উপসম্পাদকীয়

কোমেন-আতঙ্কে কাঁদে দরিয়ানগর

মনির ইউসুফ :
কাল সারারাত আমরা ঘুমাতে পারিনি। আমাদের মত দরিয়া তীরের হাজার হাজার মানুষও ঘুমাতে পারেনি। সিটিএন অফিস, নিউজ আপডেট, দুর্গত মানুষের ছুটাছুটি আর গুড়িগুড়ি বৃষ্টি এমন এক নৈর্ব্যক্তিক আতঙ্ক তৈরি করেছে, তাতে সচেতন কোন মানুষের ঘুম আসার কথা না। অসচেতন মানুষ হিসেবে আমাদেরও ঘুম আসেনি। সারারাত তীব্র বাতাস, তীব্র ঢেউয়ে- মানুষের আপতকালীন জয়যাত্রায় শামিল হতে পেরে দরিয়ার মানুষ হিসেবে আমাদেরও ভাল লাগছে। যে কোন দুর্যোগ দুর্বিপাকে মিডিয়া কর্মীদের দৌড়ঝাঁপ দেখার মত। কেননা, নতুন নিউজের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকা পত্রিকা ও চ্যানেলগুলো নিউজের উৎস তৈরি হলেই পাগল হয়ে পড়ে নিউজ প্রেজেন্ট করার জন্য। পৃথিবীতে এখন সবচেয়ে মজার ব্যবসা হচ্ছে নিউজ ব্যবসা। যারা সাম্প্রচারিক সত্য-মিথ্যা দিয়ে ধরাকে সরা করে, সরাকে ধরা । বাংলাদেশের মত ছোট্ট দেশেও এর ঢেউ পড়েছে তীব্রভাবে। মুক্ত সংবাদের নামে পত্রিকা ও চ্যানেলগুলোতে যা পরিবেশন করা হয় তাতেই প্রলুব্ধ হয়ে পড়ে মানুষ। একটি গণতান্ত্রিক দেশে কতটি সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেল কিংবা অনলাইন পোর্টাল থাকা দরকার তার হয়ত কোন নিয়ম নেই, তা না হলে বাংলাদেশে যে রকম মানহীন সংবাদপত্র,টিভি চ্যানেল, অনলাইন পোর্টাল বের হচ্ছে তা দেখলে বুঝা যায়, জাতির চিন্তার নৈরাজ্য ভোগবাদীতা ও সুবিধাবাদীতার অসুস্থ প্রতিযোগিতা কতটুকু দখল করে নিয়েছে।
দরিয়া তীরের দুর্গত মানুষ নিয়ে লিখতে গিয়ে এমন প-িতি করার কোন মানে হয় না। করতেও চায় না। কিন্তু মিডিয়ার এমন নিয়ন্ত্রহীন প্রচারণা মানুষের মনোবল নষ্ট করে দিচ্ছে। মানুষের মনে যতটুকু আতঙ্ক নেই মিডিয়া তার চেয়ে বেশি আতঙ্ক ছড়িয়ে দিচ্ছে। এর নেগেটিভ-পজেটিভ প্রচারণা একটি একাকার অবস্থা তৈরি করেছে। সাধারণ মানুষকে সাগরের ঢেউতুফানে খাওয়ার পূর্বে খেয়ে ফেলছে মনের ঢেউ তুফানে। দরিয়ার মানুষজন এখন পানিবন্দী। নিকট অতীতে মানে এক’সপ্তাহ পূর্বে যে ঝড় হয়েছে সেটার রেশ এখনো কাটেনি। মানুষ এখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেনি। বন্যার এই তীব্র দুর্বিপাক কাটতে-না কাটতে আবার ‘কোমেন’ নামক আরেক প্রাকৃতিক বিপদ ধেয়ে আসছে দরিয়া তীরের মানুষের মাঝে। এটা নিয়ে মিডিয়াবাজি না করে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানো একান্ত কর্তব্য। আসুন, আমরা মিডিয়াগুলোতে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলি। ক্ষয়-ক্ষয়তি পরিবেশনার পাশাপাশি মানুষের সামাজিক দায়বোধও উসকে দিই। এবং ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সহোদর ভাইয়ের মত আমার নিজেদের সহযোগিতা নিজেরাই করি। আল্লাহ সবার সহায় হোক।
২.
কোমেন আতঙ্কের এক উৎসব যেন। হাজার হাজার মানুষ ‘কোমেন’ আতঙ্কে হয়েছে ঘরছাড়া। ঘরছাড়া করেছে শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী বৃদ্ধসহ অনেক মানুষকে। এক জায়গায় বাস করা অভ্যস্থ জীবনে নিয়ে এসেছে এক ধরনের দুর্বিষহ বৈচিত্র। ককসবাজারের হোটেল মোটেলগুলো উপকূলীয় মানুষের ভিড়ে ভরে গেছে। সবাই নির্ভাবনায় উঠে এসেছে বিভিন্ন হোটেলগুলোতে। হোটেলের মালিকগণ এমন বিপদে সাধারণ মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। একটা উৎসব উৎসব আতঙ্ক। এবং শিশু কিশোরেরা মজাও পাচ্ছে বেশ। কিন্তু বৃদ্ধ ও মধ্যবয়সী মানুষের স্বাভাবিক অভ্যস্থতায় এক ধরনের আতঙ্ক ও দুর্ভাবনা ঘিরে ধরেছে। তীব্র রোষের বাতাস ও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি নিয়ে মানুষ নিরাপদ স্থানে চলে এসেছে। প্রাকৃতিক এই বিপদ নিয়ে অনেকে সারাদিন কাটিয়ে দিয়েছে বাতাসের দখলে থাকা সমুদ্রচরে ।
৩.
আমাদেরও এক নগদ পাগলামি পেয়ে বসে সকালে। ৭নং বিপদ সংকেত থাকা সত্ত্বেও, রোষে ফুঁসে ওঠা বঙ্গোপসাগরকে সরেজমিনে দেখার তীব্র লোভ জাগে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ি আমি, কবি সরওয়ার সাঈদ, কবি কালাম আজাদ। বৃষ্টিভেজা সেই সময়টাকে আমরা নিজের মত করে নিই। হেঁটে হেঁটে, হেঁটে হেঁটে আমরা সমুদ্রের রোষে ফুলে ওঠা সাগরের গর্জন শুনি। তাঁর তীব্র ফুঁসানিকে আমার অবজ্ঞা করি। ভয় পায়। আতঙ্কে আৎকে ওঠি। তার থাবায় থাকা দরিয়ার স্বজনদের জন্য আমাদের আকুলতা জেগে ওঠে, সাগর আমাদের শাসায়। হাজার বছর ধরে সাগরবক্ষকে বিদীর্ণ করেছে মানুষ, তার সমুদ্রচরকে আক্রমণ করেছে নিয়ত। তাকে শাসনে রাখার জন্য তার বক্ষ চিরে নতুন নতুন দালান তুলেছে। সাগরের গর্জন শুনে আমরা অবিবেচক মানুষেরা কিছু অর্জন করতে পারিনি। সেই দুঃখ বুকে নিয়ে সাগর তার রোষের জলকামান দাগাতে চাই মানুষের বক্ষে। লোভী ও স্বার্থপর ক্ষতিপয় মানুষের কারণে সাগরে বুক লেপ্টে থাকা সাগরের খোয়াজ খিজিরের সঙ্গে আল্লাহর জিকির করা মানুষও বাঁচতে পারছে না। সাগর তাঁর জন্য গর্জনে-গর্জনে আমাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে। নিবিড়-নীলাভ লবণ বাতাসে চোখ খুলতে পারি না আমরা । বাতাসে এমন ধাক্কা চোখ খোলা দায়। সেই আধো-আলো, আধো- অন্ধকারে সাগরের দুঃখে আমরা মর্মাহত হই। ঢেউগুলো ছুড়ে দেয় বাতাসে তাদের চিৎকার বলেÑ আমাকে আক্রমণ করার খেসারত তোমাদের দিতে হবেÑ হে লোভী, অবিবেচক মানুষ, এ দায় তোমাদের বহন করতে হবে। আর তোমাদের লোভকে স্থির করে নিতে হবে। তা না হলে আমার জলরোষ ভবিষ্যতে আরও বেশি তীব্র হবে, আবারও ফুঁসে উঠবে বঙ্গোপসাগরের ঢেউতিমি।


শেয়ার করুন