একজন মাশরাফির গল্প

 download-122সংবাদ সম্মেলনের মঞ্চটা আসলে একটা রঙ্গমঞ্চ। কেউ এখানে এসে অভিনয় করে চলে যান। কেউ আবার নিজেকে উজাড় করে দেন ছোট টেবিলটার সামনে বসে। কেউ হাসেন, কেউ কাঁদেন; কেউ হাসান, কেউ কাঁদান।
এই মিরপুর স্টেডিয়ামের পোডিয়ামটার কথাই ধরুন না কেনো। কতো শতো রঙ্গনাটকের স্বাক্ষী হয়ে আছে এই মঞ্চ।
ব্রায়ান লারার অসহিষ্ণু হয়ে ওঠা, শচীন টেন্ডুলকারের বরফ শীতল কথা কিংবা সৌরভ গাঙ্গুলির চটে ওঠা বা রিকি পন্টিংয়ের নাটকীয় দুঃখ প্রকাশ; কতো কিছুই না দেখেছি এই মঞ্চে। এই মঞ্চে ড্যারেন স্যামি বলেছিলেন, ‘আমাকে আপনারা কী ভাবেন, আমি জানি। ব্যাটেবলে তো পারি না; তাই হাসিয়ে আনন্দ দিতে চাই। ব্রায়ান লারার মতো প্রশ্ন করি, ডিড আই এন্টারটেইন ইউ’!
এই মঞ্চে সাঙ্গাকারাকে জ্ঞানের আসর বসাতে দেখেছি, এই মঞ্চে প্রফেসর নামের হাফিজের বিরক্তিকর সেমিনার মার্কা বক্তব্য শুনেছি, এই মঞ্চে শাহাদাত হোসেন রাজীব বলেছিলেন ‘পিকচার আভি বি বাকী হ্যায় মেরে দোস্ত!
প্রায় এক যুগ ধরে এতোশত আবেগ দেখতে দেখতে মনে হয়েছিলো, সংবাদ সম্মেলন ব্যাপারটা দেখা হয়ে গেছে। এই মঞ্চ থেকে নতুন কিছু আর কখনো দেখতে পাবো না। মার্কেজের ভাষায়, সব গল্প বলা হয়ে গেছে। এখানে তাই পুরোনো গল্প নতুন বোতলে ফিরে ফিরে আসবে; এটাই নিয়তি ছিলো।
কিন্তু নিয়তির ওপর ছড়ি ঘোরাতে এসেছেন তিনি মর্তে। তাই আরেকটা বোতল খুলে ফেললেন; বোতল থেকে বেরিয়ে এলো আনকোরা, টাটকা, আদ্যে না বলা এক গল্পের ডালি। আমরা মুগ্ধ হয়ে, হতচকিত হয়ে, অপার বিস্ময়ে দেখলাম মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের সেই মঞ্চ থেকে জীবনের নতুন নতুন বোধ আর ক্রিকেট প্রজ্ঞার নতুন নতুন স্তর উন্মোচিত করলেন তিনি।
হ্যা, আমাদের মাশরাফি বিন মুর্তজা। আমি তাকে বললাম, তিনি আচার্য মাশরাফি; একজন বললেন, ‘না, তিনি আশ্চর্য মাশরাফি।’
সত্যি বলি; মাশরাফিকে আমরা আধাপাগলা বলে জানতাম।
ডেভ হোয়াটমোর তো ওকে ‘পাগলা’ বলেই ডাকতো। বয়স বা ইনজুরির ছোবল মাশরাফির পাগলা চেহারাটা এতোটুকু ম্লান করতে পারেনি কখনো। এখনও আমাদের সঙ্গে এলাকার ভাষায় অপ্রকাশযোগ্য সব আড্ডা দেয়। দুনিয়ার অনেক ভারী ও হালকা বিষয় নিজস্ব শব্দ চয়নে একেবারে হাস্যকর বানিয়ে ফেলতে ওস্তাদ এই মাশরাফি।
আগের লেখাটাতেই বলেছি, ক্রিকেট জ্ঞান, নেতৃত্ব, বড় ভাই হয়ে ওঠা; এসব গুন মাশরাফির ভেতর বিল্ট ইন ছিলো। তাই এগুলো কখনো আমাদের অবাক করেনি। তবে আমরা যেটা কল্পনাই করিনি যে, সেই ‘পাগলা’ মাশরাফি ক্রিকেটের মাঠে, ক্রিকেটের সেই রঙ্গমঞ্চে এমন করে জীবনকে তুলে ধরতে পারবে। এমন দারুন স্মার্ট ভঙ্গিতে, সম্ভবত সবচেয়ে স্মার্ট ভঙ্গিতে সে ক্রিকেটের বিরাট বিরাট ব্যাপারকে আমাদের সাধারণের মগজে ঢুকিয়ে দিতে পারবে।
মিরপুর স্টেডিয়ামের পোডিয়ামটার কথা বলছিলাম।
২০১১ সালের মার্চ মাসের এক সন্ধ্যায়, নাকি রাতে এই পোডিয়ামে বসে চোখ মুছতে দেখেছিলাম যন্ত্রমানব গ্রায়েম স্মিথকে। স্বদেশী এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে স্মিথ বলেছিলেন, ‘হ্যা, আজ স্বীকার করে নেই। লোকে সম্ভবত ঠিকই বলে; আমরা চোকার্স।’
আহ!
সেদিনও বুঝিনি এই শব্দটার মধ্যে কতোটা যন্ত্রনা, কতোটা অবমাননা লুকানো আছে।
এই তো, রবিবার মাশরাফি মুখটা একটু বাঁকা করে আমাদের চোখে আঙুল তুলে দিলেন। একেবারে শানিত এক একটা বাক্যে বুঝিয়ে দিলেন সারা পৃথিবীর জন্য যে ‘চোকার্স’ শব্দটা একটা রসিকতা, একটা বিশেষণ, একটা খোচা মাত্র; সেটা দক্ষিণ আফ্রিকার বড় যন্ত্রণা।
প্রশ্ন করা হয়েছিলো, দক্ষিণ আফ্রিকা কী ‘চোকার্স’ বলে আবার চোক করলো?
শব্দটা শুনে মাথা এপাশে ওপাশে নাড়িয়ে বললেন, ‘আমি জানি না কারো এভাবে কথা বলা ঠিক কি না। আর আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, কোনো জাতিকে এভাবে আঘাত করা ঠিক না। আমি বিশ্বাস করি, ওরা অনেক বড় দল। এমনকি বিশ্বকাপে যখন যায়, অন্যতম সেরা দল হিসেবেই যায়। সেখানে গিয়ে এমন না ভালো খেলে না। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ওরা এবারও সেমি-ফাইনালে গিয়ে হেরেছে। আসলে এই কথাগুলো সব সময় ব্যবহৃত হয়, তখন আমার কাছে ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয় পুরো দেশটাই এতে কষ্ট পায়। মানুষকে, একটা জাতিকে এভাবে কষ্ট দেওয়ার অধিকার কারো নেই।’
এই আমাদের মাশরাফি। এ জন্যই আমাদের ক্যাপ্টেন মাশরাফি।
মাশরাফির এই ক দিনের সংবাদ সম্মেলন থেকে কী শিখলাম?
সব বিষয় মিলিয়ে একটা লেখা তৈরী করা এই আমার মতো অক্ষম গদ্যকারের পক্ষে সম্ভব না। ক্রিকেট নিয়েই অসামান্য কিছু কথা বলেছেন, কিভাবে ব্যাটসম্যানকে তিনি সংগ্রাম করাতে চান, ক্লোজ-ইন ফিল্ডিংয়ের অর্থ কী, কেন তিন পেসারই সেরা উপায়; এসব আলোচনা করেছেন।
চ্যাম্পিয়নস ট্রফি নিয়ে যে হাওয়াই উন্মাদনা কিংবা টস নিয়ে যে সর্বব্যাপী কৌতুহল সে নিয়ে ছাচাছোলা কথা বলেছেন। এর প্রতিটা বিষয় নিয়ে মহাকাব্য হতে পারে। তবে আমি সময়টাকে ধরে রাখার জন্য চোকার্স প্রসঙ্গে পাশে আর তিনটে বিষয় ধরে রাখতে চাই। জীবনের তিনটে শিক্ষা বলতে পারেন।
জীবনের চ্যালেঞ্জ
প্রতিটি খেলোয়াড়ই তার খেলাকে জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলতে পছন্দ করেন। সাংবাদিকরাও এসব প্রশ্নের ক্ষেত্রে গৎবাঁধা উত্তর পাবেন বলে অপেক্ষা করেন। মাশরাফিকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দলকে জয়ের পথে ফেরানোটা জীবনের অন্যতম চ্যালেঞ্জ ছিলো কি না।
মাশরাফি একটু হাসলেন। একেবারে চমকে দিয়ে বললেন, ক্রিকেট মাঠে কখনো মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ লুকিয়ে থাকতে পারে না, ‘মানুষের জীবনে প্রত্যেকটি দিনই একটা নতুন চ্যালেঞ্জ। চ্যালেঞ্জ বলতে আমি শুধু বুঝি, আমার একটা ছেলে আছে, একটা মেয়ে আছে; তাদেরকে মানুষের মতো মানুষ করে তোলাই আমার চ্যালেঞ্জ। খেলাধুলা অবশ্যই বড় ব্যাপার। তবে জীবনের চেয়ে বেশী চ্যালেঞ্জিং সেটা হতে পারে না।’
পরাজয়ের অপেক্ষা
মাশরাফি যখন অধিনায়ক হলেন, জিম্বাবুয়েকে হোয়াইট ওয়াশ করলেন; একটা লম্বা সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম। প্রথম প্রশ্ন ছিলো, ‘ইস লাইফ বিউটিফুল নাউ?’
মাশরাফি এক গাল হেসে বলেছিলেন, ‘না হারা পর্যন্ত সবই বিউটিফুল। আমি হারের সময়টা দেখতে চাই; জীবন তখন কেমন থাকে, সেটাই দেখতে চাই।’
এই ব্যাপারটা বড় বিস্ময়কর। একজন অধিনায়ক পরাজয় কেন দেখতে চাইবেন!
এই সেদিন মাশরাফি দ্বিতীয় ওয়ানডেতে এসে জয় পাওয়ার পর বললেন তার বোধের কথাটা, ‘আমি এই সময়টা দেখতে চেয়েছিলাম। জয়ের সময় তো সব সুন্দর থাকে, ছন্দে থাকে। কিন্তু আমি হারের ঘরে ঢুকে গেলে দল কেমন আচরণ করে, সেটা দেখতে চেয়েছি। এই সময়টাই হলো খেলোয়াড়দের ক্যারেক্টার শো করার সময়। আমি জয়ের আনন্দে ভাসতে থাকা এক ঝাক খেলোয়াড়ের চেয়ে, হারের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে জীবন দিতে থাকা এক ঝাক ক্যারেক্টার দেখতে চেয়েছিলাম। আমি খুশী যে, আমার দলের খেলোয়াড়রা সেটা দেখাতে পেরেছে।’
আবার জয়ের নেশার কথা
ধর্মপ্রাণ মাশরাফির কাছে কখনোই জাগতিক জয় বা পরাজয় জীবনের প্রতিশব্দ নয়।
জয়ের পেছনে ছোটাটা সবসময়ই তার কাছে অপছন্দের ব্যাপার। সেই কথাটা বেশ কিছুদিন ধরে বলছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টানা তিন ম্যাচ হারের পর খেলাধুলার অর্থেই এই জয়ের নেশার বিপদটা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছিলেন, ‘বিশ্বকাপ থেকে আমরা প্রায় সব ম্যাচই জিতেছি। জিততে জিততে জেতার একটা নেশা তৈরি হয়; এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নেশাটা অতিরিক্ত হতে হতে একটা সময় মানুষ মূল ব্যাপারটা ভুলে যায়; কিভাবে জয় আসে, সেই প্রসেসটা নিয়ে ভাবে না। শুরু থেকেই আমরা যখন জেতা-জেতা করি। মাঝখান থেকে ক্রিকেট অনেক দূরে সরে যায়।’
এখানে লক্ষ্য করুন, ‘জয়’ আর ‘ক্রিকেট’ দুটিকে সমার্থক মনে করছেন না মাশরাফি!
মানে জয় বড়, কিন্তু সেটা কিছুতেই ক্রিকেটের চেয়ে বড় হতে পারে না। জয়ের জন্যই আমরা যে কোনো খেলা খেলি। কিন্তু জয়ের চিন্তা কখনো খেলার চেয়ে বড় হয়ে উঠতে পারে না। তাহলেই খেলার চেতনাটা মরে যায়।
এটাই অলিম্পিক আমাদের শেখাতে চায়। কোটি কোটি কণ্ঠে সেøাগান তুলে, কোটি কোটি ডলার খরচ করে অলিম্পিক যা শেখাতে চায়, মাশরাফি দুই লাইনে তা বলে ফেলেন।
কারণ, তিনি মাশরাফি বিন মুর্তজা।
আমাদের আচার্য্য মাশরাফি; আমাদের জন্য আশ্চর্য মাশরাফি। প্রিয়.কম


শেয়ার করুন