এরশাদের আদর্শ বিরোধী দল মিশন!

113606_f1সিটিএন ডেস্ক:
প্রকৃত বিরোধী দলের ভূমিকা পালনের স্বার্থে মন্ত্রিসভা ছাড়ার পক্ষে মত দিয়েছেন জাতীয় পার্টির এরশাদপন্থি প্রেসিডিয়াম সদস্যরা। তবে তাদের এ মত প্রত্যাখ্যান করেছেন রওশনপন্থিরা। তারা প্রেসিডিয়ামের বৈঠকটিকেই অবৈধ বলে উল্লেখ করেছেন।
দীর্ঘ দুই বছর পর গতকাল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয়ে প্রেসিডিয়ামের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ৩৭ জন প্রেসিডিয়ামের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ২৪ জন। তারা তাদের দলীয় পরিচয় নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। রওশন এরশাদের সঙ্গে দূরত্ব কমানোর জন্য পার্টি চেয়ারম্যান এরশাদকে পরামর্শ দেন তারা। তবে প্রেসিডিয়ামের এই বৈঠকে রওশন এরশাদ ও তার অনুসারীরা অংশ নেননি।
বৈঠক সূত্র জানায়, শুরুতেই সভাপতির বক্তব্য দেন এইচ এম এরশাদ। পার্টির এক নম্বর কো-চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য রওশন অনুরোধ করেছেন বলে জানান এরশাদ। এ ছাড়া আনিসুল ইসলাম মাহমুদ পার্টির চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য তৎপরতা চালাচ্ছেন বলেও বৈঠকে কথা তোলেন এরশাদ। এমনকি জয় বাংলা সেøাগান নিয়েও বৈঠকে বিতর্ক হয়।
সূচনা বক্তব্যে এরশাদ বলেন, আমরা অনেকদিন পর প্রেসিডিয়াম বৈঠকে বসেছি। গত দু’বছরে আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে এ ধরনের বৈঠক হয়নি। এখন এমন একটা পরিস্থিতি যাচ্ছে যে, আমাদের ভবিষ্যৎ করণীয় ঠিক করতে হবে। যাতে পার্টিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। আমার বয়স হয়েছে। এরশাদ বলেন, আমি চট্টগ্রামে থাকা অবস্থায় রওশন আমাকে ফোন করে একটা অনুরোধ করেছেন। বলেছেন, তাকে যেন আমি পার্টির এক নম্বর কো-চেয়ারম্যান করি। আমি বলেছি এটা পারবো না। রওশন আমাকে জানিয়েছেন, তিনি নাকি আনিসুল ইসলাম মাহমুদের পরামর্শ অনুযায়ী এ অনুরোধ করেছেন।
এ সময় তিনি আরও বলেন, আনিস দলের চেয়ারম্যান হতে চায়। এটা আমাকে জানানো হয়েছে। এজন্য সে এসব করছে। তিনি আরও বলেন, আনিস ‘৯০ সাল পর্যন্ত আমার দলের মন্ত্রী ছিল। ‘৯৩ সালে সে বলেছিল আমি আর রাজনীতি করবো না। করলেও এরশাদের সঙ্গে রাজনীতি করবো না।
এরশাদ বলেন, আমি যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি করে যেতে চাই। কো-চেয়ারম্যান পদটি গঠণতন্ত্রে নেই। আমি ৩৯ ধারার ক্ষমতাবলে এ পদ সৃষ্টি করেছি। এরশাদ বলেন, আমার জীবনের বেশির ভাগ সময় আমি পার্টির জন্য ব্যয় করেছি। টাকা খরচ করেছি। দলকে টিকিয়ে রাখার জন্য অনেক কিছু করেছি। দলের সদস্যদের কষ্ট দিতে চাইনি।
তিনি আরও বলেন, অনেকদিন ধরে কাউন্সিল হয় না। দলকে শক্তিশালী করার জন্য কাউন্সিল খুব প্রয়োজন। জাপা চেয়ারম্যান বলেন, জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান করার বিষয়ে আমি রওশনের কাছে মতামত চেয়েছি। তিনি আমার সঙ্গে একমত হয়েছেন। বলেছেন, তুমি ওকে (কাদের) গড়ে তোলো। এ সময় তিনি কো-চেয়ারম্যান হিসেবে জিএম কাদেরকে সবার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক পরিচয় করে দেন।
বৈঠকে জিয়াউদ্দিন বাবলুর সমালোচনা করে এরশাদ বলেন, বাবলু চট্টগ্রামের মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী ও সোলায়মান শেঠকে কোণঠাসা করে রেখেছে। অথচ চট্টগ্রাম অঞ্চলে পার্টির জন্য এরা অনেক অবদান রেখেছে। আমি বাবলুকে সরিয়ে দিতে চাইনি। উল্টো সে আমাকে সরিয়ে দিতে চেয়েছে। বৈঠকে সব প্রেসিডিয়াম সদস্য রওশনের সঙ্গে দূরত্ব কমাতে এরশাদকে পরামর্শ দেয়। এরশাদ বলেন, আমার সঙ্গে তার কোনো দূরত্ব নেই। আমি প্রত্যেকটা কাজ রওশনকে জানিয়ে করি। সে আমার সঙ্গে মাঝে মাঝে অভিমান করে।
বৈঠক সূত্র জানায়, এরশাদের পরেই বক্তব্য দেন মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার। পুনরায় মহাসচিবের দায়িত্ব দেয়ায় তিনি এরশাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। এরপর একে একে সকল প্রেসিডিয়াম সদস্য বক্তব্য দেন। হাবিবুর রহমান ছাড়া বাকি সবাই মন্ত্রিসভা থেকে সরে আসার ব্যাপারে মত দেন। বৈঠকে প্রেসিডিয়াম সদস্য সাইদুর রহমান টেপা বলেন, আমরা সরকারের সঙ্গে থাকবো না। মন্ত্রিসভা থেকে সবাইকে সরিয়ে আনতে তিনি এরশাদকে অনুরোধ জানান।
সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা বলেন, পার্টির চেয়ারম্যান যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন। তবে আমাদের গুছিয়ে কাজ করা উচিত।
হাজী সাইফুদ্দিন আহম্মেদ মিলন বলেন, আমরা সরকারের সঙ্গে থাকতে চাই না। এটা অন্যায় হচ্ছে। আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। একই কথা বলেন আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য আজম খান। তিনি মন্ত্রিসভায় থাকা নিয়ে জোর গলায় প্রতিবাদ করেন।
প্রেসিডিয়াম সদস্য মীর আব্দুস সবুর আসুদ বলেন, আমাদের পরিচয়টা আমরা বুঝতে পারছি না। বিরোধী দলে থেকে কীভাবে মন্ত্রী হয়? প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক মাসুদা এম রশিদ চৌধুরী বলেন, পার্টির নিজস্ব পরিচয় দরকার। আমাদের প্রকৃত বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করা উচিত। সবকিছু বুঝে শুনে পরিকল্পনা করে আমাদের এগোতে হবে। তবে আমরা যেহেতু বিরোধী দলে রয়েছি, সেই দায়িত্ব আমরা সঠিকভাবে পালন না করতে পারলে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা কমে যাবে। চিত্রনায়ক মাসুদ পারভেজ সোহেল রানাও বিরোধী দলের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এ সময় তিনি এরশাদকে উদ্দেশ্য করে বলেন, স্যার আপনি কেন ‘জয় বাংলা’ সেøাগান ব্যবহার করছেন না। এটাতো মুক্তিযুদ্ধের সেøাগান। উপস্থিত সকলে সোহেল রানার এই বক্তব্যের বিরোধিতা করেন। তারা বলেন, এটা এখন আওয়ামী লীগের সেøাগান। এই সেøাগান আমরা দেবো না। এরপর প্রেসিডিয়াম সদস্য মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী ও সোলায়মান আলম শেঠ একযোগে বাবলুর বিরুদ্ধে এরশাদের কাছে অভিযোগ করেন।
মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বাবলু চট্টগ্রামের অনেক ত্যাগী নেতাকর্মীকে দমিয়ে রেখেছেন। বিভিন্নভাবে পার্টির ক্ষতি করেছেন। সোলায়মান আলম শেঠ বলেন, বাবলু ব্যক্তিগতভাবে আমার অনেক ক্ষতি করেছেন। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আমি প্রার্থী থাকা অবস্থায়ও তিনি আওয়ামী লীগ প্রার্থীর হয়ে প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন। এ সময় এরশাদ বলেন, আমি সবই জানি। আমার কিছু করার ছিল না। এম এ সাত্তার বলেন, স্যার আমি আপনার দলের পরিচয়ে এমপি হইনি। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জয়লাভ করে পার্টিতে যোগ দিয়েছিলাম। আপনি জীবনে অনেক ভুল করেছেন। এখনও করছেন। তবে শুধরানোরও সময় আছে।
বৈঠক সূত্র জানায়, প্রেসিডিয়াম সদস্য হাবিবুর রহমান মন্ত্রিসভা ছেড়ে আসার বিষয়ে বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত দিলে তাদের (আনিস, রাঙ্গা, চুন্নু) সঙ্গে ঝামেলা তৈরি হবে। তাই এটার প্রয়োজন নেই। আপাতত মিলেমিশে দল চালানো উচিত। তার এই বক্তব্যের পরই উপস্থিত প্রেসিডিয়াম সদস্যরা তীব্রভাবে এ বক্তব্যের বিরোধিতা করেন।
এদিকে মধ্যবর্তী নির্বাচন নিয়ে দলের এক প্রেসিডিয়াম সদস্য কথা তোলেন। তিনি বলেন, স্থীতিশীলতাকে ডিস্টার্ব করা আমাদের উচিত হবে না। সরকারের সঙ্গে কোনো বিভেদে যাওয়া উচিত হবে না। বৈঠকে সবার শেষে বক্তব্য দেন দলের কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের।
তিনি বলেন, আমি এরশাদের মতো নেতা হতে পারবো না। তবে উনি যেভাবে বলেন, আমি সেভাবেই কাজ করে যাবো। জরুরি ক্ষেত্রে হয়তো নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নেবো। রওশন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি কোনোদিন উনাকে ছোট করতে পারি না। উনি আমার নেতার স্ত্রী। আমার মায়ের মতন। জিএম কাদের বলেন, আমাদের জনসমর্থন অনেকটা হারিয়ে গেছে। সেটাকে ফেরাতে হবে। তিনি এরশাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এরশাদের বিকল্প আর হবে না। তিনি আমাদের ফিক্স ডিপোজিট।
বৈঠক সূত্র জানায়, ২ মাস পরপর প্রেসিডিয়াম বৈঠক করার সিদ্ধান্তও নেয়া হয় বৈঠকে। এ ছাড়া আনিস-বাবলুর ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি আসলে সেই বিষয়েও সময় নিয়ে ব্যবস্থার আশ্বাস দেন এরশাদ।
বৈঠকের পর গণমাধ্যমের সামনে আসেন জিএম কাদের ও রুহুল আমিন হাওলাদার। হাওলাদার জানান, কো-চেয়ারম্যান ও মহাসচিব পদ প্রেসিডিয়ামে অনুমোদন হয়েছে। তিনি বহু চড়াই উতরাই পার করে জাতীয় পার্টির এ পর্যায়ে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে পার্টিকে শক্তিশালী করার কথাও জানান হাওলাদার।
মহাসচিব বলেন, ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমরা প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় মনিটরিং সেল গঠন করবো। এ ছাড়া খুব শিগগির জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়ের আয়োজন করা হবে। আগামী ১৬ই এপ্রিল জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে বলেও জানান হাওলাদার। এ সময় জিএম কাদের সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরে বলেন, মন্ত্রিসভা ছেড়ে আসার ব্যাপারে সকল প্রেসিডিয়াম সদস্য একমত হয়েছেন।
তার বলেছেন, এটা হলে ভালো হবে। পার্টির গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। পার্টির চেয়ারম্যান এ বিষয়ে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেবেন। দলের কয়েকজন নেতার অনুপস্থিতির কারণ জানতে চাইলে জিএম কাদের বলেন, অনেকেই বিভিন্ন সমস্যার কারণে আসতে পারেনি। বিরোধীদলীয় নেতার আরেকটি প্রোগ্রাম আছে বলে তিনি আসতে পারেননি। তিনি এটা আমাদের জানিয়েছেন। সরকারের সুবিধায় জাতীয় পার্টিকে শক্তিশালী করা হবে, শ্রম প্রতিমন্ত্রী মজিবুল হক চুন্নুর এমন বক্তব্যের বিষয়ের তিনি বলেন, এটা উনার ব্যক্তিগত মতামত। কথাটি ঠিক না।
এদিকে এই প্রেসিডিয়াম বৈঠককে অবৈধ বলেছেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য পানি সম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। মন্ত্রিপরিষদ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য প্রেসিডিয়ামরা একমত হয়েছেন। আপনার মন্তব্য কি এ প্রশ্নে তিনি বলেন, এ বৈঠকই অবৈধ। কারণ যে মহাসচিব এই বৈঠক ডেকেছেন গঠতন্ত্র মতে তিনি মহাসচিব নন। তাই যে বৈঠক অবৈধ সে বৈঠকের সিদ্ধান্ত বা মত নিয়ে কি বলার আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিরোধী দলের চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, কিসের সিদ্ধান্ত। কিসের মতামত। কোনো সিদ্ধান্ত নেই। এ বিষয়ে রওশন এরশাদ সাংবাদিকদের বলেন, আমি অন্য একটা কাজের জন্য বৈঠকে উপস্থিত হতে পারিনি। কি মতামত দেয়া হয়েছে তা শুনে তারপর আমার সিদ্ধান্ত জানাব। শ্রমপ্রতিমন্ত্রী মজিবুল হক চুন্নু বলেন, আমরা এই বৈঠকের বিষয়ে কিছুই জানি না। মানবজমিন


শেয়ার করুন