মূলঃ কমলা সুরাইয়া
অনুবাদঃ মোহাম্মদ শাহজাহান
[কমলা সুরাইয়া ভারতীয় মালয়ালম ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখিকা।এখানে তাঁর ইংরেজিতে অনুদিত একটি
ছোটগল্পের বাংলা ভাষান্তর পত্রস্থ করা হলো]
স্বামীকে অফিসে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলো সে। ব্রিজটার কাছে আসতেই সভয়ে গাড়ি
থামাতে হলো তাকে। কারণ, পাঁচ-ছয় জন লোক ব্রিজের উপর সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পথ আটকে আছে। সে
বুঝতে পারে, ওরা পুলিশের লোক।
লোকগুলোর একজন তার গাড়ির কাছে এগিয়ে এসে বলেঃ
-তুমি কি এভাবেই গাড়ি চালাও?
সে ভয় পেয়ে যায়।কারণ, লোকটিকে হিংস্র দেখায়।তাই সে মৃদু কন্ঠে বলেঃ
-আমি তো ধীর গতিতেই গাড়ি চালাচ্ছিলাম, তাই না?
-আমি তা বলিনি।
-তাহলে আমি আর কী করেছি?
অন্যদের দিকে ইশারা করে লোকটি গাড়িতে উঠে তার বাম পাশের আসনটিতে বসে পড়ে। অন্য লোকগুলো
গাড়ির পেছনের আসনে গিয়ে বসে।
-গাড়ি চালাও। চালাতে থাকো-আমিই তোমাকে বলবো কোন দিকে যেতে হবে। থানায় চলো।
-থানা? আমি কী করেছি? আমি তো কিছু করিনি। আমাকে ওখানে নিয়ে যাচ্ছেন কেনো? কান্নাজড়িত
কন্ঠে সে বলে।পুলিশের লোকটি নিরবতা পালন করে।
এক সময় লাল দেয়ালের দু’তলা এক ভবনের সামনে গাড়ি থামাতে বলে ওরা। তাকে নিয়ে গাড়ি থেকে
নেমে পড়ে সবাই।
-এসো। তোমার কোন কিছু বলার থাকলে, ভেতরের লোকটিকে বলো। পুলিশের লোকটি বলে।
সে পালাতে চেষ্টা করে। পুলিশের লোকটি তার হাত চেপে ধরে শক্ত করে। তার মনে হয়, লোকটির চাপে
তার আঙ্গুলের হাড়গুলো যেনো ভেঙ্গে চুরমার হবে।
সে চারপাশে তাকিয়ে পুলিশের আর কোন লোকজন দেখতে পায় না। ওরা ওকে নিয়ে একটি সিঁড়ির সামনে
গিয়ে দাঁড়ায়। শুকিয়ে যাওয়া পানের পিকে বিশ্রী হয়ে আছে জায়গাটি। সিঁড়ির বাম পাশের দেয়ালে বাংলায়
কী যেনো লেখা হয়েছে চিকা মেরে। সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতে বলা হলো তাকে। চোখ দুটো অশ্রুসজল হয়ে
উঠে তার।
-কাঁদছো? এখন কাঁদছো, অপকর্মটি সারার পরে?
-কী অপরাধ করেছি আমি? আমাকে কোন আইনে ধরে এনেছেন এখানে? সে জিজ্ঞেস করে।
-প্রশ্ন করছে গো!অশ্লীল হেসে লোকটি বলে।পেছনের লোকগুলোও হেসে উঠে।
বড় একটি কক্ষে এসে থামে ওরা। কক্ষটির জানালায় গাঢ় হলুদ রঙের পর্দা ঝুলছে। টেবিল-চেয়ার কিছুই
নেই কক্ষটিতে। দেয়ালে সুন্দরী এক মহিলার একটি রঙ্গীন ছবি টাঙ্গানো।
-উনি এখনই এসে পড়বেন। পুলিশের এক লোক বলে।
-কে?
ওরা উত্তর দেয় না। পকেট থেকে এক জোড়া হাতকড়া বের করে তার হাতে পরিয়ে দেয় একজন।
-দয়া করে আমার স্বামীকে ফোন করুণ। ওকে এখানে আসতে বলুন। সে অনুরোধ জানায়।
-স্বামীকে কেনো? উনি তো কোন অপরাধ করেননি। অপরাধী তো তুমিই।
-কী অপরাধ?
-মনে করে দেখো।
কক্ষটিতে তাকে রেখে চলে যায় ওরা। সে নিজেকে স্বান্তনা দেবার চেষ্টা করেঃ এটি একটি দুঃস্বপ্ন ছাড়া কিছুই
নয়, কী অপরাধ করেছি আমি? কিছুই না। সুতরাং, যা কিছু হচ্ছে, তার সবই নিশ্চয় দুঃস্বপ্ন মাত্র—কিন্তু
তার হাতের কব্জি ব্যথা করে উঠে। সে আবারও কাঁদতে শুরু করে।
-তো, তুমি এসেছো তাহলে?আমি তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। মাঝ-বয়সী, খাট, মোটা-সোটা এক
লোক কক্ষে প্রবেশ করেই বলে।
-কে আপনি?সে রাগতঃস্বরে জিজ্ঞেস করে।
-কে আমি? হা হা হা। ওর প্রশ্ন শুনেছো তোমরা? পেছনে তাকিয়ে লোকটি বলে।পুলিশের লোকগুলো
আবারও দরোজায় এসে দাঁড়ায়। একজন বলেঃ
-ইনি আমাদের বস।
-ইন্সপেক্টর? সে জানতে চায়।
তারা মাঠা নাড়ায়।
বস নামের লোকটির পরণে সাদা পাজামা ও নীল জামা। দুটি বোতাম ছেঁড়া জামাটির।লোকটির পান-খাওয়া
দাঁতগুলোও হলদে।
ঘেন্নায় পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে দাঁড়ায় সে।
-তো, তুমি অপরাধ স্বীকার করেছো তাহলে?
-অপরাধ স্বীকারের কী আছে এখানে? আমি গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। পুলিশের এই লোকগুলো পথ
আটকিয়ে আমাকে থামায়। এরপর কোন কারণ না জানিয়েই এরা আমাকে এখানে নিয়ে আসে।আমার স্বামী
যখন এসব জানবে—-
-স্বামী!তোমার আবার স্বামী এলো কোত্থেকে,কল্যাণী? লোকটি জিজ্ঞেস করে।
-আমি কল্যাণী নই।
-তুমি ভেবেছিলে, আমি তোমাকে চিনতে পারবো না, তাই না?
-আপনার নিশ্চয় ভুল হচ্ছে। আমাকে বরং যেতে দিন।
-এই যে পরিচয় গোপন করলে, এজন্যে শাস্তি কী জানো? তিন মাসের সশ্রম কারাদন্ড। লোকটি বলে।
পুলিশের লোকগুলো এগিয়ে আসে। তারা বারান্দা পেরিয়ে আরেকটি কক্ষে নিয়ে যায় তাকে। অন্ধকারাচ্ছন্ন,
ছোট কক্ষটিতে কোন জানালা নেই।
-তোমার কাপড়গুলো খুলে আমাদের দাও। এক পুলিশ বলে।
-কী জন্য?
-তোমাকে আরেকটি পোষাক দেয়া হবে। এখন থেকে তোমাকে ওই পোষাক পরেই থাকতে হবে।
সে কাঁদতে শুরু করে।
-না। আমি পারবো না। সে বলে।
-তুমি আবার কবে থেকে এমন লাজুক হয়ে উঠলে, কল্যাণী? এক পুলিশ বলে।
-আমি কল্যাণী নই। আমার নাম আম্মিনি। আমি মেনন সাহেবের স্ত্রী। সে বলে।
-স্ত্রী!ঘৃণামাখা কন্ঠে বলে উঠে লোকটি। সে হাতকড়া খুলে দেয় তার। তারপর তার কাপড়গুলো নিয়ে
দরোজা বন্ধ করে চলে যায় তারা। এরপর কক্ষটিতে আর কিছু দেখতে পায় না সে। কারণ, কক্ষটি
অন্ধকারে ঢাকা। হাতড়ে একটি দেয়াল খুঁজে পায় সে। ওই দেয়ালে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে পড়ে সে।
ওই সময়েও সে মনে মনে ভাবতে থাকেঃ যা কিছু হচ্ছে সবই মিছে-দু;স্বপ্ন বৈ তো নয়। পুলিশ আমাকে
কেনো ধরবে? সকালে যখন ঘুম থেকে জাগবো, তখন আমার স্বামীকে জানাবো এই দু;স্বপ্নের কথা।
দরোজাটি খুলে যায় আবারও। হাতে বাতি নিয়ে এক পুলিশ এগিয়ে আসে তার দিকে।
-এখান থেকে একটু পান করে নিয়ে শোয়ে থাকো।তোমার পোষাকটি নিয়ে আসছি। পকেট থেকে একটি
বোতল বের করে পুলিশের লোকটি বলে।
-কিচ্ছু চাই না আমি। দু’হাতে শরীর ঢাকতে ঢাকতে সে বলে।
-পান করে নাও। লোকটি আবারও বলে।
সে আর দ্বিধা করে না। বোতলটি নিয়ে বিস্বাদ তরল পদার্থটি এক ঢোকে পান করে নেয় সে।
পুলিশের লোকটি চলে যায়। এরপর দীর্ঘক্ষণ সে নিথর হয়ে পড়ে থাকে মেঝেতে। তার মনে হয়, অন্ধকারে
সে যেনো অশরীরী আত্মার মতো উড়ে বেড়াচ্ছে।
দরোজা খোলার শব্দে সে উঠে বসে। কক্ষটি আকস্মিক আলোকিত হয়ে উঠে। সে লজ্জায় চোখ বন্ধ করে।
-আম্মিনি! আমি কখনও ভাবতেই পারিনি, তুমি এ রকম কাজ করতে পারো। তার স্বামী বলে।
স্বামীর গলা শুনে সে চোখ খুলে।সে আনন্দিত কন্ঠে বলেঃ
-তুমি এসেছো! দয়া করে আমাকে দ্রুত এখান থেকে নিয়ে যাও।
স্বামী কোন কথা না বলে বরং কক্ষের অন্য প্রান্তের দিকে তাকায়। সেও তাকায়।দেখে, ওখানে একটি চৌকির
উপর একজন লোক শোয়ে আছে।
-আমি বিশ্বাস করিনি, চিঠিগুলো পাবার পরেও।এমনকি, ফোনে খবর পাবার পরেও ভেবেছিলাম, কেউ নিশ্চয়
মজা করছে। কখনও ভাবতেই পারিনি, তুমি আসলে একজন পতিতা।
-এসব কী বলছো তুমি? পুলিশই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।
স্বামী আর কিছু না বলে কক্ষ থেকে দ্রুত বেরিয়ে যায়।
-দাঁড়াও। আমার কথা শোন। স্বামীকে উদ্দশ্য করে উচ্চ কন্ঠে বলে সে। কিন্তু লজ্জার কারণে স্বামীর পেছন
পেছন ছুটে যেতে পারে না। বারান্দায় একটি খুঁটির ছায়ায় দাঁড়িয়ে সশব্দে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে সে।
-এভাবে ভেঙ্গে পড়ছো কেনো?
পরিচিত গলা শুনে সে পেছনে ফিরে তাকায়। বস নামের লোকটি তার কাছে এসে দাঁড়ায়। সে আবারও
কাঁদতে থাকে।
-তুমি কাঁদছো কেনো,কল্যাণী? স্বামী হিসেবে যাকে জানো সেই লোকটি চলে গেছে বলেই কাঁদছো? কেনো,
আমি তো আছি তোমার পাশে। আমাদের ভালোবাসার বন্ধনটি কতো পুরনো, তাই না? তো, এতোটা ভেঙ্গে
পড়ার কী হলো? লোকটি বলে।
-আমি আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি কল্যাণী নই। আমি তো আম্মিনি।
-তুমি কল্যাণীই। তুমি তো আমার চিরকালের কল্যাণীই। লোকটি হেসে বলে।
ক্লান্তিতে বুজে আসা চোখ তুলে সে লোকটির দিকে তাকায়।
-আমি কি কল্যাণী? সে জিজ্ঞেস করে।
-হ্যাঁ, তুমি কল্যাণী।
সাপ যেভাবে খোলস পাল্টায়,সেভাবে সহজেই নিজের নামটি ত্যাগ করে সে।
মোহাম্মদ শাহজাহানঃ অনুবাদক, কলামিষ্ট ও আইনজীবী।