কবিরা স্বপ্নের অনুপম সৃজনকর্তা

আতিক সুজন

সবাই চেয়েছে আমি বিসিএস দিই। এমনকি তুমিও তাই চেয়েছো। কিন্তু কতোবার বলেছি, বিসিএস দিতে আমি ধরাপৃষ্ঠে আসিনি। এসেছি একটি কালজয়ী কবিতা লিখতে। যে কবিতার একটি লাইন হবে ‘ভিকারুন্নেছা নুন স্কুল এণ্ড কলেজ’। যে কবিতার একটি লাইন হবে তোমার নামে। যে কবিতাটি ছাপতে চাইবে না কোনো পত্রিকার সম্পাদক। পড়তে চাইবে না কোনো মসজিদের ইমাম। ছিঁড়ে টুকরোটুকরো করে ছুঁড়ে ফেলবেন আমার শ্রদ্ধেয় জনক। কবিতায় তোমার নামধাম উল্লেখ থাকবে বলে আদালতে মামলা ঠুকবেন তোমার বাবা। পুলিশ এসে হ্যাণ্ডকাপ পরাবে আমার হাতে। নিয়ে যাবে আদালতে। তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করবেন বিজ্ঞ আদালত। পুলিশ আমার পশ্চাৎদেশে বেত্রাঘাত করে যা-ই জানতে চাইবেন— আমি কেবল তোমার নামই জপে যাবো। অগত্যা সাতবছর জেল। কনডেম সেল; অতঃপর মুক্তি। জেলগেটে দেখবো একদল লোক প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তাতে লেখা আছে একজন প্রেমিক কবির মুক্তির দাবিতে জোরালো স্লোগান। লেখা আছে ম-বর্গে বিশেষ দৃষ্টিনন্দন হরফে কবির নামও। অথচ কেউই আমাকে চিনবে না। আমি একা একা হেসে কেঁদে সমবেত জনতাকে পাশ কেটে চলে যাবো। আমার দৃষ্টিপথে ভাসবে সাতবছর পূর্বেকার তিক্ত-মধুর স্মৃতি।
.
কবিরা স্বপ্নের অনুপম সৃজনকর্তা। কিন্তু সেই কবিতাটি লেখার পর আমার সকল স্বপ্ন-সম্ভার ফুরিয়ে যাবে। আমি মরণোন্মুখ ব্লু-হোয়েল হয়ে উঠবো। গাছতলায় আধশোয়া আমাকে দেখে মুর্খেরা বলবে ‘খাজাবাবা’ আর তরুণেরা বলবে ‘বদ্ধপাগল’। তারুণ্যের হাস্যরসই আমাকে বেশি পোড়াবে।
.
কালজয়ী সেই কবিতাটি লেখার বহুদিনপর একদিন— কেউ একজন এককালের তরুণ কবি এবং বর্তমানের বদ্ধপাগলকে করুণা করে পত্রিকার ছেঁড়া কাগজ মুড়িয়ে একঠোঙ্গা ঝালমুড়ি খেতে দিবে। আমি খেতে গিয়ে আঁৎকে উঠবো পত্রিকার সেই ছেঁড়া পাতায় নিজের সম্পর্কে পাতাজুড়ে ইতিবাচক লেখা এবং ছবি দেখে। অতঃপর নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে চিরতরে নীল হয়ে যাবো আমি। হাসপাতালের মর্গে এসে তুমিই শনাক্ত করবে আমায়। বিলাপ করে বলবে— “ওগো, তোমার কারামুক্তির জন্য আমি নারীবাদী আন্দোলন ছেড়ে ‘কবিবাদী’ আন্দোলন করে আসছি। আর তুমি কিনা এইভাবে মুক্ত হলে! তোমার মুক্তির জন্য শহরের দেয়ালে দেয়ালে ‘ওয়াল রাইটিং’ করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভরা অডিটোরিয়ামে আবৃত্তি করেছি তোমার নিষিদ্ধ কবিতার পঙক্তিমালা। আর তুমি কিনা…!’
আমার জানাযা এবং কবরস্থ করা নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু হবে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি আসবেন আমার জানাযায়। সুযোগ পেয়ে এক কালের ক্ষমতাসীন এবং বর্তমানের প্রতাপশালী বিরোধীদলের গোষ্ঠী উদ্ধার করে বক্তৃতা ঝারবেন মাননীয় হোম মিনিস্টার। ভক্তিতে গদগদ হয়ে চশমার কাঁচ মুছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবেন তথাকথিত জাতীয় দৈনিকের মেরুদণ্ডহীন সম্পাদকগণ। অসংখ্য মিডিয়ায় প্রচার হবে আমার কালজয়ী কবিতা। যা গায়ের জোরে নিষিদ্ধ করেছিল বিগত সরকার ।
.
এবার নিশ্চয় বুঝেছো প্রিয়তমা। সার্টিফিকেট ঝুলানোর জন্য কবিরা জন্মে না।
কীটস্ জন্মেনি, সুকান্ত জন্মেনি, নজরুল জন্মেনি….।
প্রিয়তমা, সেই কবিতাটি লিখবো বলে বিসিএসের ধার ধারিনি!


শেয়ার করুন