কক্সবাজারে ২ কোটি টাকা আত্মসাতে অভিযুক্ত সেই শিক্ষক জেলায় শ্রেষ্ঠ!

ডেস্ক নিউজ:
কক্সবাজারে ঈদগাঁওয়ের প্রাচীনতম বিদ্যাপীঠ ঈদগাহ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের বিভিন্ন খাত থেকে পৌনে ২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠা প্রধান শিক্ষক খুরশীদুল জান্নাতই কক্সবাজার উপজেলা ও জেলার শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।

সদ্য ঘোষিত জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক হিসেবে নাম ঘোষণা করা হয়েছে। এরপর এই শিক্ষককে এ নিয়ে এলাকাজুড়ে হাসিঠাট্টা হচ্ছে।

এর আগে খুরশীদুল জান্নাতের বিরুদ্ধে বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির চার সদস্য ঈদগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছৈয়দ আলম, শহিদ উল্লাহ মিয়াজী, এসএম সরওয়ার কামাল ও রমজান আলী লিখিতভাবে শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা উপমন্ত্রী, দুর্নীতি দমন কমিশন, কক্সবাজার জেলা প্রশাসক, জেলা শিক্ষা অফিসার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারসহ বিভিন্ন দপ্তরে ওই শিক্ষকের অনিয়মের ফিরিস্তি উল্লেখ করে অভিযোগ দেন।

পরিপ্রেক্ষিতে উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে উপজেলা প্রশাসন। যদিও সব অভিযোগ অস্বীকার করে ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেছেন খুরশীদুল জান্নাত।

অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে খুরশীদুল জান্নাত বিদ্যালয়ের প্রায় এক কোটি আটাত্তর লাখ সত্তর হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রফিডেন্ড ফান্ড থেকে ২৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা, প্রশংসাপত্র, বোর্ড সার্টিফিকেট ও প্রত্যয়নপত্র খাত থেকে ২৫ লাখ টাকা, বিদ্যালয় মার্কেটের ৩৩টি দোকান বরাদ্দে সালামির অতিরিক্ত বিনা রশিদে ৩৩ লাখ টাকা, বিগত পাঁচ বছরে উন্নয়ন কমিটিবিহীন এবং বিনা টেন্ডারে উন্নয়নের নামে ৩০ লাখ টাকা, ২০২২ সালে বিধিবহির্ভূতভাবে বিনা রশিদে পুনঃভর্তি ফি তিন লাখ টাকা, বিনা রশিদে তিন বছর একটি দোকানের ভাড়া এক লাখ ৮০হাজার টাকা, ২০২২ ও ২০২৩ সালের ভর্তি ফরম বাবদ দুই লাখ টাকা, ২০২২ সালে শুদ্ধ উচ্চারণ প্রশিক্ষণ থেকে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা, ২০২২ সালে জেএসসি এবং এসএসসি রেজিস্ট্রেশনে অতিরিক্ত নেওয়া দুই লাখ টাকা, ২০২৩ সালের ১৫০ জন এসএসসি পরীক্ষার্থী থেকে জামানত হিসেবে নেওয়া পাঁচ লাখ টাকা, ২০২৩ সালের এসএসসি ফরম পূরণে অতিরিক্ত নেওয়া এক লাখ টাকা এবং ২০২৩ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের জোরপূর্বক এনে হোস্টেল বাণিজ্য থেকে এক লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

এ ছাড়া বিদ্যালয়ে সংযুক্ত উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর বিনা রশিদে নেওয়া সহায়তা ফি দুই লাখ টাকা, শিক্ষার্থীদের জুতা ও টেইলার্স সিলেকশন বাবদ উৎকোচ গ্রহণ ৫০ হাজার টাকা, বই রাখার শোকেস কেনার জন্য ২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের দেওয়া উপহারের ৪০ হাজার টাকা, ২০১০ সাল থেকে শিক্ষক কল্যাণ তহবিলের তিন লাখ টাকা, এসএসসি ব্যবহারিকের সময় বিধিবহির্ভূতভাবে নেওয়া এক লাখ টাকা, গোপনে সহকারী গ্রন্থাগারিক, ল্যাব সহকারী ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগে উৎকোচ নেওয়া চার লাখ টাকা, এনটিআরসিএ কর্তৃক নিয়োগকৃত শিক্ষকদের ফাইল প্রসেসিংয়ের নামে আটজন শিক্ষক থেকে নেওয়া চার লাখ টাকা, ২০১৫ সাল থেকে শিক্ষার্থীদের আইডি কার্ড, প্রবেশপত্র খাত থেকে ১০ লাখ টাকা, বিদ্যালয় মার্কেটের একটি অংশের দ্বিতীয় তলা বিনা টেন্ডারে নির্মাণ ও সালামি থেকে ২৫ লাখ টাকাসহ প্রায় দুই কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে।

এদিকে করোনার সময় স্কুল বন্ধ থাকার সুযোগে বিদ্যালয়ের শেখ রাসেল হাউসে গরুর খামার করেছেন প্রধান শিক্ষক খুরশীদুল। বিদ্যালয় মাঠের দক্ষিণ-পূর্ব কোণায় অবস্থিত শেখ রাসেল হাউসের নিচতলা, ঢালু সিঁড়ি ও ওপর তলায় গরু পালন করে সমালোচিত হন এ শিক্ষক।

অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, আগে আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকলেও খুরশীদুল জান্নাত বিদ্যালয়ে নিয়োগের পর বর্তমানে কক্সবাজার মডেল থানার পেছনে কোবা টাওয়ারে অর্ধকোটি টাকা দামের ফ্ল্যাট কিনে বিলাসী জীবনযাপন করছেন। তিনি বাসা থেকে ৩৩ কিলোমিটার দূরের স্কুলে আসা-যাওয়ায় প্রতিদিন রিজার্ভ ট্যাক্সি ব্যবহার করেন। স্কুলের টাকায় তিনি এসব করছেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ঈদগাহ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক জানান, খুরশীদুল জান্নাত খুবই কৌশলী। তিনি তার ব্যাপক দুর্নীতি আড়াল করতে স্কুলের উন্নয়নসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও চোখে পড়ার মতোই ব্যতিক্রম কিছুই করেন সব সময়, যা তদন্ত করলে বের হয়ে আসবে।

বিদ্যালয়ের দোকান মার্কেটের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ব্যবসায়ীর অভিযোগ— বিদ্যালয়ের দোকান মার্কেটটি নতুনভাবে নির্মাণের পর তাদের ভাড়া দেওয়া প্রত্যেক দোকান থেকে সালামি বাবদ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মোট ছয় লাখ টাকা করে নেয়। কিন্তু দোকানের চুক্তিপত্রে পাঁচ লাখ টাকা দেওয়ার কথা উল্লেখ আছে। অপর ১ এক লাখ টাকার কোন রশিদ ব্যবসায়ীদের দেওয়া হয়নি।
বিভিন্ন খ্যাত থেকে বিদ্যালয়ের পৌণে দুই কোটি টাকা আত্মসাতের বিষয়ে জানতে চাইলে সব অভিযোগ অস্বীকার করে খুরশীদুল জান্নাত যুগান্তরকে বলেন, এসব আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটির সদস্যরা স্কুল পরিদর্শন করেছেন। আমাকে এবং অভিযোগকারীদেরও ডেকেছিল। তারা তদন্তকারী দলকে দালিলিক কোনো ডকুমেন্ট দিতে পারেনি।

জেলা শিক্ষা অফিসার মো. নাছির উদ্দিন বলেন, ঈদগাহ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালেয়র প্রধান শিক্ষককের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে আমি অবগত রয়েছি। উপজেলা থেকে এটি তদন্ত চলছে। সংশ্লিষ্টদের দ্রুত তদন্ত শেষ করতে বলা হয়েছে। যাতে করে দোষী হলে শান্তি নিশ্চিত করা যায় এবং নির্দোষ হলে যেন অভিযোগ থেকে দ্রুত মুক্তি দেওয়া যায়। অভিযোগ ও শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচন দুই ভিন্ন বিষয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. জাকারিয়া যুগান্তরকে বলেন, ঈদগাহ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককের বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগের ভিক্তিতে ইতোমধ্যে উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে প্রধান করে তিন সদস্যদের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে উপজেলা শিক্ষা অফিসারের বদলি হয়ে যায়। নতুন যিনি জয়েন্ট করেছেন তাকে এ বিষয়ে দ্রুত তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
— দৈনিক যুগান্তর


শেয়ার করুন