খাবার খেতাম মাটিতে কাপড় বিছিয়ে

19858_f6চিজ বা পনিরের প্রতি অন্ধ ভালোবাসা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বৃটিশ নাদিয়া হোসেনের। সিলেটি পিতামাতার এই সন্তান দ্য গার্ডিয়ানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে অকপটে স্বীকার করেছেন তার শৈশবের সবকিছু। সরলভাবে তিনি বলেছেন, আমি বেড়ে উঠেছি লুটনে। আমাদেরকে সব সময়ই খাবার খেতে হতো মেঝেতে কাপড় বিছিয়ে তার ওপর বসে। ছিল না টিভি দেখার অনুমতি। বাংলাদেশে (ডাইনিংয়ে) কোনো চেয়ার ছিল না। আমার পিতা এই রীতি ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। এ জন্য কখনোই আমাদের ডাইনিং টেবিল ছিল না। ভাত ছিল আমাদের প্রধান খাদ্য। বাংলাদেশি রীতি অনুযায়ী প্রতি রাতের খাবারে ভাতের সঙ্গে থাকতো সাত বা আট রকমের তরকারি। আমরা গোল হয়ে খেতে বসতাম। গ্যাস হিটারটা আমার কাছাকাছি থাকতো তখন। কারণ, আমি সব সময়ই ঠাণ্ডায় কাবু। তার এই বক্তব্য নিয়ে সামাজিক মিডিয়ায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। দ্য গার্ডিয়ান তার ওই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করেছে ১৯শে জুন। এতে তিনি আরো অনেক কথা বলেছেন। বলেছেন, তার পিতার ছিল একটি ভারতীয় রেস্তরাঁ। এর শেফ ছিলেন তিনিই। কাজ শেষে সব সরঞ্জাম বাসায় নিয়ে যেতেন তার পিতা। তার মধ্যে ছিল গ্যাজেট, উইজেট ও মিক্সার তৈরি করার বড় সব মেশিন। তিনি তৈরি করতেন অ্যাঙ্গলিসাইজ কারি। কিন্তু তার মা প্রথা অনুযায়ী রান্না করতেন সব সাধারণ খাবার। তার মা কখনো বেশি খাবার রান্না করতেন না, যদিও প্রতি শুক্রবার তার পিতা একটি আস্ত ভেড়া কিনে নিতেন। নাদিয়া বলেছেন, তার পিতা কাজ থেকে ফিরে তার মাকে সবকিছু যথাযথভাবে করতে সহায়তা করতেন। নাদিয়ার মাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলতেন, দেখ তুমি ঠিকমতো পিয়াজটা কাটতে পারোনি। জবাবে তার মা বলতেন, ‘দ্যাখো তাতে কিছু হবে না। আমি এতে কেয়ার করি না। আমি ৬টি সন্তানকে বড় করে তুলছি।’ নাদিয়া তার পিতামাতাকে চমৎকার একটি দম্পতি বলে উল্লেখ করেন। বলেন, তাদের মধ্যে মাঝে মধ্যে সব সময়ই থাকতো প্রতিযোগিতা। নাদিয়া বলেন, বেশির ভাগ গরমকালেই আমরা বাংলাদেশে যেতাম। সেখানে দাদাবাড়িতে অবস্থান করতাম। তখন আত্মীয়স্বজনে বাড়ি ভরে যেত। দাদা-দাদী, নানা-নানীর নাতিপুতিদের ৬৭ জনের মধ্যে আমি একজন। সেখানে আমি একটি জিনিস লক্ষ্য করেছি। তাহলো, সেখানে অন্যরা যা খেত তার চেয়ে আমরা বেশি খেতাম। অন্যরা সামান্যই খেত। কারণ, তাদের অনেক ছেলেমেয়ে। তারা কখনও জলখাবার খায় নি। আমাদের জন্য থাকতো বিস্কুট, চিপস, চকলেট। অন্যদের জন্য তা থাকতো না। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা গাছ থেকে একটি আম না পাবে ততক্ষণ তারা অন্যকিছু পেত না খেতে (ভাত ছাড়া)। বাংলাদেশে ডাইনিং নেই, চেয়ার নেই নাদিয়ার এমন বক্তব্যে সামাজিক মিডিয়ায় ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। ফলে বিষয়টি নিয়ে অনলাইন ডেইলি মেইল, ডেইলি অ্যান্ড সানডে এক্সপ্রেস রিপোর্ট করেছে। এতে বলা হয়েছে, ওই সাক্ষাৎকারে নাদিয়া বলেছেন, বাংলাদেশে (ডাইনিংয়ে) কোনো চেয়ার নেই। বাবা এই প্রথাকে ধরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। এ জন্য আমাদের কখনও ডাইনিং টেবিল ছিল না। তাছাড়া, ডেজার্টের ধারণাটি বাংলাদেশি কুইজিনে নেই। চিজের প্রতি আমার অন্ধ ভক্তি রয়েছে। কিন্তু আমার মা কখনও তা কেনেননি। কারণ, বাংলাদেশি রান্নায় তার ব্যবহার নেই। এর ফলে বাংলাদেশি বা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। ফেসবুকে নামিরা হোসেন নামে একজন জবাবে লিখেছেন, বাংলাদেশে অবশ্যই চেয়ার আছে। আছে ডেজার্ট। আমাদের স্থানীয় পর্যায়ে আমরা চিজকে পনির বলে থাকি। ফারাশা খান সাঈদ লিখেছেন, তার বিবৃতি বাংলাদেশকে ছোট করেছে। বাংলাদেশিদের ডেজার্ট আছে। এর মধ্যে রয়েছে দই, ফিরনি, নানা রকম মিষ্টি। আমাদের নিজস্ব ধরনের চিজ আছে। এগুলো সুইস চিজের মতোই। তিনি অবশ্যই তার নিজস্ব শৈশব নিয়ে কথা বলছেন। ফারহানা রহমান নামে একজন নাদিয়া হোসেনকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন, কথা বলার আগে আপনাকে বাংলাদেশের কুইজিন নিয়ে কিছুটা গবেষণা করা উচিত। বাংলাদেশে নানা রকম ডেজার্ট আছে। অবশ্যই এখানকার মানুষের ডাইনিংয়ে চেয়ার আছে।
সাক্ষাৎকারে নাদিয়া বলেন, ছোটবেলায় তিনি অত্যন্ত কৌতূহলী ছিলেন। সব বিষয়েই স্পষ্ট জানতে চাইতেন তিনি। প্রশ্ন করে সন্তোষজনক উত্তর না পেলে নাদিয়া সরাসরি বলে দিতেন, তোমরা আমাকে সত্য বলছো না। নিজের স্বামীকে নিয়েও কথা বলেন তিনি। নাদিয়া জানান, বিয়ের দিনই প্রথম স্বামীকে দেখতে পান তিনি। তখন তার বয়স ছিল ২০ বছর। স্বামীর সঙ্গে লিডসে থাকতে শুরু করেন। ওই বাসার রান্নাঘর ছোট হলেও প্রথমবারের মতো সম্পূর্ণ নিজের একটি রান্নাঘর পেয়েছিলেন- এমন ভাবনাতেই বিভোর ছিলেন নাদিয়া। সন্তানের জন্মের পর স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখেই ছিলেন তিনি। ওজনও বাড়তে থাকে তার। বেক অফে অংশ নেয়ার আগের বছর এসে ওজন কমান তিনি। তবে নিজের ইচ্ছামতো খেতে এখনও কার্পণ্য করেন না নাদিয়া। আর নাদিয়ার সন্তানরাও মায়ের রান্না বলে অহেতুক প্রশংসা করে না। একবার হোয়াইট চকলেট ও ল্যাভেন্ডার দিয়ে ক্রিম পুডিং বানিয়েছিলেন নাদিয়া। তার ছেলে এটাকে জঘন্য বলে অভিহিত করে এবং ভবিষ্যতে এমন কিছু যাতে তৈরি না করা হয় সেটাও বলে মাকে।
সাক্ষাৎকারে নাদিয়া বলেন, তিনি যখন বেক অফে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন তখনও ভাবেননি যে, তিনি একটা সময় গিয়ে বাংলাদেশি, মুসলিম নারী বা সবার জন্যই রোল মডেলে পরিণত হবেন। এটাকে ইতিবাচক হিসেবেই নিয়েছেন নাদিয়া। তবে সবার রোল মডেল হওয়ার পরেও তিনি বিশেষভাবে রোল মডেল হতে চান তার সন্তানদের জন্য। আর তার জন্যই কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানান নাদিয়া।
উল্লেখ্য, ওই সাক্ষাৎকারে নাদিয়া হোসেন বলেন, বাংলাদেশি কুইজিনে ডেজার্টের ধারণা নেই। এ জন্য আমরা শুধু স্কুল পর্যায়ে গিয়ে তা পেয়েছি। আমাদের বাসায় একটি ওভেন ছিল। মা সেটাতে ফ্রাইং প্যান ঢুকাতে পারতেন। এছাড়া, যেকোনো কিছু তাতে ঢুকিয়ে দেয়া যেত। টিনেজ বয়সের আগে পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল না কেক কিভাবে তৈরি হয়। যখন আমি বেকিং করা শুরু করলাম তখন তা আমার কাছে বিস্ময়কর ছিল।

–মানবজমিন


শেয়ার করুন