কুটনৈতিক ভাবনাঃ অসভ্য গণতন্ত্রের লক্ষণ ও মুক্তির একটি প্রস্তাবনা

মোহাম্মদ নুরুল হক নুরঃ

রাষ্ট্র ও সরকারব্যবস্থা :
রাষ্ট্র একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। আর সরকার রাষ্ট্র গঠনের অন্যতম প্রধান উপাদান। সরকার মূলত রাষ্ট্র্রের মুখপাত্র হিসেবে দেশ পরিচালনা করে। রাষ্ট্র ও সরকার বিভিন্ন রকম হতে পারে। রাষ্ট্র্রের সামাজিক ও রাজনৈতিক চাহিদার বিভিন্নতার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র্রে বিভিন্ন ধরনের সরকারব্যবস্থা গড়ে উঠেছে ।
রাষ্ট্র ও সরকার
‘রাষ্ট্র’ ও ‘সরকার’ এ দুটি অনেক সময় সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এ দুটির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। রাষ্ট্র একটি পূর্ণাঙ্গ ও স্থায়ী প্রতিষ্ঠান। এটি সার্বভৌম বা সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। আর সরকার রাষ্ট্র গঠনের চারটি উপাদানের (জনসংখ্যা, ভূখণ্ড, সরকার ও সার্বভৌমত্ব র ) মধ্যে একটি উপাদান মাত্র। পৃথিবীর সব রাষ্ট্র একই উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত হলেও সব রাষ্ট্র ও সরকারব্যবস্থা এক ধরনের নয়। আবার সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে যেকোনো দেশে রাষ্ট্র ও সরকারের স্বরুপ পরিবর্তিত হতে পারে।
সভ্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র :
যে শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্র্রের শাসনক্ষমতা সমাজের সকল সদস্য তথা জনগণের হাতে ন্যস্ত থাকে, তাকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে। এটি এমন একটি শাসনব্যবস্থা যেখানে শাসনকার্যে জনগণ সকলে অংশগ্রহণ করতে পারে এবং সকলে মিলে সরকার গঠন করে। এটি জনগণের অংশগ্রহণে, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের কল্যাণার্থে পরিচালিত একটি শাসনব্যবস্থা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র্রে জনগণের মতপ্রকাশ ও সরকারের সমালোচনা করার সুযোগ থাকে। এতে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় অর্থাৎ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তিত হয়। একাধিক রাজনৈতিক দল থাকে। সকলের স্বার্থরক্ষার সুযোগ থাকে এবং নাগরিকের অধিকার ওআইনের শাসনের স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
অশিক্ষিত অসভ্য ‘গণতন্ত্র ”
যে শাসনব্যবস্থায় রাষ্টের সকল নির্বাহী ক্ষমতা থাকে প্রধানমন্ত্রীর হাতে ,যার কাছে রাষ্টের সার্বভৌমত্বের চেয়ে নিজ সার্থ ও ক্ষমতার লোভ লালসা বেশি থাকে। নিজেকে প্রজাতন্ত্রের দায়ীত্ব প্রাপ্ত কর্মচারী মনে করেন না, যিনি প্রজাতন্ত্রের আয় -ব্যয়ের জবাবদিহি করেন না বরং ব্যয়কে নিজের কৃতিত্ব বলে প্রচার করেন ।যিনি শিক্ষা ,সিকিৎসা,খাদ্য,নিরাপ্তায় বিদেশ নির্ভর থাকেন।
এ ছাড়াও এ অশিক্ষিত অসভ্য ‘গণতন্ত্রের ”শাসক ও রাষ্ট্রের কয়েকটি মৌলিক লক্ষণ হল:
উগ্র জাতীয়তাবাদ:
এধরণের রাষ্ট্রে সরকার জনগণের একটি অংশ উভয়ই চেতনা ,জাতীয়তাবাদী স্লোগান চিহ্ণ, গান নিয়ে মুখর হয়ে থাকে। দেশের সব জায়গায় জাতীয়তাবাদী চিহ্ণের পতাকা ওড়ে, নয়তো জামা কাপড়ে সিল হয়ে লেগে থাকতে দেখা যায়।
মানবাধিকারের প্রতি অবজ্ঞা:
দেশের সরকার এবং জনগণের মাঝে মানবাধিকার নিয়ে একধরনের অবজ্ঞা বিরাজ করে। শত্রুভয় ও দেশের নিরাপত্তার প্রশ্ন তাদের কাছে মানবাধিকারের ঊর্ধ্বে। ওইসবের প্রয়োজনে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলে।এ ধরণের শাসনব্যবস্থায় মানুষের মনে কারাবন্দীদের অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যা করা নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য থাকে না, বরং অনেক ক্ষেত্রে ভয়ে জনগণের একটি অংশ তাদের সমর্থনই করতে থাকে।
একটা কমন শত্রু থাকা:
দেশের সব সমস্যার জন্যে জনগণের কাছে একটা কমন শত্রু তথা বলির পাঁঠা উপস্থিত থাকে। দেশের টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে? অমুকের দোষ। যুদ্ধে বা কুটনীতিতে হেরেছি? আলবৎ জামায়াত বি এন পি মৌলবাদীদের দোষ। কেবল শত্রু নির্ণয়েই তার শেষ নয়। জনগণের কমন শত্রুকে সমূলে নিশ্চিহ্ণ করার পরিবর্তে জিয়ে রেখে ভিন্ন ও সংখ্যালঘু ধর্মের বর্ণের বা রাজনৈতিকদল/জাতির উপর চাপিয়ে দেয়া হয়। কখনো কখনো তারা হয় বি এন পি জোট বা জামায়াত শিবির কিংবা হেফাজত জঙ্গী নামধারীদের নামে।
মিলিটারিকে প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান:
দেশের দুর্যোগের মুহূর্তেও সরকারি তহবিলের মোটা অংশটা মিলিটারির ভাগ্যে জুটে, দুর্যোগটাকে দূরে ঠেলে হলেও। দেশের মানুষের কাছে দেশের সৈন্যরা অতিশয় মহৎ। মিলিটারি সেবা মহান কর্ম।
লিঙ্গবৈষম্য সর্বব্যাপী বিরাজমান:
এ অসভ্য ‘গণতন্ত্রের ”শাসক প্রায় সার্বিকভাবে হয় নারী ,না হয় পুরুষ উভয় এক নায়কতান্ত্রিক। তাদের শাসনে লিঙ্গবৈষম্য আরো প্রকট হয়। প্রচলিত লিঙ্গভিত্তিক বিভাজনকে সমর্থনের মাধ্যমে আরো প্রকটরূপ দেওয়া হয়। রাষ্ট্রকে পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের সার্বিক রক্ষক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম: কোনো কোনো ক্ষেত্রে মিডিয়া সরাসরি রাষ্ট্রাধীন, অন্যান্য ক্ষেত্রে মিডিয়া পরোক্ষভাবে নানা সরকারি নিয়মকানুনের বেড়াজালে বন্দী কিংবা সরকারপন্থী ভাষ্যকার ও মুখপাত্রদের দখলে। সেন্সরশিপ সেখানে সর্বব্যাপী বিরাজমান।
জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে আহাজারি: জাতীয় নিরাপত্তা লঙ্ঘনের ভয়কে একটা প্রধান অস্ত্র হিসেবে জুজুর ভয় দেখায় ।
ধর্ম আর রাষ্ট্রের মাখামাখি: এ অসভ্য ‘গণতন্ত্রের ”শাসক সাধারণত দেশের প্রধান ধর্মটি নিয়ে বিস্তর গুটিবাজি করে, ওটা ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের মন ভুলায়। কথায় কথায় বিসমিল্লাহ, কোরান তেলওয়াত কিংবা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অজুহাতে কোনো লেখক বা ওয়েবসাইটকে ধরে সাইজ করে দেওয়া এইসব প্রায়ই দেখা যায়। এমন কি সরকারের মূলমন্ত্র কিংবা নীতিগুলো প্রধান ধর্মটির নানা বিষয়ের সাথে সাংঘর্ষিক হলেও মুখে মুখে ওই ধর্মকেই ব্যবহার করে এইসব গুটিবাজি করতে তাদের বাঁধে না।
কর্পোরেটদের নিরাপত্তা: অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় ধনিক ব্যবসায়ী গোষ্ঠিরাই এধরণের সরকার গঠনে সাহায্য করে যাতে করে সরকারটি সকল ক্ষমতা একহাতে নিয়ে ওই গোষ্ঠির স্বার্থের দেখভাল করে।
শ্রমিকদের ক্ষমতা সীমিতকরণ:
শ্রমিকদের একতাবদ্ধ আন্দোলন এদের সবচেয়ে বড় ভয়। তাই এ অসভ্য ‘গণতন্ত্রের ”শাসক হয় শ্রমিক ইউনিয়ন সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ণ করে দেয় নতুবা শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করে।
বুদ্ধিজীবিতা ও শিল্পকর্মের প্রতি অবজ্ঞা:
এ সরকার উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে হয় সরাসরি বৈরিতা প্রদর্শন করে নয়তো সেরকম অবজ্ঞাকে সমর্থন করে। অধ্যাপকদের ও বুদ্ধিজীবীদের সেন্সরের মুখে পড়া কিংবা গ্রেপ্তার হওয়া সেখানে বিরল ঘটনা নয়। শিল্পসাহিত্যের মুক্তপ্রকাশের উপর আক্রমণও সেখানে ঘটতে থাকে।
অপরাধ ও শাস্তি নিয়ে মাত্রাধিক আগ্রহ:
এ অসভ্য ‘গণতন্ত্রের ”শাসন আমলে পুলিশ কিংবা বিশেষ বাহিনী আইন প্রয়োগের ব্যাপারে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ভোগ করে। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়ম ও অন্যায় নিয়ে উদাসীন থাকতে, এগুলোকে উপেক্ষা করে । এমন কি দেশপ্রেমের উছিলায় (নিজের এবং অন্যের) নাগরিক অধিকার ও স্বাধীনতাকেও জলাঞ্জলি দিতে তারা প্রস্তুত।
অবাধ স্বজনপ্রীতি এবং দুর্নীতি:
এ অসভ্য ‘গণতন্ত্রের ”শাসক প্রায় সবসময়েই এক পর্যায়ের একটা গোষ্ঠিশাসন, যেখানে একদল লোক আর তার বন্ধুরা মিলে অধিকাংশ সরকারি পদ, সুযোগ সুবিধা, ক্ষমতা ভোগ করে। সরকারি নেতাদের দ্বারা দেশের তহবিলের উপর বিশেষাধিকার ভোগ এমন কি লোপাট করার ঘটনাও প্রায়ই ঘটতে দেখা যায়।
নির্বাচনে কারচুপি:
এ অসভ্য ‘গণতন্ত্রের ”শাসন আমলে অনেক সময় নির্বাচন হয় কেবল নামকাওয়াস্তে। অন্যান্য সময় নির্বাচনে ঘটে কারচুপি ও অবৈধ হস্তক্ষেপ, ঘটে বিপক্ষ দলের প্রার্থীদের হত্যর ঘটনা, ভোট গণনায় হস্তক্ষেপ, আসনের সীমানা নড়াচড়া করানো এবং মিডিয়ার অসৎ ব্যবহার।

সভ্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে বিছু প্রস্তাবনা :
যে গণতান্ত্রে সকল নির্বাহী ক্ষমতার মালিক প্রধানমন্ত্রী সে গনতন্ত্র অসভ্য গণতন্ত্র সেই দেশ যত উন্নত দেশই হোকনা কেন।
জাতীয় আইনসভা গঠন করে প্রধানমন্ত্রীর একক নির্বাহী ক্ষমতা ভাগাভাগি করে রাষ্ট্র পরিচালনা করা। দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট একটি আইন-সভা তৈরি করা যেতে পারে । এটা নির্মিত হবে নিম্নকক্ষের দ্বারা যাকে প্রতিনিধিসভা বলা যেতে পারে এবং একটি উচ্চকক্ষ দ্বারা যাকে কাউন্সিলদের হাউস বলা যেতে পারে । উভয় কক্ষ সরাসরি সমান্তরাল ভোটিং ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন করা হবে । রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ আইন পাসের চুড়ান্ত ক্ষমতা ,জাতীয় প্রতিরক্ষা ,জাতীয় নির্বাচন এ আইন-সভার অধীনে থাকবে, আনুষ্ঠানিকভাবে এ আইন সভা দায়িত্বপূর্ণ বা দায়বদ্ধ হয়ে থাকবে। অন্ততপক্ষে এ টুকু হলেই আপাতত সভ্য গণতন্ত্রের আশা করা যায় ।

মোহাম্মদ নুরুল হক নুর
লেখক ও কলামিস্ট


শেয়ার করুন