কক্সবাজারের কৃতি মানুষ

কৃষক সংগঠক-আজীবন বিপ্লবী ধীরেন শীল

কালাম আজাদ

কালাম আজাদ

কালাম আজাদ :

১৯৪০ সালের দিকে চট্টগ্রামে কমিউনিস্ট পার্টি, নিখিল বঙ্গ ছাত্র ফেডারেশন, কৃষক সভা এবং প্রগতি লেখক সংঘের সংগঠন গড়ে ওঠে। সুখেন্দু দস্তিদার, সুরেণ দে, শচীন নন্দী, পুর্ণেন্দু দস্তিদার, সুধাংশ বিমল দত্ত, শরদিন্দু দস্তিদারের বদৌলতে কক্সবাজার মহকুমায় পার্টির সাথে যোগাযোগ ঘটে। কিন্তু শিক্ষা দীক্ষায় কক্সবাজার অনুন্নত থাকায় জমিদারি জোতদারদের শোষণে তীব্র নির্যাতিত ও শোষিত হতো এই অঞ্চলের জনগণ। তাই কক্সবাজারে ছাত্র ফেড়ারেশনের তেমন একটা ব্যাপ্তিও হতে পারি নি। তবে কুতুবদিয়ার স্বভাব কবি ধীরেন শীল, শহীদ সাবের, চট্টগ্রাম থেকে এসে রামু ও কুতুবদিয়ায় ছাত্র ফেডারেশনের কাজ করতেন। কুতুবদিয়া, চকোরিয়া, রামুতে পার্টির যোগাযোগ ছিলো। তবে কুতুবদিয়া ও চকরিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ফেডারেশন, কৃষক সভার সংগঠন ছিলো বেশ জোরালো। কুতুবদিয়ায় পার্টির সংগঠক ছিলেন অবিভক্ত বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সদস্য স্বভাব কবি ধীরেন শীল। কুতুবদিয়া উপজেলার বড়ঘোপে তার জন্ম। হিন্দু জমিদার পরিবারে জন্ম হলেও তিনি ছিলেন প্রজা ও কৃষকদের প্রতি সহানুভূতিশীল। যার ফলে তাকে সহ্য করতে হয়েছে অনেক নির্যাতন ও মানসিক যন্ত্রণা। জমিদার-জোতদারদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে অনেক মামলা-হামলার শিকার হয়েছেন।

একদিকে জমিদারের শোষণ অন্যদিকে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের আস্ফালনের  জর্জরিত বাংলার মানুষ। চট্টগ্রাম কলেজে পড়াকালিন সময়ে ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ছাত্র ফেডারেশনের সাথে যুক্ত হন।  কুতুবদিয়ায় তিনি গড়ে তোলেন হিন্দু মুসলমান ছাত্র যুবাদের নিয়ে গোপন সংগঠনের কাঠামো। মুসলিম লীগের দুর্দাণ্ড প্রতাপের সময়েও তার নেতৃত্বে কুতুবদিয়ায় নিখিল বঙ্গ কৃষক সভা ও ছাত্র ফেডারেশন গঠিত হয়। তার অন্যতম সহযোগি ডা. উপেন শীলও একজন কৃষক সংগঠক ছিলেন। তাকেও অত্যন্ত প্রতিকূল অবস্থায় চকরিয়ায় তাকে কাজ করতে হয়। চকরিয়া ও কুতুবদিয়া থানা ছিলো কয়েকজন দুর্দান্ত প্রতাপশালী জমিদার- জোতদারের অমানুষিক নির্যাতনের উর্বর ভূমি। তাই স্বভাব কবি ধীরেন শীল ও উপেন শীলকে মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে ওই সব এলাকায় কাজ করতে হতো। তবুও তাদের আহ্বানে অনেক কৃষক কর্মী পার্টির পতাকাতলে সমবেত হয় বলে কমরেড শরদিন্দু দস্তিদার তার ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থে ( ৫৪ পৃষ্টায় ) উল্লেখ করেছেন।

১৯৩৯ সালে পঢিয়া ধলঘাট ইউনিয়নের বাগদণ্ডি এলাকায় চট্টগ্রাম জেলা কৃষক সভার প্রথম সম্মেলন হয়। ওই সম্মেলনের এক জন সদস্য ছিলেন ধীরেন শীল।

১৯৪৫ সালের ৫ এপ্রিল থেকে নেত্রকোনায় নাগাড়ার মাঠে কয়েকদিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত সারা ভারত কৃষক সম্মেলনে চট্টগ্রামের প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নেন । ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মুজফ্ফর আহমদ এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে মাহবুব উল আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে চট্টগ্রামের কৃষক নেতা কমরেড আবদুস সাত্তার, কমরেড কল্পতরু সেনগুপ্ত, কল্পনা দত্ত, নবী ও বঙ্গিম সেনও অংশ নিয়েছিলেন। অভ্যূত্থনা কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন কমরেড মণি সিংহ। ভারত থেকে এসেছিলেন পিসি যোশী, ভবাণী সেন, বঙ্কিম মুখার্জী, কৃষ্ণবিনোদ রায়, সোমনাথ লাহিড়ী। চট্টগ্রাম থেকে যে দশজনের একটি সাংস্কৃতিক স্কোয়াড ওই সারা ভারত কৃষক সম্মেলনের যোগদান করে তার অনত্যম স্বভাব কবি ধীরেন শীল গান গেয়ে সবার নজর কাড়েন। ১

দ্বি-জাতিতত্ত্বের মতো সাম্প্রদায়িক ভাগবাটোয়ার মধ্যে দিয়ে গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে মুসলিম লীগ তাদের বিরোধী সংগঠন কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের উপর যখন হামলা চালায় এবং তাদের দমাতে কারাগারে প্রেরণ করে। ঠিক তেমিন কুতুবদিয়ার কৃষক ও গণতান্ত্রিক যুবলীগ নেতা এবং কমিউনিস্ট পার্টি চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সদস্য ধীরেন শীলকেও আটক করা হয়। ঢাকা জেলে আটক থাকার সময়ে ১৯৪৯ সালের ৯ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া রাজবন্দিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং খাবারের মান্নোয়নের দাবিতে ৫৮দিনের অনশন কর্মসূচীতেও সরদার ফজলুল করিম, শরদিন্দু দস্তিদার, নলিনী দাশ প্রমুখের সঙ্গে অংশ নেন। ৫৮ দিন অনশনের পর সবাই অনশন তুলে নিলেও ধীরেন শীল কোনো কিছু খান নি। অনশন ভঙ্গ করার কথ বললে উল্টো যারা বলতেন তাদের পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর এজেন্ট দাবি করতেন। ওই অনশনে অংশগ্র্রহণকারী কমরেড সরদার ফজলুল করিম এর ভাষায় বলা যায় :

‘কুতুবদিয়ার কৃষক-যুবক কর্মী এবং স্বভাব কবি ধীরেন শীল অনশন ভঙের পরেও খাদ্য গ্রহণ করতে বলে অস্বীকার করেন। বললেন, যারা তাকে খেতে বলছে তারা সংগ্রামের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করছে। তারাই কর্তৃপক্ষেরই এজেন্ট এবং অনশন ধর্মঘট এখনো চলছে। এভাবে করতে করতে তার জীবনও প্রায় বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। ২

অনশন ভাঙ্গার পর কোনো কিছু না খাওয়ায় আস্তে আস্তে ধীরেন শীলের শরীর শুকে যায়। ১৯৫৪ সালের দিকে তিনি বদ্ধ পাগল হয়ে যান।  জেলে কী হয়েছিলো তার কাহিনি শুনা যাক- শরদিন্দু দস্তিদারের জবানির মাধ্যমে। তিনি তার ‘জীবনস্মৃতি (১৯৯৯) গ্রন্থের ১৪১ পৃষ্টায় উল্লেখ করেছেন এভাবে-

‘কারাগারে আমার চোখের সামনে এক মর্মান্তিক ঘটনার অবতারণা হয়। চট্টগ্রাম জেলার কুতুবদিয়া থানার কৃষক নেতা ধীরেন শীল হঠাৎ একদিন হয়ে গেলেন বদ্ধ উন্মাদ। তার সাথে আমার ছিল দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। অবিভক্ত বাংলায় তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সদস্য। জেলে বসে তিনি বিভিন্ন মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বইপত্র থেকে নোট করতেন দিন রাত। পড়তেন সব সময়। হঠাৎ একদিন দেখলাম, তিনি নানা অসংলগ্ন কথা বলছেন। আমি ঘাবড়ে গেলাম। অনিলদাকে (অনিল দা মানে ‘সাম্যবাদের ভূমিকা’ গ্রন্থের লেখক শ্রমিক নেতা কমরেড অনিল মুখার্জী- লেখক) বিষয়টা বললাম। রাতে দেখলাম তিনি পাগল হয়ে গেলেন। তাঁকে স্থানান্তর করা হয় জেল হাসপাতালে। দুই মাস পর তাকে মুক্তি দেয়া হয়। তাঁর মুক্তির আদেশ নিয়ে জেল জমাদার হাসপাতালে গেলে তিনি জানালেন, শরদিন্দু বাবু ছাড়া আমি বাড়ি যাবো না। কারা কর্তৃপক্ষ পড়লেন মহা মুশকিলে। আমার সাহায্য কামানা করলেন। বাধ্য হয়ে আমাকে যেতে হলো জেল গেটে। তাঁকে বের করার পর আমি ফিরে গেলাম জেলের অভ্যন্তরে। প্রতিবাদে তিনি চিৎকার করতে লাগলেন। যা হোক তাঁকে বলপূর্বক জেল কর্তৃপক্ষ তাঁকে কারাগারের বাইরে পাঠিয়ে দেন। সে অবস্থায় ঢাকার কমিউনিস্ট পার্টির সহকর্মীরা তাঁকে চট্টগ্রামে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। ’৩

জেল থেকে বের হয়ে ধীরেন শীল চট্টগ্রামের অনেক সহকর্মীর সাথে দেখা করলেন। ওই সময়ে বলে যেতে থাকলেন পার্টির রাজনীতি বিষয়ক কথাবার্তা। তখন অনেকেই ধারণা করতে পারেন নি যে, এক সময়ের তুগোড় কৃষক ও কমিউনিস্ট নেতা ধীরেন শীলের মস্তিস্ক বিকৃতি ঘটেছে।  জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর শরদিন্দু দস্তিদার ধীরেন শীলের সাথে দেখা করলেন। ওই সময় ধীরেন শীল প্রতিবেশী দেশ ভারতে যাবার মনস্থির করলেন। শরদিন্দু দস্তিদারের জবানীতে-

কিছুদিন পর তার সাথে আমার দেখা। তিনি আমাকে জানালেন, তিনি প্রতিবেশী দেশে যাবেন। অর্থাৎ কলকাতায়। সঙ্গে একটি লাল পতাকাও। সব সময় লাল পতাকা তাঁর সাথে থাকতো। এমন একনিষ্ট, আদর্শের প্রতি আস্থাবান কমরেড ছিলেন তিনি।

কলকাতা যাওয়ার মনস্থির হওয়ার পর যাওয়া গেল না কিনা সে তথ্য জানা যায় নি। তবে তিনি লাল পতাকা ও বইপত্র থাকায় আবার গ্রেফতার করে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর পদানত পুলিশ বাহিনী। শরদিন্দু দস্তিদারের জানালেন,

আবার এক বছর পর তার সাথে দেখা হলো রাজবন্দি ওয়ার্ডে। জানতে পারলাম। পুলিশ তাঁকে বইপত্র-লাল পতাকাসহ গ্রেফতার করেছে।

পরে তিনি (ধীরেন শীল) কোথায় থাকতেন সেটা জানেন না উল্লেখ করেছেন শরদিন্দু দস্তিদার। তবে তিনি কলকাতায় আবাস গড়েন বলে পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে।

 

 

দোহাই – 

১.    মাহবুব উল আলম চৌধুরী, স্মৃতির সন্ধানে, ২০০৮, ঢাকা : পালক, পৃ ৬২/ মামুন সিদ্দিকী, ভাষাসংগ্রামী মাহবুব উল আলম চৌধুরী , জুন ২০০২, ঢাকা : বাংলা একাডেমী, পৃ : ৩৪

২.    সরদার ফজলুল করিম, নুহের কিশতি ও অন্যান্য প্রবন্ধ, ১৯৯৬, ঢাকা : বাংলা একাডেমী।/ সরদার ফজলুল করিম, ‘অনশনে আত্মদান’, মার্চ ২০১০, ঢাকা : জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, পৃ : ৩৫।

৩.    শরদিন্দু দস্তিদার, ‘জীবনস্মৃতি’, ডিসেম্বর ১৯৯৯, ঢাকা : জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ। পৃ: ৫৪।


শেয়ার করুন