উল্টো রথে এসে আজ রায় দিতে হচ্ছে

ঐশীর বিচারক : এ রায় ঘোষণা আমার জন্য কঠিন

125066_1সিটিএন ডেস্ক :

মাদকাসক্তির ভবিষ্যৎ ফল কতটা ভয়াবহ ও নির্মম হতে পারে তার দৃষ্টান্ত হয়েছে নিজ বাবা-মা (মাহফুজুর রহমান ও স্বপ্না রহমান) হত্যায় দু’বার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ঐশী রহমান। রায় ঘোষণার সময় ঐশীর মাদকাসক্তির বিষয়টি না উঠলেও এর ফলে সৃষ্ট হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করেই আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করেন। কারণ মুক্ত মাদকাসক্তে বাধা প্রদানের কারণেই ঐশী খুনের পথ বেছে নেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথমে মাকে এবং পরে বাবাকে হত্যা করে সে। তাই ঐশীর মতো মাদকাসক্তে যারা নিজেদেরকে জড়িয়েছে তাদের কাছে এ রায়টি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে মনে করেন অনেকে।

মামলার সূত্র থেকে জানা যায়, অষ্টম শ্রেণী থেকেই ঐশী মাদক গ্রহণ শুরু করে ক্রমেই বিপথগামী হতে থাকে। পরে তার মাদক গ্রহণ ও উচ্ছৃঙ্খল আচরণ অতিমাত্রায় বেড়ে যায়। হেরোইন, প্যাথেডিন ইঞ্জেকশন, ইয়াবা, অ্যালকোহল এমনকি গাঁজা সেবনেও অভ্যস্ত ছিল সে। এসব কারণেই প্রতিমাসে নতুন নতুন কৌশলে বাবা-মাকে বলে হাত খরচ হিসেবে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিত ঐশী। তবে শত চেষ্টা করেও বাবা-মা তাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হন। যে কারণে বাবা-মার সঙ্গে বিরোধ তৈরি হয়। তাই পরিকল্পনা অনুযায়ী সে তার বাবা-মাকে হত্যা করে।

আদালত তার রায় পর্যবেক্ষণেও এই হত্যার ঘটনাকে ‘পরিকল্পিত’ বলে উল্লেখ করেন। সে কারণেই এ অপরাধের ভয়াবহতা বুঝাতে আদালত তার রায়ে মামলার প্রধান আসামি ঐশী রহমানকে দু’টি পৃথক সাজা দিয়েছেন। আর এই সাজায় তাকে ডাবাল মৃত্যুদণ্ড, ২০ হাজার করে জারিমানা অনাদায়ে এক বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। শুধু তাই নয়। এই রায় কার্যকর করতে আসামির মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তাকে ঝুলিয়ে রাখতে বলেছেন আদালত।

আদালত বলেন, এই মামলা তদন্তের সময় আসামি (ঐশী) স্বীকারোক্তি দেয়নি। বরং রিমান্ডে নিয়ে তার স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে। তবে এই মামলায় বাবা–মাকে কফি খাইয়ে অজ্ঞান করার বিষয়টি আদালত বিবেচনায় নেয়নি।

রায়পূর্ব ঢাকা মহানগর দায়রা আদালত প্রাঙ্গণেজুড়ে ঐশীর রায় নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করতে দেখা যায় উপস্থিত জনতাকে। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩ এর রায় শোনার পরও জনতার সেই বিরূপতা মোটেও কমে যায়নি। বরং এ রায়ের ফলে ভবিষ্যতে পরিবারগুলো সন্তান লালন-পালনে আরো সতর্ক হবেন বলে অনেকের ধারণা।

এসময় আদালত প্রাঙ্গণে উপস্থিত এক বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম বাংলামেইলকে বলেন, ‘আদালতের রায়টি আমাদের সমাজের জন্য দৃষ্টান্ত হবে বলে মনে করি। কারণ, দিন দিন সমাজে মাদকের প্রভাব বাড়ছে। মাদকের ব্যবহারে সুদূর ভবিষ্যৎ কতোটা ভয়াবহ হতে পারে তা এই রায়ের মাধ্যমে উঠে এসেছে। শুধু এই মামলার ক্ষেত্রেই নয়। মাদকের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত সবার বিচার এভাবে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে শেষ করা উচিৎ। তাহলে আমাদের সমাজে এমন নির্মমতা অনেকটাই কমে আসবে।’

আহমেদ রিয়াজ নামের এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র বলেন, ‘মাদক থেকে সবসময়ই দূরে থাকার চেষ্টা করি। তবে সমাজের কিছু লোক থাকে যারা এই মাদককে ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে সুবিধা ভোগ করে। মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের সমাজে আরো প্রচার-প্রচারণা চালানো উচিৎ। নইলে ঐশীর মতো ঘটনা আগামীতে ঘরে ঘরে ঘটতে থাকবে। আর আমাদের বাবা-মায়েরাও আমাদের ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলবে।’

এ মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘মাদকাসক্তির সঙ্গে জড়িত থাকলেও ঐশীর মামলার সাক্ষ্য ও যুক্তি উপস্থাপনে সেই বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়নি। তবে আদালত বলেছেন এটি পরিকল্পিত ঘটনা। তাই খুনের দায়ে তাকে এই সাজা দিয়েছেন।’

তবে এর উল্টোটাই ভাবছেন ঐশীর আইনজীবী মাহবুব হাসান রানা। তার ভাষায়, ‘কোনো দৃষ্টান্ত নয়। এ রায়টি হাইকোর্টে টিকবে না। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে। সেখানে মামলার আসামিরা খালাস পাবেন।’

তিনি বাংলামেইলকে বলেন, ‘মামলাটিতে ঐশীর বয়স বিভ্রান্তে ডিএনএ টেস্ট করানো হয়েছে। তবে ডিএনএ টেস্টের জন্য ছয়টি এক্স-রে করানোর প্রয়োজন হয়। অথচ রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা মাত্র দুটি টেস্ট করে ডকুমেন্ট আদালতে দিয়েছেন। আর আদালত তাদের ডকুমেন্টের ওপর নির্ভর করেই এই রায় দিয়েছেন। এছাড়া আদালত আমাদের দাখিলকৃত বয়স প্রমাণের বিভিন্ন সার্টিফিকেট আমলে নেননি।’

রায়ে এ প্রসঙ্গে বিচারক সাঈদ আহমেদ বলেছেন, ‘যেখানে শিশু ও নারী নির্যাতন দমনের পক্ষে আমাকে রায় দিতে হয় সেখানে উল্টো রথে এসে আজ এই মামলায় আমাকে রায় দিতে হচ্ছে। এটা আমার জন্য কঠিন।’

পর্যবেক্ষণে তিনি বলেন, ‘আমি বয়সের চিন্তা করেছি। এবং তার (ঐশীর) প্রকৃত বয়স পেয়ে গেছি। ২০১৩ সালের শিশু আইন অনুসারেই তার বয়স ধরা হয়েছে। আমার পর্যবেক্ষণে ঘটনার সময় তিনি সাবালক হিসেবে এসেছেন।’ তবে তখন ঐশীর বয়স কত ছিল সে বিষয়ে আদালত স্পষ্ট কিছু বলেননি।


শেয়ার করুন