাছে। তাদের চরিত্র গড়ে তোলার জন্য আমি কোনো ত্র“টি করিনি। চরিত্র গঠন প্রত্যেক পিতা-মাতার পক্ষে অনিবার্য ও বাধ্যতামূলক কাজ বলে আমি মনে করি। আমার চেষ্টা সত্ত্বেও আমার ওই ছেলেদের চরিত্রে যে ত্র“টি দেখতে পাওয়া যায়, তা আমাদের স্বামী-স্ত্রীর ত্র“টির প্রতিফলন এটাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।’

পিতার সাথে বিচ্ছিন্নতার পর হতাশায় হরিলাল অ্যালকোহলে আসক্ত এবং নৈতিক অবক্ষয়ের শিকার হন। তার পর এক সময়ে হিন্দু ধর্মের প্রতি তার ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং তিনি ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৩৬ সালের ১৪ মে বোম্বাইয়ের জামে মসজিদে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। এ ঘটনায় বেশ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। গান্ধী পরিবারের কাছে এটা ছিল দুঃসংবাদ। কিন্তু গান্ধী ভিন্ন পন্থায় তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। মুসলমানদের উদ্দেশে তিনি তার বিবৃতিতে বলেন, ‘যদি তার এই গ্রহণ হৃদয় থেকে এবং জাগতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে হয়ে থাকে, তবে আমার মধ্যে কোনো বিরূপতা থাকবে না। কারণ আমি বিশ্বাস করি ইসলাম আমার নিজেদের মতোই একটি সত্য ধর্ম।’

গান্ধী তারপর তার পুত্রের নৈতিক অবক্ষয় এবং তার অ্যালকোহল আসক্তির কথা বলেন। তিনি মুসলমান সম্প্রদায়ের কাছে তার বার্তার শেষ দিকে বলেন, যদি তারা দেখতে পায় এই ধর্মান্তর সত্যিকারের নয় এবং যদি ‘সে আগের মতোই খারাপ থাকে’, তবে তাদের উচিত তাকে প্রত্যাখ্যান করা। তবে মুসলমানদের এমন কিছু করার প্রয়োজন পড়েনি। হরিলাল নিজেই কিছুদিন পর তার নতুন বিশ্বাসকে বিদায় জানান এবং শ্রদ্ধানন্দ শুদ্ধি সভার একজন মিশনারিতে পরিণত হন।

পরবর্তীকালে দেবদাস জানান, ‘বাপু নিহত হওয়ার চার দিন পর আমাদের দুঃখের ভাগি হতে তিনি (হরিলাল) হঠাৎ করে, কেউ জানে না কোথা থেকে, দিল্লিতে আমাদের বাসায় এলেন।’ তবে শিগগিরই তিনি ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বোম্বাইগামী একটি ট্রেনে ওঠার সময়ে তিনি দেবদাসকে দুর্বল কণ্ঠে বলেন, ‘আমার নিয়তি হচ্ছে ভবঘুরে থাকা।’

তবে এবার আর তিনি বেশি দিন ভবঘুরে অবস্থায় থাকতে পারেননি। তার পিতা মারা যাওয়ার পর বিদ্রোহী পুত্রও বেশি দিন বেঁচে থাকেননি। গান্ধী নিহত হওয়ার ১৮ দিন পর ১৯৪৮ সালের ১৮ জুন বোম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে তিনি মারা যান। রেখে যান দুই কন্যা (তার ছোট মেয়ে মনুকে গান্ধী নিজের হাতে গড়ে তুলেছিলেন এবং তাকে তিনি সব সময় সাথে রাখতেন)।


শেয়ার করুন