গণতান্ত্রিক রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা

এম আবদুল হাফিজ

মঈনুদ্দীন-ফখরুদ্দীনের অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার মহাজোট তথা আওয়ামী লীগের ‘আন্দোলনের ফসল’ হলেও তা ঠিকই বুঝেছিল যে দুই নেত্রীর কাজিয়া-ফ্যাসাদই বাংলাদেশের সব সম্ভাবনাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। অতএব ‘জরুরি অবস্থা’ প্রদত্ত ক্ষমতা যখন হাতে রয়েছে- এখনই সময় দেশের রাজনীতি থেকে এই অনাকাক্সিক্ষত পরগাছাকে ছেঁটে ফেলার। ‘অপারেশন মাইনাস টু’কে ইনিয়েবিনিয়ে নানা কথার আস্তরণ দিয়ে জাতির কাছে গ্রহণযোগ্য করার সব উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা একই সমান্তরালে চলতে থাকল। যারা ভিন্নমত প্রকাশ করল, ‘জরুরি অবস্থার’ চাবুক দিয়ে তাদের নিরস্ত করা হলো।
কিন্তু গোড়ায়ই কৌশলে ভুল ছিল কুখ্যাত এই ‘অপারেশন মাইনাস টু’তে। সামরিক বাহিনীর যুদ্ধের মতো রাজনীতির যুদ্ধেও প্রতিপক্ষকে একাধিক অংশে বিভক্ত করতে হয়। সেটা না করেই ওই সরকার আমাদের রাজনীতির সম্মিলিত শক্তির বিরুদ্ধেই আলোচ্য অপারেশনটি চালিয়েছিল। ফলে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলোকেও তাদের মোকাবিলা করতে হয়েছিল। অগত্যা মঈনুদ্দীন-ফখরুদ্দীন সরকারকে তাদের লক্ষ্য অর্জন ছাড়াই রণে ভঙ্গ দিতে হয়েছিল।
বর্তমানের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাসম্পন্ন আওয়ামী লীগ আগামী দিনে ক্ষমতার সমীকরণ সম্পর্কে কী ভাবছে? তারাও কি কোনো ‘মাইনাস টু’সদৃশ অপারেশন হাতে নিতে ইচ্ছুক? কেন নয়? এখনকার মতো ক্ষমতা তো দলটির হাতে বারবার আসবে না। তাই তাদের স্বপ্নসাধকে স্থায়িত্ব দিতে এখনই তো সময়। আগামী দিনে সে সুযোগ আর না-ও আসতে পারে। নাউ অর নেভার!
তবে এবার আর মাইনাস টু নয়, সরাসরি অপারেশন ‘খালেদা বধ’। অবশ্য এমন একটি অপারেশনের প্রাথমিক প্রস্তুতি অনেক আগেই আরম্ভ হয়েছে। এ প্রস্তুতিরই আভাস আমরা দেখি সরকারের অনেক ক্ষেত্রে অযৌক্তিক হার্ডলাইন এবং বিএনপির ‘সহিংসতায়’ পুলিশ-র‌্যাবের ‘জিরো টলারেন্সে’। সরকারের মন্ত্রী-পাতিমন্ত্রীদের মুখ থেকে এমন সব কথা ফসকে বেরিয়ে আসে, যা একটি প্রতিপক্ষের জন্য চূড়ান্ত আঘাত হানার ইঙ্গিত বহন করে। যদিও সেসব উক্তি রাজনৈতিক শিষ্টাচারসম্মত নয়। কিন্তু একটি রাজনৈতিক দল বা জোট যখন একটি স্থায়ী বন্দোবস্তের দিকে এগোতে থাকে, তখন তার এসব বোধশক্তি থাকে না। কী করে লক্ষ্য অর্জিত হবে, সেটাই তখন তার ধ্যান ও জ্ঞান। এরই কিছু কিছু প্রকাশ ঘটে অসতর্ক মুহূর্তের অসতর্ক আচরণ ও উক্তিতে। তা না হলে একজন এইচ টি ইমাম সাহেব কেন হার্ডলাইন বা জিরো টলারেন্সের গোমর ফাঁস করে দিলেন। তিনি বলেছেন যে এখন খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি বিবেচনায় আনা উচিত। তিনি সেই বঙ্গবন্ধু আমল থেকে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও নীতিনির্ধারক।
তাহলে কি বিএনপির এত দিনকার আন্দোলন ও তার ‘সহিংসতা’ রোধে মহাজোটের হার্ডলাইন ও জিরো টলারেন্স একই সুতোয় গাঁথা। সরকারের কিছু কিছু মন্ত্রী বলছেন শুধু আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের কথা। শক্তি প্রয়োগ ছাড়াও আপস নিষ্পত্তি বা সংলাপজাতীয় অন্য কোনো বিকল্পের কথাই ক্ষমতাসীনরা আমলে নিচ্ছেন না। বিএনপি সংলাপের কথা বললেও মন্ত্রী মহোদয়দের অবস্থান তার উল্টো। তাঁরা বলছেন : কিসের সংলাপ? কার সঙ্গে সংলাপ? সংলাপের সব সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে তাঁরা বলছেন : কেয়ামত পর্যন্ত কোনো সংলাপ হবে না।
গণতান্ত্রিক রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা
কেননা সংলাপ-সমঝোতা তো পারস্পরিক ‘ছাড়ের’ ওপর নির্ভরশীল। ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতার ‘লাড্ডু’তে কাউকে ভাগ বসাতে দিতে চান না। প্রধানমন্ত্রী এসব ব্যাপারে একেবারেই মুখ খোলেন না। তাঁর ‘পারিষ“লই’ এসব কথা বলে এবং পথের প্রতিবন্ধক বিএনপিকে ঘায়েল করে। তবে প্রধানমন্ত্রীর ‘কটাক্ষবাণ’ অব্যর্থ। তিনি তা সরাসরি খালেদা জিয়াকে তাক করেই ছোড়েন। দেশবাসী এতে আহত হয়, বেদনা বোধ করে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে ঘরে ফেরার কথা বলে টিপ্পনী কাটছেন। ঘরপলানি বলেছেন। খালেদা নাকি অভিনেত্রী হতে জিয়ার সঙ্গে পালিয়েছিলেন। এত দিন এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য কিভাবে চাপা ছিল? তবে জাতি ও জনগণ এটুকু জানত যে খালেদা জিয়া স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য স্বামীর সহযাত্রী হননি। কেন হননি, তা যে কারো জন্য ব্যক্তিগত ব্যাপার। মানুষের তো হাজারো দৈহিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণ থাকতে পারে। তাই অল্প লোকই অপরের এসব খুঁটিনাটি নিয়ে মাথা ঘামায়। তবে তিনি ‘মির্জা আসলাম বেগের’ সঙ্গে অধিকৃত বাংলাদেশেই রয়ে গিয়েছিলেন বলে যে তথ্য প্রকাশ করেছেন, তা আমার কাছে অভিনব। ষাটের দশকের গোড়ার দিকে মেজর আসলাম বেগ তৎকালীন কুমিল্লা ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর (বিএম) ছিলেন। প্রয়াত পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুস্তাফিজুর রহমান তাঁর তৃতীয় গ্রেডের স্টাফ অফিসার ছিলেন। বার্ষিক রেঞ্জ শ্যুটিংয়ের জন্য একবার কুমিল্লায় গেলে তখনকার ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজ প্রদত্ত একটি নৈশভোজে আমন্ত্রিত হয়ে তাঁর বাসভবনে গিয়ে সেখানে মেজর আসলাম বেগকে (পরবর্তী সময় জেনারেল বেগ ও পাকিস্তান আর্মিপ্রধান) দেখি। সেই দর্শনে তাঁকে একজন পেশাদার সামরিক কর্মকর্তা মনে হয়েছিল। জানি না একাত্তরের শুরুতে তিনি কোথায় ছিলেন এবং কী করছিলেন অথবা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়ার সঙ্গেই বা তাঁর কী সম্পর্ক ছিল। তা ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমরা তাঁকে নিবেদিতপ্রাণ রাষ্ট্রনায়ক এবং সামরিক বাহিনীতে একজন ‘নো ননসেন্স’ জেনারেল হিসেবেই দেখেছি।
তাই তাঁকে জড়িয়ে বেগম জিয়াকে নিয়ে এমন গল্প ফাঁদার উদ্দেশ্য সহজে বোধগম্য নয়। তা কি খালেদা জিয়াকে তাঁর আন্দোলন থেকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে, তাঁর চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করতে, তাঁকে হেয় প্রতিপন্ন করতে- এসবের উত্তর রাজনীতির পর্যবেক্ষকরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে প্রধানমন্ত্রীও খালেদা জিয়ার ব্যাপারে যেভাবে ‘ব্যক্তিগত পর্যায়ে’ আক্রমণ চালান এবং খালেদা জিয়ার ব্যক্তিজীবন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন, তাতে উভয়ের সম্পর্ক আর রাজনৈতিক থাকে না, এক প্রকার প্রতিহিংসা বা জিঘাংসায় নেমে আসে।
খালেদা জিয়াকে তাঁর সেনাছাউনিস্থিত বাসভবন থেকে বিতাড়নকে প্রধানমন্ত্রী এক প্রকার ব্যক্তিগত প্রেস্টিজের বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। যদিও ওই বাসভবনটি প্রয়াত জিয়ার স্মৃতিবাহক ছিল এবং জিয়ার মৃত্যুর পর তাঁর বিধবা পতœীকে তা আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই দেওয়া হয়েছিল, তবু আমি কখনো সেনাছাউনিতে একজন রাজনৈতিক দলপ্রধানের বসবাস পছন্দ করিনি। এমন বসবাসের নেপথ্য অসংগতির উল্লেখ করে আমি একাধিক কলামও লিখেছিলাম।
যাক, বৈধ বা অবৈধ যা-ই হোক, বাসভবনটি যে এখন ‘দখল’মুক্ত হয়েছে তা এক প্রকার স্বস্তির বিষয় সব মহলের জন্যই। এর বিপরীতে যদি আমরা আরেকটি দখলের দিকে দৃষ্টিপাত করি, যাতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী জড়িত ছিলেন, তাহলে খালেদা জিয়ার সেনাছাউনির বাসভবন নিয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া এবং পদক্ষেপ গ্রহণ মশা মারার জন্য কামান দাগার মতো মনে হবে। কেননা খালেদা জিয়ার একটি ‘বি’ গ্রেডের বাড়ি, যা আর্মি এমইএস-এর তদারকিতে কর্নেল পদবির কর্মকর্তাদের জন্য নির্মিত হয়, তার তুলনায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গণভবন, যা নাকি তৈরিই হয় দেশের প্রধান নির্বাহীর জন্য, তার দখল কি আরো চাঞ্চল্যকর নয়! যদিও তিনি একজন চৌকস রাজনীতিক হিসেবে অনেক বিচার-বিশ্লেষণ করে শেষ পর্যন্ত গণভবন ছেড়ে দিয়েছিলেন।
সেনাছাউনিতে খালেদা জিয়ার বাসভবন দখলমুক্ত করার অপারেশনে প্রধানমন্ত্রীর মেজাজ এবং দখলমুক্ত হওয়ার পরও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিলাসী জীবনশৈলী নিয়ে আওয়ামী মহলের খিস্তিখেউড় জাতির মননে এক প্রকার অসুস্থতার জন্ম দিয়েছিল। জাতি তাদের অপপ্রচার এবং ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বলার সঙ্গে একমত হয়নি। তাই খালেদা জিয়া এখনো সব প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়ে ‘বেঁচে’ আছেন। আওয়ামী মহল যে কৌশলই নিক এবং তার কুশীলবরা যে অপকৌশলই ফাঁদুক, সারা পশ্চিমা বিশ্বের উন্নয়ন সহযোগীরা সংলাপের পক্ষে তাদের রায় দিচ্ছে, যার অর্থ খালেদা জিয়া এখনো বাংলাদেশে রাজনীতির অন্যতম নিয়ামক- যার সংশ্লিষ্টতা ছাড়া গণতন্ত্র আসেনি, আসবেও না। কালেরকণ্ঠ
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বি আইআইএসএস


শেয়ার করুন