কেমন আছে ভারতে চলে যাওয়া বাংলাদেশের হিন্দুরা?

ুুুুুুসিটিএন ডেস্ক:
কাজের অভাব ও উপযুক্ত মজুরি না পাওয়ায় পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে অন্যান্য রাজ্যে অভিবাসী হচ্ছে শ্রমজীবী শ্রেণির অনেকে। আন্দামান, মধ্যপ্রদেশ, কেরালা, দিল্লিসহ দূরের ও কাছের বেশ কয়েকটি রাজ্যে কাজ নিচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের শ্রমজীবী মানুষরা।

পরিসংখ্যান অনুয়ায়ী, অন্যান্য রাজ্যে কাজ নিতে প্রতিমাসে পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে যাচ্ছে প্রায় ১০ থেকে ১৫ হাজার শ্রমিক। এসব রাজ্যে কৃষি, শিল্প ও নির্মাণ খাতে অভিবাসী শ্রমিকরা কাজ করছে। তবে তারা পশ্চিমবঙ্গ ছাড়লেও বঞ্চনা তাদের পিছু ছাড়ছে না। নিজের রাজ্য ছেড়ে অন্যত্র কাজে গিয়েও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন এইসব শ্রমজীবী মানুষেরা।

শ্রমিকদের অনেকে অভিযোগ করেছেন, বিশেষ সিন্ডিকেট গ্রুপ করে তাদের কর্মস্থলে নিয়ে যাচ্ছে। বিনিময়ে তাদের যে মজুরি ধরিয়ে দিচ্ছে মালিকদের কাছ থেকে সিন্ডিকেট সদস্যরা এর চেয়ে বেশি নিচ্ছে।

সিন্ডিকেট সদস্যদের এ কমিশন খাওয়া নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ আছে। বেকারত্বের সুযোগে এক শ্রেণির সিন্ডিকেট চক্রও সক্রিয় হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গে। ভিন প্রদেশের জায়গা চেনা ও কাজে যোগদানের কথা বলে ১৫ থেকে ২০ জনের গ্রুপ নিয়ে যাচ্ছে সিন্ডিকেট চক্র। এদের থাকা-খাওয়াসহ ২শ’ থেকে ৩শ’ রুপি রোজ হিসেবে দেয়ার কথা বলে নেয়া হয়। আর সিন্ডিকেট চক্র ৫শ’ থেকে ৮শ’ রুপি রোজ হিসেবে শিল্প উদ্যোক্তাদের কাছ আদায় করছে। তবুও কাজ পাচ্ছে সেজন্য মুখ খুলছে না তারা।

গত ১৮ মার্চ থেকে ২৩ মার্চ পর্যন্ত ভারতের বালুরঘাট, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, মালদা, কালিগঞ্জ, গাজোল, রায়গঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে।

বিশেষ করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর, পশ্চিম দিনাজপুরের বালুরঘাট, রায়গঞ্জ, গাজোল, মালদা, নদীয়া, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, ময়নাগুড়ি, ফালাকাটা, আলিপুর, কোচবিহারসহ জেলাগুলোতে বাংলাদেশ ত্যাগী যেসব হিন্দুরা বাস করছেন তাদের মধ্যে এখন হতাশা বিরাজ করছে। বর্তমান প্রজন্মের শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ ছেলেরা বেকার। ৪০ ভাগ নানা অসামাজিক কাজে লিপ্ত।

এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় ৬০ শতাংশ কর্মক্ষম যুবক বেকার। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর থেকে যেসব সংখ্যালঘুরা ভারতে স্থায়ী আবাস গড়েছেন তাদের বিশ্বাস ছিল, ভারতে গিয়ে অন্তত খেয়ে-পরে সুখে-শান্তিতে থাকতে পারবেন। কিন্তু বিধিবাম। কাজ আছে শ্রম মজুরি কম। আবার অনেকে লোক লজ্জায় নিজ রাজ্য ছেড়ে অন্য রাজ্যে কাজ করতে যাচ্ছে। যেখানে পরিচিত কেউ দেখছে না- সে কী কাজ করছে।

কোচবিহারের কালজানি গ্রামের রাধেরশ্যাম সরকার বাংলামেইলকে বলেন, ‘কালজানি গ্রামে ২শ’ বাড়ি রয়েছে। প্রতি বাড়ি থেকে কম করে হলেও এক জন করে দিল্লিতে কনস্ট্রাকশন কাজে নিয়োজিত। ৬ মাস থেকে ১ বছরের জন্য কাজে যায়। শ্রমমূল্যে বৈষম্য থাকার পরও কালজানি একটি সমৃদ্ধশালী গ্রাম হয়েছে। লোকজন এখন খেয়ে-পরে ভালো আছে। যে বাড়িতে এক সময় টিনের ঘর ছিল না, সে বাড়িতে আজ পাকা ঘর। সব মিলে কালজানি গ্রামের মানুষের মধ্যে স্বচ্ছলতা ফিরে এসেছে। এসব শ্রমিকরা যদি বেতন বৈষম্যের শিকার না হতেন তবে কালজানির গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখতে পারতেন।’

মালদা জেলার গাজোল থানার কালিতলা গ্রামের বাসিন্দা কমল রায় বাংলামেইলকে বলেন, ‘কালিতলায় আমার জন্য বা আমার বয়সের বেকার ছেলেদের কৃষিকাজ ছাড়া কোনো কাজ নেই। তাও আবার মজুরি কম। তাই কেরালায় এক বছরের জন্য কাজে যাই। ৬ মাস পর একবার বাড়ি আসি। দেখা গেছে কাজ শেষে থাকা-খাওয়া খরচ বাদে ২ থেকে আড়াই লাখ টাকা হাতে জমা থাকে। বাড়ি এসে মা-বাবার সঙ্গে মাস খানেক থেকে আবার পাঁচদিনের ট্রেনে চেপে কেরালায় যাই। এসময় একটু খারাপ লাগে। তবে কাজে ঢুকে গেলে আরা সমস্যা হয় না।’

কালিতলা গ্রামের কমল রায়ের মতো বেকার যুবারা কেরো ও আন্দামান গিয়ে কাজ করে। শুধু ছেলেই নয় নারী শ্রমিকও বাইরে কাজ করতে যায় বলে জানান কমল।

একই গ্রামের অপর বাসিন্দা সুদেন মন্ডল বাংলামেইলকে বলেন, ‘দিল্লিতে কাজ করে স্ত্রী ও এক ছেলেকে নিয়ে আজ আমি ভালো আছি। আরও ভালো থাকতাম যদি মজুরি বৈষম্য না থাকতো। সরাসরি কাজে যোগ দিতে পারলে সঠিক মজুরি পাওয়া যেত।’

বালুরঘাট জেলার বুনিয়াদপুর থানার কুসুমন্ডি গ্রামের সাধুচরণ সরকার বলেন, ‘২৫ বছর হয় বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ জেলার ভাড়ারিয়া ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রাম ছেড়ে এখানে এসেছি। এখানে কোনো কিছু করতে না পেরে অন্যের বাড়িতে জন দিয়েও (কামলা) জীবন-জীবিকার পথ স্বচ্ছল হয়নি। বর্তমানে শেষ বয়সে এসে স্ত্রী-ছেলে নিয়ে একসঙ্গে দিল্লি, কেরালা এমনকি আন্দামানের মতো দূরের প্রদেশে গিয়েও কাজ করতে হচ্ছে। তবে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে।’

তিনি আরো বলেন, ‘তারা আমাদের আশা-যাওয়ার খরচ দিয়ে নিয়ে যায় সুদূর প্রদেশে। সেখানে আমাদের প্রতিদিন ৫শ’ থেকে ৭শ’ টাকা দরে বিক্রি করে দেয় সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর কাছে। আর যারা আমাদের নিয়ে যাচ্ছে তারা আমাদের দিচ্ছে ২শ’ থেকে ৩শ’ টাকা রোজ হিসেবে। যাই হোক, মজুরি বৈষম্যের শিকার হয়েও আমরা বর্তমানে ভালো আছি।’

এদিকে ভারতের আন্দামান প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, কেরালা, দিল্লিসহ আশপাশের প্রদেশগুলো ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম একটি শ্রমবাজার। ফলে আন্দামান প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, কেরালা, দিল্লিসহ আশপাশ রাজ্যে গমনেচ্ছু পশ্চিমবঙ্গের দক্ষ শ্রমিকদের জিম্মি করে প্রকাশ্যে চলছে সীমাহীন ঘুষ বাণিজ্য। এ নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে।

এসকল শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে সুনাম থাকা সত্ত্বেও স্থানীয় শ্রমিকদের তুলনায় তারা অবহেলিত হচ্ছেন নানাভাবে। বেশি অভিবাসন ব্যয় ও কম মজুরি প্রদানসহ নানা প্রকার বৈষম্যমূলক ব্যবহার করছে উল্লিখিত এলাকাসহ সেখানকার কোম্পানিগুলো।

সিন্ডিকেটের কবল থেকে কেরালা, আন্দামান প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, দিল্লিসহ বিভিন্ন প্রদেশে শ্রমিক পাঠানো একক প্রক্রিয়ার ক্ষমতা রোধ করা না হলে অদূর ভবিষ্যতেই পশ্চিমবঙ্গের শ্রমবাজার হারিয়ে যেতে পারে বলে বাংলামেইলের মুখোমুখি শঙ্কা প্রকাশ করেন বালুরঘাটের তৃণমূল নেতা ভক্ত সরকার।


শেয়ার করুন