কবি ও উপন্যাসিক গ্যুন্টার গ্রাসের মহাপ্রয়াণ

মনির ইউসুফ :

‘কবি সেই সুদীর্ঘ অতীত ও বর্তমান সত্তা, একই সঙ্গে জটিল ও সরল যেন দাঁড়িয়ে আছেন স্বপ্ন ও বাস্তবতার, দিন ও রাত্রির সীমানা ছুঁয়ে; এবং তাঁরই ভেতর দিয়ে উঠে আসছে সমস্ত প্রকার উপস্থিতি ও অনুপস্থিতি; এবং যেন তিনি হঠাৎ অর্ন্তগত বিস্ফোরণ খুঁজছেন এবং গ্রহণ করছেন সমস্ত ধ্বংস ও বিপর্যয়ের শক্তি ও উন্মেষের মুক্তিমন্ত্র। (এমে সেজায়ার)

কট্টর ইউরোপিয় একদেশদর্শী এনলাইটেন্টমেন্টের বিপক্ষে কথা বলার শেষ সাহসী কবি ও কথাসাহিত্যিক গ্যুন্টার গ্রাস চলে গেলেন পৃথিবীর বাইরে, অন্যলোকে। সাহিত্যে বিংশ শতাব্দীর শেষ নোবেল বিজয়ী গ্রাস মহাজীবনে প্রবেশ করলেন সোমবার ১৩ এপ্রিল ২০১৫। জার্মান লেখকদের মধ্যে গ্যেটে যেমন অনেক মানুষের প্রিয় কবি ও লেখক, তেমনিভাবে গ্যেটে পরবর্তী শতাব্দীর জার্মান কবি কথাসাহিত্যিক চিত্রকরদের মধ্যে গ্যুন্টার গ্রাসও মানুষের বাস্তব আকাক্সক্ষার সাহিত্যিক নায়ক। বাংলাদেশে গ্যুন্টার গ্রাসকে ব্যাপক ও বিপুলভাবে পরিপ্লাবিত হতে দেখি ‘গুন্টার গ্রাসের ঢাকা আবিষ্কার’ নামক একটি বড় মলাটের গ্রন্থে। ফ্রেব্রুয়ারি ২০০১ ‘আগামি প্রকাশনী’ থেকে প্রকাশিত ‘নাসির আলী মামুন’ সম্পাদিত গ্রন্থটিতে লেখক গ্রাসকে পেয়ে শিল্পের শুভ্রতায় চমকিত হই। পুরো গ্রন্থের পৃষ্ঠায়-পৃষ্ঠায় গ্রাসের বাংলাদেশ ভ্রমণের ছবি এমন আকর্ষণ ও মোহময় করে রাখে, দেখলেই আবিষ্ট হয়ে পড়বে যে কোনো সৃষ্টিশীল মানুষ। মনের ভেতর তৈরি হবে একটি নতুন জগত। গ্রন্থটি দেখে যেমন অনেক কিছু জানা যায়, তেমনি পাঠ করে গ্রাসের মনোভঙ্গি সম্পর্কেও আঁচ করা যায়। নান্দনিক স্বপ্নের পেছনে ছুটতে ছুটতে কোনো এক কৌতূহলী পরিব্রাজক যেনো খুঁজে ফিরছেন একটি শান্তিময় পৃথিবী। যে স্বর্গের জন্য পৃথিবীর হাজারো মহৎ-মানব নিজের জীবন ও যৌবনকে ঢেলে দিয়েছেন একান্ত নিজস্বতায়-সার্বভৌম স্বপ্নে, যে স্বর্গের পিছনে ছুটতে ছুটতে তছনছ হয়েছে মানুষের স্বাভাবিক জীবন। অনেক রক্ত-ঋণ, অনেক কষ্ট ও গ্লানি, নির্মমতা, মানুষের হিং¯্রতা দেখেছে মানুষ। কিন্তু কোথাও কি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বর্গকানন! সেই স্বর্গ প্রতিষ্ঠা করার জন্য জার্মানিতেও ঘটে গিয়েছিল এক তুলকালাম কা-, এক ব্যাপক তোলপাড়। সেই তোলপাড়ের ভেতর বেড়ে ওঠে জার্মান তরুণ গ্যুন্টার গ্রাস। স্বদেশের মানুষের নির্মমতা দেখে দেখে ‘বুকের তলে হৃদয় নামক আঁখি’ দিয়ে নীরবে তাকিয়ে থাকেন মূল্যবোধহীন পৃথিবীর দিকে আর গুটিয়ে যেতে থাকেন নিজের ভেতর। গুটিয়ে যেতে যেতেই গহন সুখে আলো জ্বালানোর বিরাট এক দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে মানুষের সামনে হাজির হন তিনি ‘দি টিন ড্রাম’ নিয়ে। বলা যায়, এই ড্রামের শব্দের ঝংকারে জার্মানি সচকিত হল এবং এরই গর্জন ছড়িয়ে পড়ল তাবৎ পৃথিবীতে। বিশ্ব সাহিত্য নতুন এক ‘বর’কে খুঁজে পেল তার আঙিনায়।

বর্তমান শতাব্দীর জার্মানি এমন এক দুর্বিষহ ও ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে এসেছে, যার মধ্যে ছিল দুটি মহাযুদ্ধ। যার কঠিনতম নৃশংসতায় জার্মানির অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়েছিল এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ জার্মান অস্তিত্বকেই বিলুপ্ত করে দিয়েছিল প্রায়। শতাব্দীর এমন ভয়াবহ নৃশংসতায় থমকে দাঁড়িয়েছিল মানবতার সকল বোধ, সমগ্র নৈতিকতা। আমরা জানি সে সময়, হাজার বছর ধরে মানুষের রক্তের বিনিময়ে একটু একটু করে অর্জন করা মানবিক সৌন্দর্য এক ধাক্কায় উল্টে পড়ে গিয়েছিল। পৃথিবী ভিজে গিয়েছিল মানুষের রক্তদানায়। জার্মানি তখন শুধু নিজেদের অস্তিত্বকে বিপর্যস্ত করে তুলেনি, ‘পৃথিবীর হৃদয়কেও ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছিল’। সেই সময় জার্মান কোন লেখকই নিজের স্বাধীন সত্তাকে বাঁচিয়ে লেখালেখি করতে পারেনি। জার্মান একনায়ক এডলফ হিটলার সমাজে প্রচলিত সমস্ত মূল্যবোধের ওপর আঘাত করেছিল। রাষ্ট্রে কারো নিরাপত্তা ছিল না। না লেখক, না কবি, না সাধারণ মানুষ। স্বাধীন চিন্তার সৃষ্টিশীল মানুষগুলো দেশ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। রাষ্টযন্ত্র পরিচালনাকারি পুলিশমুখো শুয়োরের বাচ্চারা কাউকে বিশ্বাস করত না। ক্ষমতা পেলে এই সাধারণ নিরীহ মুখ সর্বস্ব আইনি মানুষগুলো কেমন হিং¯্র হয়ে ওঠে, জার্মান তার উৎকৃষ্ঠ উদাহরণ। এই ভয় ও চরম অবিশ্বাসের পৃথিবীতে ইতিহাসের সমস্ত চাকা উল্টো দিকে ঘুরে গিয়েছিল। ইতিহাসে বীরত্বের যে মর্যাদা কিংবা শিল্প-সাহিত্যের যে আধেয় তাকে পদদলিত করা হল, আনুগত্যই হল রাষ্ট্রের মাঝে সব কিছুর চালিকা শক্তি। এইরকম দুঃসময়ে কোনো লেখকই তার নিজের লেখাটি লিখতে পারে না, রাষ্ট্রের শ্যেণচুক্ষু তাকে পাহারা দিয়ে রাখে। সেই পাহারা থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারাটা লেখকের জন্য হয়ে উঠে আরেক নতুন জীবন পাওয়ার স্বাদ। এই সময় ‘স্বাভাবিকভাবেই বুদ্ধিজীবীদের চিন্তায় একটি নতুন আদর্শ- রূপলাভ করতে লাগলোÑ তা হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক আদর্শবাদ। সকল নৈরাশ্যের সামনে এই সমাজতান্ত্রিক আদর্শবাদ উপস্থিত হল একটি আশার প্রতীক হিসেবে। প্রকৃত প্রস্তাবে, এই সময় শিল্প-ক্ষেত্রে যে অভিব্যক্তিবাদ বা এক্সপ্রেসনিজমের জন্ম তা এ কালের অসীম যন্ত্রণারই ফলশ্রুতি’।
এ অসীম যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যুদ্ধোত্তোর কালে জার্মান সাহিত্য তার প্রকৃত ও নিজস্ব অবস্থানে ফিরে আসে। লেখকরা ফিরে পায় স্বাধীন মাটি ও মুক্ত আকাশ। তখন থেকেই জীবন ও জগত নিয়ে তাদের যে ভীতি ও বিতৃষ্ণা তা দূর হতে লাগল। শিল্পের জন্য শিল্পের বদলে তারা রচনা করতে থাকেন জীবন ঘনিষ্ঠ সাহিত্য। যুদ্ধ তাদের জীবনে নিয়ে এলো নতুন বোধ ও নানামুখি পরিবর্তন। যে সমাজে তারা বড় হয়েছিলেন সে সমাজের সমস্ত মূল্যবোধ তাদের চোখের সামনে ভঙ্গে-চুরে গিয়েছিল। জার্মান সাহিত্যের যুদ্ধোত্তোর সময়ের পরবর্তী ইতিহাস তাই নানান বৈচিত্র বর্ণ ও নানান স্বাদের। এ সময় পরিব্যাপ্ত হতে থাকে জার্মান সাহিত্য এবং গড়ে ওঠে একাধিক সাহিত্য আন্দোলন, অনেকগুলো লেখক গোষ্ঠি। যুদ্ধের করুণ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে জার্মান লেখকদের কয়েকজন মিলে গড়ে তুলেন গ্রুপ- ৪৭ নামক একটি মুভমেন্ট। যা পঞ্চাশের দশকে এসে ব্যাপক প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই গ্রুপ থেকে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন হাইনরিশ বোয়েল, ইলজে আইখইনগার, হুর্বাট ফিক্টে এবং অবশ্যই গ্যুন্টার গাস। সমালোচকদের মতে গ্রুপ ৪৭ এর মাধ্যমে সবচেয়ে বড় আবিষ্কার হল কবি, উপন্যাসিক, চিত্রকর গ্যুন্টার গ্রাস ও হাইনরিশ বোয়েল। গ্রুপ ৪৭ এর হাত ধরে জার্মান সাহিত্য নতুন করে আবার প্রাণ ফিরে পেল। ‘গ্রুপ ৪৭ এর যেটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট তা হচ্ছে তাঁদের মনোভঙ্গি ও উদারতা’। অভিব্যক্তিবাদের ধারায় অনেকে যেমন- মুসিল রোখ, ডবলিন নতুন করে পরিচিত হতে লাগলেন। ‘এই সময়ের অনেক জার্মান লেখকের ওপর ‘কাফকা’র কমবেশি প্রভাব লক্ষযোগ্য।’ সমালোচকরা বোয়েল কে সামনে রেখেও মত দিচ্ছেনÑ এই সময়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য লেখক হচ্ছেন গ্যুন্টার গ্রাস। তাঁর রচনায় জীবনের নানান বৈচিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গ্রাস যে লেখক হিসেবে অন্যজাতের, ভিন্ন-ঘরনার সেটি বুঝা যায় তার ‘টিনের ঢাক ও কুকুরের বৎসর’ গ্রন্থদ্বয়ের মাধ্যমে। এই দুটি গ্রন্থ এ যাবৎ ত্রিশটি ভাষায় অনুদিত হয়েছে এবং লক্ষ, লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছে ।

মানবতার কল্যাণের জন্য যে লেখক নিষ্ঠাবান, হৃদয়ে ধারণ করে মহত্ত্ব, সে রকম গুরুত্বপূর্ণ লেখকের মৃত্যু অবশ্যই পৃথিবীর জন্য মৌলিক ক্ষতি। গ্রাসের মৃত্যুও পৃথিবীর জন্য তেমনি এক ঘটনা। বর্তমানে সা¤্রাজ্যবাদি বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যে অস্ত্র তৈরি করছে, মাদক তৈরি করছে, কর্পোরেটোক্রেসির সুযোগ সুবিধার মাধ্যমে মানুষকে দাস মনোবৃত্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে, নারীদের প্রসাধনী-পাগল বানাচ্ছে, বাজারের উদ্দেশ্যে টেলিভিশন মিডিয়াগুলো যে ভাবে পণ্যের প্রচারের জন্য নগ্ন হয়ে ওঠছে তা পৃথিবীর জন্য ভয়ঙ্কর এক ফাঁদ। মানুষের কষ্টার্জিত অর্থগুলো তারা ছলনার গোপন কৌশলে সুধে-আসলে শুষে ও নিংড়ে নিচ্ছে। সে সব বহুজাতিক ষড়যন্ত্রের দিকে তীব্র নজর ছিল গ্রাসের। সেই ষড়যন্ত্র বুঝতেন বলেই মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি ব্যথিত ও চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন এবং রাজপথে প্রতিবাদ করতেন। ইউরোপের শ্বেত চামড়ার লেখক হয়েও তিনি মিশতেন সাধারণ নিরীহ মানুষের সঙ্গে। ১৯৮৬ সালে সস্ত্রীক বাংলাদেশ সফর করেছেন তিনি, সেই সময় যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে লালবাগ কেল্লা থেকে শুরু করে বস্তী পর্যন্ত চষে বেড়িয়েছেন। কলকাতা ও বাংলাদেশ ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘সো ইওর টাং’ (জিভ কাটো লজ্জায়) নামে গ্রন্থ লিখেছেন। গ্রন্থটিতে তিনি কলকাতার বিভিন্ন সামাজিক চিত্রের সরাসরি সমালোচনা করেছেন। একজন প্রত্যক্ষদর্শ্যী হিসেবে গ্রাস কলকাতার সংগ্রামী ও লোক-মানুষকে যেভাবে দেখেছেন সেভাবেই বর্ণনা করেছেন তাঁর লেখায়। যার পাল্টা সমালোচনা করেন অনেকে।

প্রাচ্য-প্রতীচ্যের ভাষিক ও বুদ্বিভিত্তক লড়াই বহুদূর বিস্তৃত হয়েছে। প্রাচীন ও সাম্প্রতিক সময়ে প্রতীচ্যে বসবাস করা প্রাচ্যের বুদ্বিজীবীরা তাদের চিন্তাকে সম্প্রসারিত করেছেন এবং প্রতীচ্যের বুদ্বিজীবীরা কি চোখে প্রাচ্যকে দেখেন সে বিষয় নিয়ে অনেকে জল ঘোলা করেছেন। ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ বিস্তারের সঙ্গে চিন্তার সা¤্রাজ্য বিস্তার করে, ইউরোপিয় তথাকথিত বুদ্বিজীবীগণ প্রাচ্যকে খারিজ করে দেন। প্রাচ্যের হৃদয়কে দেখেনে না। প্রতীচ্যের ব্যবহারিক ধর্মবাদীরা প্রাচ্যের হৃদয়বাদী ধর্মকে গুলিয়ে ফেলেন সব-সময়। সেক্ষেত্রেও গ্যুন্টার গ্রাস ছিলেন ব্যতিক্রম। সৃজনশীলতা ও সংবেদনশীলতা চর্চা করতেন বলেই ইউরোপিয় মননশীল বুদ্বিজীবীদের মত করে তিনি প্রাচ্যকে দেখেন নি। তিনি হৃদয় দিয়ে প্রাচ্যকে অনুধাবন করেছিলেন। গ্রাসই ইউরোপিয়ানদের দম্ভকে চূর্ণ করে তার স্বভাব সুলভ ভাষায় বলেছিলেনÑ‘ইউরোপ বড় বেশি একরকমের, বড় বেশি একঘেয়ে’।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তোর জার্মান ভূমি ফুঁড়ে ওঠে আসা শিল্পীর নাম গ্যুন্টার গ্রাস। যুদ্ধের নানান বিভিষীকা ছুঁয়ে ‘টিন ড্রাম’ সময়পর্ব পর্যন্ত জার্মানকে আবারও মানুষের কাছে গ্রহণীয় করে তুলেন তিনি। গ্রাস হয়ে উঠলেন মৌলিক মানবতার পক্ষে এক সাহসী কলম যোদ্ধা। উল্লেখ্য,একজন লেখক যখন প্রতিষ্ঠিত হন, তখন সে কত বড় লেখক সেটি বিবেচ্য থাকে না আর। বিবেচ্য হয়ে ওঠে গণমানুষের পক্ষে তার অবস্থান কি, মানবিক সুন্দরের জন্য তার আকুলতা আছে কিনা ইত্যাদি। গ্যুন্টার গ্রাসের বেলায়ও সেটাই বিবেচ্য। প্রাচ্য-প্রতীচ্যের ভাষিক ও সমর দ্বন্দ্বে গ্রাস গণমানুষের পক্ষে তার অবস্থান শুরুতেই ঘোষণা করেছিলেন। এখানেই তার গুরুত্ব, এই জন্যই তাকে নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনা। ইসরাইলি নৃশংসতার বিরুদ্ধে নির্যাতিত ফিলিস্তিনিদের পক্ষে এই ক’দিন আগেও ‘কতদিন আর মুখ বন্ধ করে রাখব’ নামে কবিতা লিখে ইউরোপসহ সারাবিশ্বে হইচই ফেলে দেন। এরই ফলশ্রুতিতে প্রাচ্যবাদী একদেশদর্শী চিন্তকেরা শেষ বয়সে তাকে একঘরে করে ফেলে। গ্রাসের ব্যাপক সমালোচনা শুরু করেন, নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য সুইডিশ একাডেমিকে চাপ সৃষ্টি করেন। তবু গ্রাস অবিচল দৃঢ়তায় মানবতার পক্ষে শেষ সত্যটি বলে যান এবং সভ্যতার সুবিধাভোগী বুদ্ধিজীবীগণ শ্রেণিস্বার্থে যে বৈষম্য জিইয়ে রেখেছে তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। বলেনÑ‘চুপ করে থাকার সময় নেই আর। কথা বলো- কথা বলো সত্যের পক্ষে। তা না হলে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ অন্ধকার’। সবচেয়ে বড় কথা, ইহুদি-খ্রিষ্টান- হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধচক্র, বহুজাতিক এই কতিপয় উগ্র জনগোষ্ঠির ষড়যন্ত্র নিয়ে কথা বলতেন তিনি এবং সে মোতাবেক সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। যে কারণে গ্রাস পৃথিবীর জন্য মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ এককথক ও সমালোচক।

যুদ্ধোত্তোর কালে জার্মানি তাঁর ধ্বংসস্তুপের ওপর দিয়ে নতুন স্বপ্নসৌধ নির্মাণ করেছে। আর এই নির্মাণের পেছনে যারা ভাষা-শ্রমিকের ভূমিকায় অবর্তীণ হয়েছিলেন তাঁরা ঐ মাটিরই সংবেদনশীল সন্তান। জর্মান রাষ্ট্র ও সমাজের আচারিত সংস্কৃতি হতাশার অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হলেও সেই সীমাহীন হতাশা কাটিয়ে একটি নান্দনিক বাস্তবতার সন্ধানে আশার আলো নিয়ে এগিয়ে গেছে। ‘জীবনের অনন্ত ধারা সকল বাধা ও বিপত্তিকে যে শেষ পর্যন্ত অতিক্রম করে চলতে থাকে তারই কথা বর্তমান জার্মান সাহিত্যে উপজীব্য। অতীতের সকল কালিমা এবং বিপর্যয়ের যেন চিরকালের জন্যে হারিয়ে যায় অনন্তে, তা যেন আর কোনদিন ফিরে না আসে তারই সাধনা চলে সাম্প্রতিক জার্মান সাহিত্যে’। আর এই সাহিত্য বিনির্মাণের পেছনে গ্রুপ- ৪৭ এর ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। গ্রাস সেই ভূমিকা পালনকারী জার্মানির শ্রেষ্ঠ সন্তানদেরই একজন। ।

ব্যক্তি জীবনেও বহুমুখি সংঘাতের মধ্য দিয়ে গ্রাসকে অগ্রসর হতে হয়েছে। ‘একজন লেখককে শুধু তার অর্জন দিয়ে মাপলে হয় না, তিনি কি ধরনের বাধা ও বিপদ মোকাবেলা করেছেন, কিভাবে জীবন যাপন করেছেন, কিভাবে ভাষাশৈলীকে ভেঙ্গে-চুরে বিনির্মাণ করেছেন, সার্বিক বিচারে এই বিষয়গুলোও বিবেচনায় নিতে হয় এবং তা-ই হয় ঐ লেখকের মানদ-।

মৃত্যুর আগে গ্রাস ঢাকার জেনেভা ক্যাম্প, কলকাতার সামাজিক প্রকল্প, ভেনেজুয়েলার সংকটাপন্ন মহিলাদের জন্য নিবেদিত সংস্থাসহ বহু প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক ও মানসিক সাহায্য দিয়েছেন। গ্রাস নির্যাতিত ও দলিত বিপন্ন মানুষের সহযোগিতায় সবসময় এগিয়ে আসতেন। এবং প্রতিশ্রুতিশীল লেখক শিল্পীদের ক্ষেত্রেও সহযোগিতার হাত প্রসারিত রাখতেন । ছিলেন বড় রাজনীতিবীদ। এসডিপি’র নির্বাচনে বিজয়ের পর উইলি ব্রান্ট একসময় গ্রাসকে মন্ত্রী হতে অনুরোধ করেন, অন্তত সংস্কৃতিবিষয়ক প্রধান হতে বলেন। গ্রাস সে অনুরোধ সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যাখান করেন।
গ্রাস অনেকগুলো উপন্যাস ও ভ্রমণবিষয়ক গ্রন্থ ও কাব্য রচনা করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যÑ দি টিন ড্রাম, ক্যাটস এন্ড মাউস, ডগ ইয়ারস, লোকাল এ্যানেসথেটিক, দি প্লেবিয়ানস্ রিহার্স দি অপরাইজিং’ মাইন ইয়ার হন্ডার্ট’ ‘দি কল অব দ্য টোড’ ইত্যাদি।


শেয়ার করুন