এসো হে বৈশাখ এসো এসো

আরিফ সোহেল

জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, বয়স নির্বিশেষে সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিতে পারেন, এমন এক উৎসব বাংলা নববর্ষ। এই বাংলায় হাজার বছর ধরে বাংলা ও বাঙালীর যে পথ চলা, তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে পয়লা বৈশাখ। এটি পরিণত হয়েছে বাঙালী সংস্কৃতি ও লোকজ-ঐতিহ্যের অংশ। বাংলা সনের প্রথম এই দিনটি বাঙালীর লোকায়ত জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পৃত্ত হয়ে আছে। এই দিনটি আসে শুভ বারতা নিয়ে। আসে আনন্দ-উল্লাসের উপলক্ষ্য হয়ে। আসে বাঙালীয়ানায় দীক্ষা দিতে। এই দিনটিতে অনুভব করতে পারি, আমরা লোকায়ত গৌরবোজ্জ্বল এক ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অধিকারী। সেই ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে আছে আমাদের জীবনযাপনের নানা উপাদান।

শুধু বৈশাখই নয়; বাঙালীর জীবনে উৎসবের শেষ নেই। তবে অধিকাংশ উৎসবই নির্দিষ্ট একটি গণ্ডিতে বাঁধা। তাতে নেই সর্বজনীনতা। হয়ত কোনো দিনে এক গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় উৎসব করছেন। অনেকেই উৎসবে সম্পৃত্ত হতে পারছেন না। অন্যদের উৎসব দেখে প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যান। আবার কঠিন বাস্তবতার কথাও মানতে হবে। আর্থিক কারণেও সমাজের উল্লেখযোগ্য জনগোষ্ঠীকে উৎসব বা অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া থেকে বঞ্চিত হন। এতে সমগ্র দেশের জনগণের মধ্যে আত্মিক বন্ধন গড়ে ওঠে না। নিবিড় ও ঘনিষ্ঠ বন্ধন গড়ে তোলার জন্য সর্বজনীন উৎসবের কোনো বিকল্প নেই। বাংলার মানুষ এ দিক দিয়েও অত্যন্ত সৌভাগ্যবান। তাদের আছে বিভিন্ন ঋতুভিত্তিক, কৃষিভিত্তিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক উৎসব। আছে জাতীয় নানা দিবস। এই উৎসবে বা দিবসে তারা পরস্পরের হাতে হাত রেখে অংশ নিতে পারেন। আছে সমধিক উৎসমূখর পহেলা বৈশাখ।

কৃষিপ্রধান বাংলাদেশ। এ নিয়েই আবর্তিত-বিবর্তিত হয়েছে জীবনযাপনের নানা ছন্দ ও দোলাচল। আর এই কৃষিকাজকে একটা নিয়মের মধ্যে আনতে মুঘল সম্রাট আকবর প্রবর্তন করেন বাংলা সন। এরপর থেকে বাংলা নববর্ষ বাঙালীর জীবনে নিয়ে আসে নতুন ব্যঞ্জনা। দিনটি উদযাপিত হয় নানাভাবে। দোনাকীদের হালখাতা এই উৎসবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। পুরনো হিসাব-নিকাশ চুকিয়ে দিয়ে খোলা হয় হিসাবের নতুন খাতা। সেই জমিদারী আমলে এ দিনে কৃষকরা খাজনা পরিশোধ করতেন। আমোদিত-আহল্লাদিত জমিওয়ালার তাদেরকে মিষ্টিমুখ করাতেন। আয়োজন করা হতো মেলা ও নানা উৎসবমুখর অনুষ্ঠান। বাংলা নববর্ষের আবেদন ও উজ্জ্বলতা দিনকে ‍দিন বেড়েছে। বেড়েছে ব্যাপ্তি-পরিধি। বাঙালীত্বের অন্যতম নিয়ামক হয়ে ওঠেছে বাংলা নববর্ষ। এটি এখন বাঙালীর সর্ববৃহৎ অসাম্প্রদায়িক উৎসব। বাংলার গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে নববর্ষের নিবিড় সম্পর্ক। পরিবর্তন-পরিবর্ধন-পরিমার্জনে নববর্ষ আসছে প্রতিবারেই নবরূপে-নবসাজে।

নববর্ষ উপলক্ষ্যে ঘরে ঘরে উৎসবের মেজাজ লক্ষ্য করা যায়। এরমধ্যে আছে নতুন পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করা, বৈচিত্র্যময় খাওয়া-দাওয়া। তবে প্রধান আকর্ষণ হিসেবে স্থান করে নেয় রসমাধুর্যে ভরা বৈশাখী মেলা। এই মেলা হয়ে ওঠেছে বাংলার লোকায়ত জীবনধারার নিয়ামক। লোকজ জীবনের প্রতিদিনকার ব্যবহার্য অনুষঙ্গ এই মেলায় বেচা-কেনা হয়। যা মোটামুটি মানুষের ক্রয়-ক্ষমতার মধ্যে। বাঙালীর তো খুব বেশী চাহিদা ছিল না। প্রকৃতির দেওয়া অপার দানকে করে তোলে নিজের প্রাত্যহিক চাহিদার অংশ। মেলায় কৃষিজাত দ্রব্য, কারুপণ্য, কুটিরশিল্প, মৃৎশিল্প, মহিলাদের সাজ-সজ্জার সামগ্রী ও শিশুদের খেলনার নানা সমাহার ঘটে। মুখরোচক খাদ্যদ্রব্যের কোনো কমতি নেই। কত রকমের যে খাদ্যসামগ্রী। টক-ঝাল-মিষ্টির উপস্থিতি থাকলেও মিষ্টি জাতীয় খাদ্যের প্রাধান্যই বেশী। এক সময় বৈশাখী মেলা আনন্দময় হয়ে ওঠত নানা রকম সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে। বসে নানা রকম গানের আসর। লোকশিল্পীদের কণ্ঠে পরিবেশিত হয় বাংলার লোকজ সহজিয়া সুর। পালাগান, জারীগান, কবিগান, গম্ভীরা, বাউল, মারফতি, মুর্শীদী, ভাটিয়ালী। এ ছাড়া থাকে যাত্রা, নাটক, পুতুল নাচ, নাগরদোলা, সার্কাসসহ আনন্দের নানা উপকরণ। তবে হাল সময়ে গ্রাম-বাংলাতে মেলার এই দৃশ্যপট এখন অনেকটাই স্মৃতি রোমন্থনের অংশ পরিণত হচ্ছে।

সময়ের বিবর্তনে বাঙালীর জীবনে ঘটেছে নানা কিছুর সংমিশ্রণ। পরিবর্তন এসেছে পয়লা বৈশাখ উদযাপনেও। যে বাংলা নববর্ষ ছিল গ্রামীণ জনপদের একান্ত নিজস্ব উৎসব, তা এখন নগর সংস্কৃতিরও অংশ হয়ে ওঠেছে। তবে তা অনেকটাই আধুনিক স্টাইলে। দেশভাগ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর গ্রামের মানুষজন শহরমুখী হয়ে ওঠায় তাদের বুকের ভিতরে রয়ে যায় নাড়ীর টান। শহরবাসের পর সেই টান তারা অনুভব করেন। শহরেই অনুরণন ঘটে গ্রামীণ সংস্কৃতির। নিজেদের মত পরিশীলন ঘটিয়ে নতুন রূপ দেওয়া হয় বাংলা নববর্ষের। তাতে অনেক কিছুরই সংযোজন ঘটে। পয়লা বৈশাখের নতুন ভোরের নতুন সূর্যকে বরণ করে নেওয়ার জন্য আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠানমালার। রমনার বটমূলে নববর্ষকে স্বাগত জানাতে গানের আয়োজন করে ছায়ানট। সুরে সুরে ভরে ওঠে চারপাশ। এতে বিপুল সংখ্যক মানুষের সমাগম হয়। নববর্ষের পোশাক হিসেবে প্রচলন হয়ে আসছে মেয়েদের লাল পেড়ে সাদা শাড়ি, হাতে চুড়ি, খোঁপায় ফুল, কপালে টিপ। আর ছেলেদের পাঞ্জাবী, ফতুয়া। পেঁয়াজ, মরিচ সহযোগে পান্তাভাত খাওয়াটা প্রচলিত হয়ে ওঠেছে। এরসঙ্গে থাকে ইলিশ মাছ, ডিম ভাজা, সব্জি, আচার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের বকুল তলায় স্বাগত জানানো হয় বাংলা নববর্ষকে। তবে চারুশিল্পীদের বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা নববর্ষের অন্যতম আকর্ষণ। এই শোভাযাত্রায় স্থান পায় নানারঙের মুখোশ, আল্পনা, বিচিত্র পোশাক-পরিচ্ছদ, খোল-করতাল, বাদ্য-যন্ত্র। রঙে রঙে রঙিন হয়ে ওঠে শোভাযাত্রা। এতে নতুন ব্যঞ্জনা পায় বাংলা নববর্ষ। বাংলা নববর্ষ উদযাপন এখন ছড়িয়ে পড়ছে সারা বিশ্বে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানসহ তো বটেই, নানা রকম সংগঠন তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বরণ করে নেয় পয়লা বৈশাখকে। পার্বত্য জেলায় এবং উপজাতিদের কাছে নববর্ষ আসে উৎসবের প্রধান উপলক্ষ্য হয়ে। শুধু ঢাকাকেন্দ্রীক নববর্ষ উদযাপনের ঢামাডোল নয়; গ্রাম ছাড়িয়ে আলো-বাতির আধুনিক শহরেও মহাধুমধামে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের পসরা বসে।

বাংলা নববর্ষে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। পয়লা বৈশাখ শিশু-কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের মুখাবয়বে কিংবা শরীরে আল্পনা আঁকার চল শুরু হয়েছে। ফ্যাশন ও বুটিক হাউসগুলো বাংলা নববর্ষকে উৎসবের মেজাজ দেওয়ার জন্য নানা রকম পোশাক বাজারে ছাড়ে। বিশেষ করে গরমের কথা বিবেচনা করে বেছে নেওয়া হয় সুতি ও তাঁতের কাপড়। তাতে শোভা পায় ব্লক প্রিন্ট, হ্যান্ড পেইন্ট, স্প্রে, স্ক্রিন প্রিন্ট, এ্যামব্রয়ডারি, টাই-ডাই, এ্যাপলিকসহ কত না বাহারী কারুকাজ। শাড়ী, সালোয়ার-কামিজ, থ্রি-পিস, টপস, পাঞ্জাবী, ফতুয়া, টি-শার্টগুলো যেন উৎসবের মেজাজ নিয়ে আসে। তাতে ওঠে আসে বাংলার হাঁড়ি-পটসহ নানা মোটিফ, বাংলা কবিতা ও গানের মন ছুঁয়ে যাওয়া পঙ্ক্তি, প্রাচীন টেরাকোটার নিদর্শন, নানা শিল্পকর্ম। ঈদে-পার্বণে নতুন পোশাকে সাজতে অভ্যস্ত বাঙালীর কাছে পয়লা বৈশাখও হয়ে ওঠেছে নিজেকে নতুন রঙে সাজানোর উপলক্ষ্য। নববর্ষের পোশাকে থাকে নিখাঁদ বাঙালীয়ানার ছাপ। পোশাক-আশাকের পাশাপাশি গহনার সাজ-সজ্জায় আছে নানা বৈচিত্র্য। পোড়ামাটি, কাঠ, মাটি, পূঁতি, তামা, পীতল দিয়ে কত রকম গহনা তৈরী হয়। কানের দুল, গলার মালা, হাতের বালা, চুড়ির বাহারী ডিজাইন শোভা পায় আধুনিক নারীর দেহে। আর ফুল তো আছে সৌন্দর্যের অন্যতম উপাদান হয়ে। তবে আগের তুলনায় ফুলের কদর যেমন বেড়েছে, বেড়েছে তার নানা রকম ব্যবহার। নববর্ষে প্রতিদিনের জীবনে নিয়ে আসে বৈচিত্র্য। এ দিনে অনেকেই ঘরে ভিন্ন স্বাদের খাবারের আয়োজন করলেও কেউ কেউ বাইরে থেকে খেয়ে আসেন। অনেকেই চলে যান দূরে কোথাও।

গানের ক্ষেত্রেও এসেছে পরিবর্তন। লোকজ গান, রবীন্দ্র সঙ্গীতের পাশাপাশি বাংলা নববর্ষ উপলক্ষ্যে এখন ব্যান্ড দলগুলোও বেশ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। নববর্ষে বের করা হয় নতুন নতুন সিডি এ্যালবাম। শহরের ফোকাল পয়েন্টে আয়োজন করা হয় ব্যান্ড শো। তাতে ব্যাপক সংখ্যায় উপস্থিত হন তরুণপ্রজন্ম। এখন যেকোনো অনুষ্ঠান ও আয়োজনে বাংলা নববর্ষ ব্যাপ্তি বেড়েই চলেছে। তা পরিণত হয়ে ওঠেছে জাতীয় উৎসবে। সবার কাছে এটি এখন প্রাণের উৎসব। তবে যারা বাংলা নববর্ষকে মেনে নিতে পারেনি তারা বিভিন্ন সময় নববর্ষ উদযাপনী অনুষ্ঠান বানচাল করার চেষ্টা করেছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ২০০১ সালে রমনা বটমূলে পয়লা বৈশাখে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে কাপুরুষোচিত হামলা। তাতে বেশ কয়েকজনের জীবনহানী ঘটেছে। আহত হন অসংখ্য মানুষ। এ ঘটনায় অবশ্য আয়োজকরা মোটেও হতোদ্যম হননি। তারা এটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে প্রতি বছর আয়োজন করে যাচ্ছে বাংলা নববর্ষ। সংস্কৃতিবান মানুষও পিছিয়ে যায়নি।

বাংলা নববর্ষ তাদের অন্তরে স্থান করে নিয়েছে। এক্ষেত্রে তারা ছাড় দিতে নারাজ। তবে হামলার ঘটনার পর থেকে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করার ক্ষেত্রে একটা সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। মনের মধ্যে কিছুটা হলেও একটা ভীতি কাজ করে। এখন তো নানা ঘটনায় বাংলা নববর্ষ উদযাপন করাটা কঠিন হয়ে ওঠেছে। যে কোনো সময় যেকোনো ঘটনার জন্য প্রস্তুত থাকাটা অমূলক নয়। তারপরও বাংলা নববর্ষকে বাদ দিয়ে বাঙালীকে আলাদা করা যাবে না। এটি মিশে আছে বাঙালীর প্রাণে, বাঙালীর অন্তরে। বাংলা নববর্ষে বাঙালী খুঁজে পায় নিজেকে। নিজের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে। সংস্কৃতির এই মহাজাগরণে উচাটন মনে সাহসে বুকে আসুন ১৪২২ বঙ্গাব্দকে বরণ করতে আমরা সম্মিলিত কণ্ঠে গেয়ে ওঠি রবি ঠাকুরের গান- ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’। বৈশাখ আসুক বাঙালীর ঘরে ঘরে সুন্দর আগামীর বার্তা নিয়ে। আসুক সবুজ মাঠ-ঘাসে; শহর-নগর সবখানে। আসুক প্রতিবাদের কালবৈশাখী হয়ে। আসুক অতিশয় ঢোল-বাদ্যি-বাজনা বাজিয়ে।

– See more at: http://www.thereport24.com/article/99600/index.html#sthash.GSkV6HZv.dpuf


শেয়ার করুন