এডভোকেট সালামতুল্লাহ ছিলেন আইনজীবী, সাংবাদিক, মানবাধিকার ও সাংস্কৃতিক সংগঠক

হুমায়ুন সিকদারঃ

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সাবেক সদস্য, কক্সবাজার জেলার সাবেক আমীর প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবক অ্যাডভোকেট সালামতুল্লাহ একটি ইতিহাস। বহু প্রতিভার অধিকারী একজন আলোকিত মানুষ। তিনি একাধারে আইনজীবী, সাংবাদিক, মানবাধিকার ও সাংস্কৃতিক সংগঠক। বহু গুণের অধিকারী এডভোকেট সালামতুল্লাহ ছিলেন এতদঞ্চলের আদর্শ ব্যক্তিত্ব। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন এডভোকেট সালামতুল্লাহ জেলাবাসী একজন প্রবীণ এ অভিভাবককে হারিয়ে শোকাহত। তিনি একজন লেখক হিসেবে সাংবাদিকতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে বই লিখে সুনাম অর্জন করেন।
প্রতিটি অঙ্গণেই সফলতা ও ন্যায-নিষ্ঠার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। অতি সাধারণ জীবন-আচরণ, আল্লাহর ও রাসুলের ভালবাসা, জ্ঞানস্পৃহা, ব্যক্তিগত আমল- আখলাক এসব কিছুর কারণে তার ব্যক্তিত্ব ছিল আমাদের কাছে দৃষ্টান্ত স্বরুপ। তিনি বহুগুনের অধিকারী এক মহান ব্যক্তিত্ব। তিনি জীবনের বাঁকে বাঁকে অনেক দ্বায়িত্ব পালন করেছেন। প্রারম্ভিকালে তিনি একজন দক্ষ আইনজীবী ছিলেন তিনি ছিলেন খুবই অমায়িক ও মানবতাবাদী বুযুর্গ ব্যক্তি। কোনো মানুষ তার থেকে নিরাশ হতো না। এলাকার সব মানুষকে নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। তিনি অনেক দেশ ভ্রমণ করেন। তার কাছে কোনো মেহমান এলে তার আন্তরিক, অভিজাত ও মেহমানদারী লাভ করে চিরদিনের জন্য তার আপনজনে পরিণত হতেন। তার মেহমানদারীর কোনো তুলনা হয় না। আকর্ষণীয় সুবক্তা ছিলেন তিনি। মানুষ মুগ্ধ হয়ে তার আলোচনা শুনতে থাকত। তিনি ইসলামী জ্ঞানের ভান্ডার, আধুনিক জ্ঞান ও রাজনীতির দিকনির্দেশক। তিনি একজন দক্ষ ও কর্মঠ নেতা ছিলেন।

তাহাজ্জুৎ ও ফজরের নামাজ পড়ে সীমিত সময়ের জন্য তিনি ঘুমাতেন। তিনি নিজের জীবনে ইসলামকে গভীরভাবে ধারণ করতেন এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা পালন করতেন। তিনি হিংসা, বিদ্বেষ ও অহংকার মুক্ত ছিলেন। কাজের মানুষ, সঙ্গী-সাথী ও পরিচিত সকলের সাথে স্নেহ, মায়া-মমতার সম্পর্ক রাখতেন। আল্লাহ তাআলা মরহুমকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন এবং তাঁর পরিবারকে হেফাজত করুন। তিনি নিজের প্রতি খেয়াল রাখতেননা।
ছিলেন পরোপকারী, সাহসী, উদার মনের মানুষ। তার জন্য কিছু করতে পারলে ভালো লাগবে। তার নামে ট্রাস্ট করে প্রতি বছর গরীব অসহায় শিক্ষার্থীদেরকে সহযোগিতা করা যেতে পারে। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ভদ্র, আন্তরিক, সজ্জন। তার কথা শুনলেই শক্তি পেত লোকজন। তিনি অত্যন্ত অতিথি পরায়ণ ছিলেন। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন সহজ সরল ব্যক্তিত্ব। সংস্কৃতিপ্রেমী ছিলেন। কখনো নিজের কথা ভাবেননি। পরোপকারী ছিলেন। তার লেখা ও ব্যক্তিত্ব দুটিই খুব উন্নতমানের ছিলো। অতিথি পরায়ণ ছিলেন। খাওয়াতে পছন্দ করতেন। রাজনীতি ব্যক্তিত্ব ছাড়াও আর্ন্তজাতিক-কূটনৈতিক বিশ্লেষক ছিলেন। নিজেকে উপস্থাপনে ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী। ছিলেন প্রচার বিমুখ। এই যুগে তার মতো ভদ্রলোক হয় না। তিনি অত্যন্ত সাধারণ ছিলেন।

গত ৭ জুন বাদে জোহর কক্সবাজার কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে জানাজাপূর্ব সমাবেশে বক্তব্য রাখেন- জামায়াত ইসলামী কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও চট্টগ্রাম মহানগর আমীর মুহাম্মদ শাহজাহান, জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরী, বিএনপির কেন্দ্রীয় মৎস্যজীবী বিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য লুৎফুর রহমান কাজল, জেলা জামায়াতের সাবেক আমীর ও চট্টগ্রাম অঞ্চল টীম সদস্য মাওলানা মোস্তাফিজুর রহমান, জেলা আমীর অধ্যক্ষ মাওলানা নুর আহমদ আনোয়ারী, বান্দরবান জেলা আমীর মাওলানা আবদুস সালাম আযাদ, ইসলামী ঐক্যজোটের জেলা সভাপতি হাফেজ সালামতুল্লাহ, জেলা জামায়াতের সাবেক নায়েবে আমীর ও চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুল গফুর, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট আবুল কালাম ছিদ্দিকী, কক্সবাজার প্রেস ক্লাব সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বিশিষ্ট সমাজসেবক ও রাজনীতিবিদ জাহাঙ্গীর কাসেম। পরিবারের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন মরহুমের দ্বিতীয় ছেলে সোহেল সাইফুল্লাহ জাজি ও ছোট ছেলে রিয়াজ মুহাম্মদ শাকিল। উপস্থিত ছিলেন- জেলা জামায়াতের নায়েবে আমীর মাওলানা মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ, সহকারী সেক্রেটারি অধ্যাপক আবু তাহের চৌধুরী, সাংগঠনিক সেক্রেটারি শামসুল আলম বাহাদুর, জাহেদুল ইসলাম, জেলা সমাজসেবা সম্পাদক সাইদুল আলম, যুব ও ক্রীড়া বিভাগীয় সম্পাদক হেদায়াত উল্লাহ, সাবেক পৌর মেয়র সরওয়ার কামাল, শহর জামায়াতের আমীর ফজলুল কাদের, ছাত্রনেতা আমান উল্লাহ, রকিবুল ইসলাম, কামাল উদ্দিন। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও আইনঙ্গনের সহকর্মীবৃন্দ জানাযায় অংশগ্রহণ করেন।সমাবেশ সঞ্চালনা করেন জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট ফরিদ উদ্দিন ফারুকী।
নামাজে জানাযায় ইমামতি করেন মরহুমের ছোট ছেলে রিয়াজ মুহাম্মদ শাকিল। উল্লেখ্য, এ্যাডভোকেট সালামতুল্লাহ (৮৫) ৬ জুন রাত ৮:১০ মিনিটে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন।
তার ৩ ছেলে ১ মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে আমেরিকা প্রবাসী, মেঝ ছেলে শিক্ষানবীশ আইনজীবী ও ছোট ছেলে কক্সবাজার শহর জামায়াতের সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করছেন। মরহুম সালামতুল্লাহ একজন রত্নগর্ভ পিতা।
জন্মঃ
ক্ষণজন্মা, মহান সত্যব্রতী পুরুষ সালামতুল্লাহ এডভোকেট ১৯৩৭ সালের ৬ ফেব্রæয়ারি পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতসংলগ্ন পর্যটন নগরী কক্সবাজারের বাহারছড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫৫ সালে কক্সবাজার হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন । অতঃপর ১৯৫৭ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে আই.এ এবং ঢাকা সলিমুল্লাহ কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন। তিনি ১৯৬৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল.এল.বি ডিগ্রি লাভ করেন।
স্কুলজীবনে তিনি ফুটবল খেলা ও স্কাউটিং -এ সুনাম অর্জন করেন। ১৯৫৩ সালে করাচিতে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় স্কাউট্স জাম্বুরিতে কক্সবাজার হাইস্কুল থেকে গ্রুপলিডার হিসেবে যোগদান করেন।
তিনি ১৯৬৫ সালে কক্সবাজার কোর্টে আইনপেশা শুরু করেন। তখন থেকে তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ সাংবাদিকতার সাথেও জড়িত ছিলেন। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস), এসোসিয়েট প্রেস অব পাকিস্তান (এপিপি), অবজারভার, জনপদপ্রভৃতি পত্রিকার কক্সবাজার প্রতিনিধি হিসাবে তিনি কাজ করেন। কক্সবাজার জেলায় সাংবাদিকতার বিকাশে এবং কক্সবাজার প্রেসক্লাব গঠনে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন । তাঁর নেতৃত্বে কক্সবাজারে সর্বপ্রথম বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির কক্সবাজার শাখা ও প্রেসক্লাব গঠিত হয়। তিনি দীর্ঘদিন তদানিন্তন বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেন।
তিনি ছাত্রজীবন থেকে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত আছেন। তিনি তৎকালীন কক্সবাজার মহকুমা মুসলিম ছাত্রলীগের জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন। এছাড়া তিনবার কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। সালামতুল্লাহ এডভোকেট কক্সবাজার ইসলামী সমাজ কল্যাণ সংসদের সভাপতি ও বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার কক্সবাজার জেলার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি দীর্ঘকাল যাবৎ কক্সবাজার জেলার স্কাউটস্ কমিশনার ছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ স্কাউটস্, কক্সবাজার জেলার সহ-সভাপতি ।
এছাড়া কক্সবাজার রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির আজীবন সদস্য। তিনি তদানিন্তন কক্সবাজার মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন।
সালামতুল্লাহ এডভোকেট কক্সবাজার ইসলামিয়া বালিকা কামিল মাদ্রাসা, কক্সবাজার আইন কলেজ, কক্সবাজার মহিলা কলেজ, কক্সবাজার সিটি কলেজ, আলহেরা একাডেমী এবং কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজসহ অনেকগুলো শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি দীর্ঘদিন কক্সবাজার আইন কলেজের ইসলামী আইনের অধ্যাপক এবং ভাইস প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ কক্সবাজার জেলার আমীর-এর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন । তিনি কক্সবাজার জেলার একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ। কক্সবাজারের সাহিত্য বিকাশে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। তিনি কক্সবাজার সাহিত্য পরিষদের প্রধান উপদেষ্টা। কক্সবাজারের নবীনদের লিখা প্রথম হাতেলেখা সাহিত্য পত্রিকা তাঁরই উদ্দ্যোগে প্রকাশিত হয়। তিনি তৎকালীন কলকাতার ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকার ছোটদের বিভাগে লিখতেন।
১৯৯৬ সালে সালামতুল্লাহ এডভোকেট আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সরকার কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ভিজিটর্স প্রোগ্রামে (ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঠরংরঃড়ৎ চৎড়মৎধস) যোগদান করেন। উল্লেখ্য যে, এই প্রোগ্রামে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান (১৯৫২), মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদত (১৯৬১), পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসহাক খান (১৯৪৯), শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট রানা সিংহ প্রেমাদাসা (১৯৬৬) এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দীরা গান্ধী (১৯৬১) অংশ গ্রহণ করেন।
আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি, ক্যালিফোর্নিয়া, কলম্বিয়া, বার্লিংটন, ফ্রিপোর্ট, স্যানডিয়াগো, শিকাগোসহ বিভিন্ন শহর ও অঞ্চল সফর করেন। তিনি ১৯৯৯ সালে মক্কাভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘রাবেতা আল-আলমে ইসলামী’ কতৃক আমন্ত্রিত হয়ে উক্ত সংস্থার অতিথি হিসেবে পবিত্র হজ্জ্ব পালন করেন এবং দেশে ফেরার সময় আরব আমীরাতের বাংলাদেশ সমিতি ও ইসলামিক সেন্টার-এর সদস্যদের আমন্ত্রণে আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবী, দুবাইসহ বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করেন। ক্ষণজন্মা এ মহান পুরুষ গত ৬ জুন রাত ৮টা ১০মিনিটে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তিনি এক কন্যা ও তিন পুত্র এবং অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে যান।

যুগ্ন সম্পাদক
সাংবাদিক ইউনিয়ন কক্সবাজার।
বার্তা সম্পাদক
দৈনিক হিমছড়ি, কক্সবাজার।


শেয়ার করুন