কুরআন কেন বুঝে পড়া উচিত

40231_178-400x240কুরআন বিশ্ববাসীর জন্য আল্লাহ তায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত। বিশ্ববাসী যখন চরম অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল, যখন কোথাও কোনো নিভু নিভু আলোর শিখাও পরিদৃষ্ট হচ্ছিল না, তখন কুরআন নিয়ে এলো মহা নিয়ামতের ভা-ার হাতে। কুরআনের আলোয় আলোকিত হওয়ার কারণে মরুচারী যাযাবর জাতিগোষ্ঠীকে আল্লাহ তায়ালা সর্বকালের সর্বগুণে গুণান্বান্বিত জাতিতে পরিণত করলেন। শুধু তাই নয়, বিশ্বব্যাপী আদল ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের এমন কোনো শাখা-প্রশাখা নেই যেখানে কুরআন ওয়ালাদের অবদান নেই।
অতঃপর এই কুরআন ওয়ালারা যখন কুরআন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো, তখন কুরআনের মালিকের ওয়াদা মতো তারা বিশ্বব্যাপী লাঞ্ছিত, অপমানিত হতে লাগল।
কুরআনে আলোড়ন সৃষ্টিকারী সম্মোহনী ক্ষমতা : হজরত উমর রা:-এর কথাই ধরা যাক। মুহাম্মদ সা:-এর বিশাল ব্যক্তিত্ব, ন্যায়পরায়ণতা, সত্যবাদিতা বা আমানতদারিতা হজরত উমর রা:-এর চিন্তাজগতে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। বরং তিনি মুহাম্মদ সা:কে হত্যা করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। কিসে তাকে ইসলামে আকৃষ্ট করল? শুধু কুরআন। কুরআনই তাকে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করল। আঘাতে আঘাতে যখন তিনি তার বোন ফাতিমাকে রক্তাক্ত করলেন। অতঃপর যখন তার হুঁশ হলো, তিনি জানতে চাইলেন, দেখি তোমরা কী পড়ছিলে? তার বোন ফাতিমা সূরা ত্বহার অংশ বিশেষ তাকে দিলে, তিনি তা পাঠ করে এতটাই অভিভূত হয়ে পড়লেন যে, তৎক্ষণাৎ ছুটে গেলেন মুহাম্মদ সা:-এর কাছে ইসলাম গ্রহণের জন্য।
ইসলামের আরেক দুশমন আরবের অন্যতম ধনাঢ্য ও কুরাইশ নেতা ওয়ালিদ বিন মুগিরা। তিনি তো রীতিমতো চুপিসারে কুরআন শুনতেন, কুরআনের সুললিত ছন্দ ও কথা তার মনোজগতে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল। কুরাইশদের মধ্যে এ কথা প্রচার হয়েছিল যে, মুগিরা ইসলাম গ্রহণ করেছে। আবু জেহেল মুগিরার কাছে গিয়ে বলল, তুমি কুরআনের বিরুদ্ধে কুৎসা প্রচার করো। জবাবে মুগিরা বলল, কাব্য এবং সাহিত্যে আমার চেয়ে বেশি জ্ঞান তোমরা রাখ না। কিন্তু মুহাম্মদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে ভাষার দিক থেকে তা কোনো কবির রচনা নয় এবং ভাবের দিক থেকেও তা কোনো জাদুমন্ত্রও নয়। হে আবু জেহেল তুমি দেখছ না, পিতা তার পুত্র থেকে, ভাই তার বোন থেকে, স্বামী তার স্ত্রী থেকে কিভাবে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। আল্লাহর কসম জেনে রাখ, মুহাম্মদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা বিজয়ী হবেই। আবু জেহেল বলল : যদি তুমি কুরআনের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা না করো, তাহলে তোমার কওম তোমাকে পরিত্যাগ করবে এবং তুমি তোমার নেতৃত্ব হারাবে। যদিও শেষ পর্যন্ত ওয়ালিদ বিন মুগিরা ইসলাম গ্রহণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সে বিষয়ে সূরা মুদাচ্ছিরে আল্লাহ সুবহানুু তায়ালা ইঙ্গিত দিয়ে তার প্রতি অনুগ্রহের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এরূপ ইসলামের প্রাথমিক যুগের অসংখ্য ঘটনা রয়েছে, যা শুধু কুরআনের কারণেই ইসলামের বড় দুশমনদের চিন্তা-চেতনাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণে বাধ্য হয়েছে। শুধু তাই নয়, বর্তমান যুগেও অনেক বড় বড় অমুসলিম প-িত ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছেন। যেমন : প্রখ্যাত সঙ্গীত তারকা সামী ইউসুফ, ভারতের শীর্ষস্থানীয় ধর্মগুরু বহু ভাষায় প-িত ড. শিবশক্তি স্বরূপজী মুসলিম নাম ড. ইসলামুল হক। ব্রিটিশ চিকিৎসা বিজ্ঞানী ড. আর্থার জে. এলিসন ১৯৮৬ সালের ডিসেম্বরে, কায়রোতে অনুষ্ঠিত পবিত্র কুরআনের চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কিত আয়াত শুনে তিনি এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে, সেখান থেকে ফিরে এসে ব্যাপকভাবে কুরআন অধ্যয়ন শুরু করেন এবং শেষ পর্যন্ত ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন, মুসলিম নাম হয় ড. এলিসন আবদুল্লাহ। তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান। (সূত্র : ইসলাম ও সমকালীন বিস্ময়কর কয়েকটি ঘটনা, মুহিউদ্দীন খান)
ওপরে এই ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো বর্ণনার কারণ একটি তা হচ্ছে, কুরআন বুঝে পড়া। কুরআন বুঝার কারণে তাদের চিন্তাচেতনাকে কিভাবে ছিন্নভিন্ন করে দিলো। কারণ আল্লাহ নিজেই কুরআনের অপরিসীম ক্ষমতা সম্বন্ধে বলেছেন : ‘যদি এ কুরআনকে পর্বতের ওপর অবতীর্ণ করতাম তবে অবশ্যই তুমি তাকে আল্লাহর ভয়ে ধসে যেতে ও বিদীর্ণ হতে দেখতে পেতে; আর আমি এসব দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করি মানুষের জন্য যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে’ (সূরা আল হাশর : ২১)।
এরপর কুরআনে আল্লাহ চ্যালেঞ্জ করে বললেন : ‘আর যা আমি আমার বান্দার ওপর অবতীর্ণ করেছি সে ব্যাপারে যদি তোমাদের কোনো সন্দেহ থাকে, তাহলে অনুরূপ একটি সূরা তৈরি করে আন এবং আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সহযোগীদের ডেকে আন যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক’ (সূরা বাকারা : ২৩)।
কুরআন কেন আমাদের বুঝে পড়তে হবে : আমরা আমাদের শিক্ষাজীবনে সব গ্রন্থই বুঝে পড়েছি, শুধু কুরআন ছাড়া। অথচ দাবি করছি, কুরআন মহাগ্রন্থ। যদি সত্যি সত্যিই আপনি বিশ্বাস করেন যে, কুরআন মহাগ্রন্থ এবং একমাত্র নির্ভুল জ্ঞানের উৎস। তাহলে তো সর্বপ্রথম এই কিতাবটি আমাদের বুঝে পড়া এক নম্বরের দায়িত্ব ছিল। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল, শিক্ষাজীবন শুরু হবে এ মহাগ্রন্থ ও নির্ভুল জ্ঞানের একমাত্র উৎস আল কুরআন বুঝে পড়ার মধ্য দিয়ে। কিন্তু আমরা কি তা করতে পেরেছি। আসলে আমাদের উচিত এটি মুখস্থ করার পাশাপাশি বুঝে পড়া। যে গ্রন্থটি আমাদের জীবনের ইশতেহার, সে গ্রন্থটি না বুঝে পড়লে, এ মহাগ্রন্থ আমাদের চিন্তা জগৎকে কিভাবে আলোকিত করবে? আর এর হকই বা কিভাবে আদায় হবে?
এই যে, আমরা চার দিকে এত ফেরকা, মতভেদ, র্শিক ও বিদআতের ছড়াছড়ি দেখি। একমাত্র কারণ কুরআনিক জ্ঞানের অভাব। এ থেকে মুক্ত থাকার উপায় দ্বীনের সঠিক জ্ঞান। আর দ্বীনের সঠিক জ্ঞানের উৎস কুরআন ও হাদিস। এ কুরআন সংরক্ষণের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ সুবহানু তায়ালা নিজেই গ্রহণ করেছেন। বিদায় হজের ভাষণে রসূল সা: বলেছেন, ‘তোমরা যত দিন কুরআন ও আমার সুন্নাহকে সঠিকভাবে অনুসরণ করবে তত দিন তোমরা বিভ্রান্ত হবে না।’ কুরআন তো শুধু এ জন্যই নাজিল হয়েছে যে, এর বিধানাবলি তাঁর বান্দারা জানবে এবং সে অনুযায়ী তার জীবনকে পরিচালিত করবে। আর জ্ঞানীদের জন্য রয়েছে জ্ঞানের বিশাল ভা-ার। আল্লাহ সুবহানু তায়ালা বলেন, ‘এটি এক বরকতময় কিতাব, যা (হে মুহাম্মদ) আমরা আপনার প্রতি নাজিল করেছি, যেন লোকেরা এর আয়াতগুলো সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করে এবং জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিবেকসম্পন্ন লোকেরা তা থেকে উপদেশ গ্রহণ করে’ (সূরা সোয়াদ : ২৯)।
কুরআন মানব চরিত্রকে দৃঢ় বিশ্বাস বা ঈমানের ওপর প্রতিষ্ঠিত করে। তার মধ্যে আত্মসম্মানবোধ ও দায়িত্ববোধ সৃষ্টি হয়। যেহেতু সে বিশ্বাস করে, আল্লাহ ছাড়া আর কেউই মানুষের কোনো কল্যাণ বা অকল্যাণ করতে পারে না। তাই সে শুধু আল্লাহ ছাড়া আর কারোই কাছে মাথা নত করে না।
তারপরও কুরআন সন্তুষ্ট হবে না। কুরআন আবারো মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে দরখাস্ত করে বলবে, ‘হে আমার রব, তার মর্যাদা বাড়িয়ে দিন। তখন আল্লাহ তাকে বলবে, পড় এবং ওপরে উঠতে থাক। অতঃপর প্রতিটি আয়াতের বিনিময়ে তার প্রতিদান বাড়তে থাকবে’ (তিরমিজি)।
শেষ কথা : কুরআনের কারণেই যে জাতি বিশ্বব্যাপী নন্দিত ছিল, কুরআনের কারণেই সে জাতি ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, বিশ্ববাসীকে আলোর পথ দেখিয়েছে। সে জাতির দুর্গতির একমাত্র কারণ কুরআনের শিক্ষানুযায়ী জীবন পরিচালনা না করা। কুরআন বুঝে পড়ার জন্য প্রতিটি এলাকায় কুরআনের ভাষা শিক্ষা ইনস্টিটিউট গড়ে তুলতে হবে। সম্পদশালী ইসলামপ্রিয় ব্যক্তিদের কুরআন বুঝে পড়ার কার্যক্রম হাতে নিয়ে এগিয়ে আসা দরকার। কুরআনপ্রিয় সম্পদশালী মানুষ যদি কুরআনের শিক্ষা সম্প্রসারিত করার জন্য এগিয়ে আসে তাহলে সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর হয়ে দ্বীনি পরিবেশ সৃষ্টি হবে। সুখী-সমৃদ্ধশালী ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে।


শেয়ার করুন