কক্সবাজারের ইয়াবা ব্যবসায়ীদের ব্যাংক হিসাব শূন্য

ফাইল ছবি

ডেস্ক নিউজঃ

ভয়ংকর মাদক ইয়াবার কারবার করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া কারবারিরা সুযোগ পেয়ে তাঁদের অবৈধ টাকা বিভিন্ন কৌশলে সরিয়ে ফেলেছেন। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুয়ায়ী, শীর্ষ ইয়াবা কারবারিদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের মামলার মাধ্যমে সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার কথা থাকলেও সেই প্রক্রিয়া এগোয়নি। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, কক্সবাজারের ১২৩ কারবারি আত্মসমপর্ণের পর তদন্তের মাধ্যমে তাঁদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে আর্থিকভাবে অচল করে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু এরই মধ্যে ২৭ আত্মসমর্পণকারীসহ অন্তত ৪০ কারবারি জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। দীর্ঘ সময় পরে মাত্র ১২ জনের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের মামলা হয়েছে, যাঁদের ব্যাংকে নেই কোনো টাকা! আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ৭৩ শীর্ষ কারবারির মধ্যে ৪০ জন আত্মসমর্পণই করেননি।
সবার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ এবং সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার প্রক্রিয়াও স্তিমিত। আর্থিক তদন্তের বাইরে রয়েছেন অর্ধশতাধিক ইয়াবা গডফাদার। শীর্ষ ইয়াবা কারবারিরা দাপটের সঙ্গে এলাকায় ফিরেছেন। অনেকে জনপ্রতিনিধি হওয়ার জন্য বিপুল পরিমাণ টাকাও খরচ করছেন।
কক্সবাজারের একাধিক সূত্র বলছে, বিশেষ অভিযান শুরু হলে শীর্ষ ইয়াবা কারবারিরা টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ কিছু ব্যক্তিকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আত্মরক্ষার সুযোগ পান। সুযোগ পেয়ে অনেকে হুন্ডির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে টাকা পাচার করেছেন। দিয়েছেন স্বজনদের। অনেকে বাড়ি ও জমিও অন্যের নামে লিখে দিয়েছেন। কার্যকর তদন্ত হলে এসব বেরিয়ে আসবে বলে জানায় সূত্র।

২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ১০২ জন এবং গত বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি ২১ জন কারবারি আত্মসমর্পণ করেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৭৩ শীর্ষ কারবারির তালিকা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২৪ জন প্রথম দফায় আত্মসমর্পণ করেন। তালিকায় ২ নম্বরে থাকা হাজি সাইফুল করিমসহ ৯ জন পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। দ্বিতীয় দফায় আত্মসমর্পণ করা ২১ জনের মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ের কেউ নেই। গত বছরের ৩১ জুলাই মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খুনের পরে অভিযানে ভাটা পরে। আত্মসমর্পণের সময় কারবারিরা তিন লাখ পিস ইয়াবা এবং ৩০টি আগ্নেয়াস্ত্র জমা দেন পুলিশের হাতে। সেই অস্ত্র ও মাদক মামলায় গত বছরই ২৭ জন জামিন পেয়েছেন। আত্মসমর্পণের সময়ই কারবারিদের অর্জিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত এবং ব্যাংক হিসাব জব্দ করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। তবে ওই নির্দেশনা কিছুটা বাস্তবায়ন করতেই লেগেছে এক বছর! ১২৩ কারবারির মধ্যে ১২ জনের বিরুদ্ধে গত বছরের ২১ মার্চ মানি লন্ডারিং মামলা করে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তাঁদের কোটি টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া গেলেও মেলেনি টাকার হদিস। প্রথম দফায় ২০ কারবারির বিরুদ্ধে শুরু হয়েছিল আর্থিক অনুসন্ধান। পরে অন্যদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করে মামলা করার কথা থাকলেও তা আর করা হয়নি।

সিআইডি সূত্র জানায়, যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে তাঁরা হলেন টেকনাফের বাসিন্দা সাবেক এমপি বদির সত্ভাই আবদুল শুক্কুর, শফিকুল ইসলাম, ফয়সাল রহমান ও আপন বড় ভাই আবদুল আমিন ওরফে আমিনুর, হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য নুরুল হুদা ও তাঁর ভাই নুরুল কবীর, টেকনাফ সদরের ইউপি সদস্য এনামুল হক, শীর্ষ ইয়াবা কারবারি একরাম ও তাঁর ভাই আব্দুর রহমান, হ্নীলা ইউপি সদস্য জামাল হোসেন ও তাঁর ছেলে শাহ আজম ও মোহাম্মদ আলী। বদির সত্ভাই শুক্কুর ইয়াবার এক কোটি ৩০ লাখ টাকায় সম্পদ কিনেছেন। তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য থাকলেও টাকা নেই। আমিনুরের অ্যাকাউন্টেও নেই টাকা। নুরুল কবীরের ১৯টি জমির তথ্য মিলেছে, যার মূল্য কমপক্ষে তিন কোটি ৫১ লাখ ১৮ হাজার টাকা। একরাম হোসেনের প্রায় ৭০ লাখ টাকা মূল্যের জমির সন্ধান মিলেছে। ইউপি সদস্য জামালের ৮০ শতাংশ জমি পাওয়া গেছে, যার মূল্য ১৯ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। মোহাম্মদ আলীর প্রায় এক একর জমি ও বিলাসবহুল গাড়ি আছে। ইউপি সদস্য নুরুল হুদার ৮২ লাখ টাকার জমি এবং আরো কিছু সম্পদের খোঁজ মিলেছে। আব্দুর রহমানের জমি আছে কমপক্ষে ৪৩ লাখ টাকার। নুরুল হুদার দুটি হিসাব নম্বরের একটিতে পাওয়া যায় মাত্র আট হাজার ৪০৫ টাকা এবং আরেকটিতে তিন হাজার ২৪১ টাকা রয়েছে। এনামুলের একটি হিসাব নম্বরে সাত হাজার ৩৫২ টাকা আছে। এই ইয়াবা কারবারিরা বিত্তশালী হিসেবেই পরিচিত। কৌশলে নিজেদের নামের ব্যাংক হিসাবে তাঁরা বেশি টাকা জমা রাখেননি।
জানতে চাইলে সিআইডির পুলিশ সুপার (এস এস) মোস্তফা কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মানি লন্ডারিংয়ের মামলা করার জন্য প্রথমে অনুসন্ধান করতে হয়। এতে সময় লাগে। আমরা অনুসন্ধান করে কয়েকটি মামলা করেছি। তদন্তপ্রক্রিয়া চলছে।’

স্থানীয় লোকজন বলছে, সুযোগ পেয়ে টাকা ও সম্পদ সরিয়েছেন ইয়াবা কারবারিরা। আব্দুর রহমান বদি, তাঁর ভাই মৌলভি মুজিবুর রহমানসহ অনেকের বিরুদ্ধে আর্থিক তদন্ত হয়নি। তাঁরা নিজেদের নির্দোষ প্রমাণে অনেকটা সফল! এলাকায় ফিরে ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার নির্বাচনে জয়ী হতে অবৈধ টাকা ছড়াচ্ছেন কয়েকজন। টেকনাফ পৌরসভার মেয়র হতে পোস্টারে সাঁটাচ্ছেন শুক্কুর। জামিন পাওয়া সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহানও নির্বাচনে নেমেছেন। হুন্ডি জাফর ওরফে টিটি জাফরের ভাই মনিরুজ্জামান ও জুয়াবের টেকনাফ পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী। ৭ নম্বর ওয়ার্ডে ফের কাউন্সিলর প্রার্থী হচ্ছেন মৌলভি মুজিবুর রহমান। এ ছাড়া নির্বাচনে নেমেছেন সদর ইউনিয়নের সদস্য হামজামাল, জিয়াউর রহমান, এনামুল হক, সাবরাং ইউপি সদস্য রেজাউল করিম, হ্নীলার ইউপি সদস্য নুরুল হুদা ও জামাল হোসেন এবং টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর নুরুল বশর নুরশাদ।

টেকনাফ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর বলেন, ‘ইয়াবা কারবারিদের লোক-দেখানো আত্মসমর্পণ এবং তাদের ফিরে আসায় সবই যেন আগের মতো মনে হচ্ছে। তাদের ক্রসফয়ার থেকে বাঁচাতেই আত্মসমসর্পণ করিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। হয়তো টাকা-পয়সার প্রমাণ গায়েব করারও সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তদন্ত হলে ঠিকই বের হবে।’

পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘তারা আইনগত প্রক্রিয়ায় আদালত থেকে জামিন পেতে পারে। তবে আমরা দেখব, তারা আবার ইয়াবা ব্যবসা করছে কি না। সে ব্যাপারে পুলিশের নজরদারি আছে।’

–সুত্র: কালের কন্ঠ


শেয়ার করুন