জাতিসঙ্ঘের তথ্যানুসন্ধান মিশন আসছে

গণহত্যার উপাত্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেবে বাংলাদেশ

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান গণহত্যা ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনের প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত দিয়ে তদন্তে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সহায়তা করবে বাংলাদেশ। এ লক্ষ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ (ইইউ) বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সমর্থনে রাখাইন রাজ্যের সহিংসতা তদন্তে জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের তথ্যানুসন্ধান মিশনকে স্বাগত জানিয়েছে সরকার। আগামী কিছুদিনের মধ্যে তথ্যানুসন্ধান মিশনটি জেনেভা থেকে ঢাকা আসবে।
এদিকে রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর চলমান অভিযানে নির্বিচার বলপ্রয়োগের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূলের চেষ্টা চলছে বলে মনে করেন জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার জাইদ বিন রাদ আল-হুসাইন।
আজ সোমবার জেনেভায় জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের এক সভায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে নৃশংস অভিযানের তীব্র নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, গত মাসে নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্পে বিদ্রোহীদের হামলার পাল্টা হিসাবে যে অভিযান চলছে তা স্পষ্টতই বাড়াবাড়ি। রাখাইনে গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের খবরের মধ্যে দুই লাখ ৭০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। আরো অনেকে সীমান্তে আটকা পড়েছে। এ পরিস্থিতিকে ‘জাতিগোষ্ঠী নির্মূল’ অভিযানের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ বলেই মনে হচ্ছে।
মিয়ানমার সরকারকে চলমান নৃশংস অভিযান বন্ধ করার পাশাপাশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর জন্য জবাবদিহির আহ্বান জানিয়ে হাইকমিশনার বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গুরুতর ও সুদূরপ্রসারী বৈষম্যের অবসান ঘটাতে হবে।
গত অক্টোবরের পর রাখাইনে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্তের জন্য ২৪ মার্চ জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা কাউন্সিলে একটি প্রস্তাব পাসের মাধ্যমে স্বাধীন আন্তর্জাতিক তথ্যানুসন্ধান মিশন গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মানবাধিকার কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ইন্দোনেশিয়ার নাগরিক মারজুকি দারুসমানকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি মিশন গঠন করেন। মিশনের অন্য দুই সদস্য অস্ট্রেলিয়া ও শ্রীলঙ্কার নাগরিক। তারা প্রত্যেকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্তের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। কিন্তু মিশনটি গঠনের পর মিয়ানমার তাদের রাখাইন রাজ্যে তদন্ত চালানোর জন্য ভিসা দেয়নি। এ কারণে মিশনের প্রক্রিয়া থমকে যায়। গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর নতুন করে চালানো সহিংসতায় বাংলাদেশ অভিমুখে রোহিঙ্গাদের যে ঢল নামে, তা নজীরবিহীন। অক্টোবরে চালানো অভিযানের পর আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) হিসাবে অনুযায়ী ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। কিন্তু ২৫ আগস্টের পর মাত্র দুই সপ্তাহে তিন লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এবারের সহিংসতা অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় ভয়াবহ বলে স্বীকার করছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
চলতি মাসে নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ অধিবেশনে জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের তথ্যানুসন্ধান মিশনটি অন্তবর্তীকালীন প্রতিবেদন দেবে। আর ২০১৮ সালে দেবে চূড়ান্ত প্রতিবেদন। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধ ও রাখাইনে অবিলম্বে মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করতে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে গত শনিবার জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ৪০টি মানবাধিকার সংগঠন।
মিয়ানমারে গণহত্যা চলছে
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চলমান দমন অভিযানকে ‘গণহত্যা’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক।
আজ কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, গণহত্যার বিচারে আন্তর্জাতিক মহলের উদ্যোগ জরুরি। অন্যথায় আন্তর্জাতিক কোর্ট অফ জাস্টিজে মিয়ানমারের বিচার করার উদ্যোগ নিতে হবে।
মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা নিজেদের নৃশংসতার চিত্র মুছে ফেলতে নিহত রোহিঙ্গাদের লাশ গুম করছে। তারা আগুনে পুড়িয়ে, মাটিতে পুঁতে ও নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে রোহিঙ্গাদের লাশের চিহ্ন মুছে দিতে চাইছে, যাতে পরবর্তীতে বিশ্বের কেউ এসে এর প্রমাণ না পায়। উখিয়ায় অনুপ্রবেশকারী অনেক রোহিঙ্গা এই দাবি করেছেন।
ইউএনএইচসিআরের অ্যাসিস্ট্যান্ট হাইকমিশনার কাল আসছেন
জাতিসঙ্ঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) কার্যালয়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট হাইকমিশনার জর্জ অকোথ-উবু তিনদিনের সফরে আগামীকাল মঙ্গলবার ঢাকা আসছেন। তিনি কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করবেন এবং সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করবেন। এতে নতুন আসা রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের সামাল দেয়ার উপায় খোঁজা হবে।
জর্জ অকোথ-উবু আগামী শুক্রবার রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আলোচনার অংশ হিসেবে থাইল্যান্ড যাবেন। যেখানে জাতিসঙ্ঘের মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন। জাতিসঙ্ঘের সংস্থাগুলো সন্ত্রাসবাদীদের উষ্কানি দিচ্ছে – মিয়ানমারের এ অভিযোগের পর অন্যান্য সংস্থার পাশাপাশি মিয়ানমারে নিযুক্ত ইউএনএইচসিআরের কর্মীদের পার্শবর্তী দেশ থাইল্যান্ডে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বর্তমানে এর বিকল্প হিসেবে মিয়ানমারে কাজ করছে আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি (আইসিআরসি)।
রাখাইনে সহিংসতার হাত থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে আসা নতুন তিন লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের সহায়তার জন্য জাতিসঙ্ঘ গত শনিবার ৭৭ মিলিয়ন ডলার সহায়তা চেয়েছে।


শেয়ার করুন