এই ছাত্রলীগ কি সেই ছাত্রলীগ?

বাহরাম খান

‘ছাত্রলীগ’ দেশের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য ঐতিহ্যের অধিকারী ছাত্র সংগঠন। বাংলাদেশ হওয়ার প্রায় দুই যুগ আগে জন্ম নিয়েছিল সংগঠনটি। অর্থাৎ সংগঠনটি গড়ে ওঠে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার কয়েক মাসের মাথায়। ছাত্র সংগঠনটি আওয়ামী লীগ গঠন হওয়ার আগ পর্যন্ত মুসলিম লীগের সঙ্গে প্রায় বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ ছিল। এরপর বাংলাদেশের স্বাধীনতা পর্যন্ত প্রতিটা সংগ্রামে-আন্দোলনে তাদের ভূমিকা অতি-উজ্জ্বল, তাদের সেই অবদান বলার অপেক্ষা রাখে না।

অথচ সেই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা এখন প্রায়শ নেতিবাচক সংবাদের শিরোনাম হচ্ছেন। বুধবারও (১৫ এপ্রিল) দিনাজপুরে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে সংঘর্ষে দুইজন ছাত্রলীগ নেতা নিহত হয়েছেন। এর আগে রংপুর মেডিকেল কলেজ বন্ধ ঘোষণা হয়েছে ছাত্রলীগের অন্তর্কোন্দলের কারণে।

ছাত্র সংগঠনগুলো ছাত্রদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়-আশয়, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ভাষা-সংস্কৃতি ও জাতীয় পর্যায়ের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং বিশেষ করে ছাত্রদের ক্লাস-পরীক্ষা নিয়মিত ও এ সংক্রান্ত যে যে সমস্যা আছে সেগুলো সমাধানে নিজেদের নিয়োজিত রাখবে, স্বার্থ দেখবে— এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু নব্বইপরবর্তী সময়ে ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত এবং বিরোধী দল সমর্থিত ছাত্র সংগঠনগুলোর পারস্পরিক দ্বন্দ্বের কারণে প্রায় তা দেখা যায় না। উল্টো দেখা গেছে এবং যাচ্ছে শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হতে। অথবা শিক্ষাঙ্গনে পবিত্র পরিবেশ চরমভাবে কলুষিত হয়েছে— লাশ হতে হয়ে জ্ঞানার্জন বা মানুষ হতে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের।

দলে দলে বিরোধ ক্রমেই যেমন তীব্র হয়েছে তেমনই ছাত্র সংগঠনগুলোর অন্তর্দ্বন্দ্বও বেগবান হয়েছে অবিশ্বাস্যভাবে। অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে, ক্ষমতায় যে দল যায় সেই দলের সমর্থিত ছাত্র সংগঠনই কেবল ক্যাম্পাসে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে, অবশ্য সঙ্গে দুই-একটি ছোট সংগঠন থাকে বৈকি। এর ফলে, আগে যেখানে পরস্পর বিরোধী দু’টি ছাত্র সংগঠনের সংঘর্ষ হতো এখন সেটা একই সংগঠনের দুই গ্রুপনির্ভর হয়ে পড়েছে।

দুঃখজনক হলেও সত্য, গত ছয় মাসে ছাত্রলীগের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষে কমপক্ষে পাঁচজন প্রাণ হারিয়েছেন। ১৬ এপ্রিল দিনাজপুরে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযু্ক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে দুইজন ছাত্রলীগ নেতা নিহত হয়েছেন, ১৩ এপ্রিল কুমিল্লায় দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন শহর ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুল ইসলাম। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং নভেম্বর মাসে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নিজেদের কোন্দলে আরও দু’টি লাশ পড়েছে।

ক্রমেই যেন এই লাশের সারি দীর্ঘ হয়ে চলেছে। এদের মধ্যে বেশীর ভাগই নিজেরাই নিজেদের সংগঠনের নেতাদের জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিচ্ছেন। কখনো শিকার হয়েছে প্রতিপক্ষ সংগঠনের কেউ, না হয় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে প্রাণ হারানো ১০ বছরের শিশু রাব্বির মতো কেউ।

ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বললে তারা আক্ষেপ করে বলেন, শুধু ছাত্রলীগের ছেলেরা মারামারি করলেই দোষ। অন্যরা করলে মিডিয়া সেভাবে দেখে না। এটা সত্য, ছাত্রলীগের বেশ কিছু নেতাকর্মীকেও ছাত্রশিবিরের হামলার শিকার হয়ে অঙ্গহানী ও প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে ছাত্রলীগকে তুলনা করা যায় না। কারণ ছাত্রলীগ একটি ঐতিহ্যবাহী সংগঠন। এই সংগঠনটি বাংলাদেশের অনেক অর্জনের নেতৃত্ব দিয়েছে।

অথচ ছাত্রলীগের এই সম্মান ও ঐতিহ্যের বিষয়টা মাথায় রেখে যখন কেউ সমালোচনা করেন, তখন তাকে ‘ছাত্রলীগবিরোধী’ হিসেবে তকমা দিয়ে বসেন— এই সংগঠনটিরই শীর্ষ অনেক নেতা। ছাত্রলীগের প্রথম সারির নেতাদের বেশীর ভাগেরই অভিযোগ, সাংবাদিকরা ছাত্রলীগের নাম পেলেই শুধু নেতিবাচক প্রতিবেদন করে। অথচ বাস্তবতা হল, তথ্য প্রমাণ ছাড়া সাংবাদিকরা সংবাদ লিখেন না।

গত দুই বছর যাবত প্রায় সব গণমাধ্যমে ছাত্রলীগের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে কাউন্সিল না হওয়ার বিষয়টিও সমালোচিত হচ্ছে। এ বিষয়ে কোনো সাংবাদিক প্রতিবেদন করলে ছাত্রলীগের কেউ কেউ রুষ্ট হয়ে থাকেন। কেউ কেউ এমন বলেন, ছাত্রলীগ করি আমরা আর কাউন্সিলের জন্য চিন্তা আপনাদের (সাংবাদিক), এর কারণটা কী? এই যদি হয় মূলধারার একটি ছাত্র সংগঠনের শীর্ষ নেতার মন্তব্য তাহলে ছাত্রলীগ কোথায় যাচ্ছে, এবং কেন বারংবার সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা নেতিবাচক খবরের শিরোনাম হচ্ছেন তা অনুমানযোগ্য।

ছাত্রলীগের সর্বশেষ কাউন্সিল হয়েছিল ২০১১ সালের জুলাই মাসে। নিয়ম অনুযায়ী ২০১৩ সালের জুলাই মাসেই কাউন্সিল হওয়ার কথা। এরপর আরও দুই বছরে পা দিয়েছে সেই কমিটি অথচ কাউন্সিলের তারিখ নির্ধারণ হয়নি। ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের অনেকের মতে, সম্প্রতি স্বয়ং শেখ হাসিনা সংগঠনটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে ‘সাবেক’ হতে বলেছেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কাউন্সিলের ঘোষণা আসেনি।

ছাত্রলীগের ‍নেতৃবৃন্দের অনেকে বলছেন, আগামী জুন মাসে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল। এর আগে জননেত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কাউন্সিল চেয়েছেন। এই তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতোমধ্যে ছাত্রলীগে নেতা-কর্মীদের মধ্যে গ্রুপিং-লবিং সক্রিয় হতে শুরু করেছে। তাদের প্রত্যাশা, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পরই হবে ছাত্রলীগের কাউন্সিল। কেউ কেউ অভিযোগ করছে, গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা নেতারা তাদের বিপক্ষ নেতা-কর্মীদের হল থেকে বের করে দিচ্ছেন। পরবর্তী কমিটিতে রাখতে চাইছেন শুধু নিজেদের অনুসারীদের।

কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সম্মেলনে পুরোদেশে সাড়া পড়লেও, বরাবরের মতো মূল কেন্দ্র থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সিটি নির্বাচন নিয়ে সরগরম থাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আপাতত ছাত্রলীগের ভেতরের দ্বন্দ্ব দৃশ্যমান না হলেও নির্বাচনের পর গরম হয়ে উঠতে পারে বলে অনেকের আশঙ্কা। চার বছর যারা কাউন্সিল পাননি তাদের অনেকের বয়স চলে যাচ্ছে। সে কারণে, দীর্ঘদিন সংগঠনে সময় ব্যয় করে যারা নেতা হতে পারছেন না তাদের চোখের সামনে বয়স ক্রাইটেরিয়ায় নেতা বনে যাচ্ছেন জুনিয়ররা। ফলে যারা দীর্ঘদিন ছাত্রলীগ করে এসেছেন, শীর্ষ নেতৃত্বে যাবেন বলে যাদের প্রত্যাশা ছিল— তাদের অনেকেই বাদ পড়ে যাওয়ার চিন্তায় হতাশ। এটাও ছাত্রলীগে কোন্দলের জন্ম দিচ্ছে।

দীর্ঘদিন একই সঙ্গে থেকে জুনিয়ররা নেতৃত্বে চলে এলে সেটা সিনিয়রদের চক্ষুশূলের কারণ হয়। এ সব কারণে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ বৃদ্ধি পাচ্ছে নিশ্চয়ই। এ ছাড়া বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষ নেতারা কমিটি ভাঙ্গা-গড়ার মধ্য দিয়েও অনেক সমস্যার তৈরী করেছেন বলে অনেকের অভিযোগ।

দুই বছরের নেতারা যখন তাদের মেয়াদ শেষে বাড়তি সময় পান তখন তারা আর আগের মতো দায়িত্বশীল থাকেন না। তখন হয়ত এই ভাবনাটাই বড় হয়ে দেখা দেয়— যেকোনো সময়ে চেয়ার সরে যাবে। তাই ক্ষমতায় থাকাকালে যতটুকু করা যায় ‘তাই লাভ’!

ছাত্রলীগের এর আগের কমিটিও প্রায় অর্ধযুগ পার হয়ে কাউন্সিল দিয়েছিল। এবারের কমিটি নিশ্চয়ই তেমন কোনো পরিস্থিতির অবতারণা করবে না বলেই মনে হয়। তবে, ছাত্রলীগের ঊনত্রিশের কাছাকাছি বয়সের নেতা-কর্মীরা যে প্রায় অধৈর্য অবস্থায় আছেন তা তাদের সঙ্গে কথা বললেই বোঝা যায়। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে কথা হচ্ছিল এক ছাত্রলীগ নেতার সঙ্গে। তার অভিমত, বর্তমান কমিটি দুই বছরের জায়গায় চার বছর দায়িত্ব পালন করতে চলেছে। গত কমিটি ছয় বছর থাকলেও ১/১১-এর কারণে অনেকে মেনে নিয়েছিল। এই কমিটির সময়ে তো কোনো সমস্যা নেই। ফলে, এরা যদি আরও সময় নেয় তবে সিটি নির্বাচনের পর ক্যাম্পাসের পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা রয়েছে।

অবস্থাদৃষ্টে যা মনে হচ্ছে, এইভাবে নানা সমস্যা ও সঙ্কট বেড়ে যাচ্ছে অথবা নেতৃত্ব তাদের সুবিধার্থে সমস্যাকে জিইয়ে রাখছে। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী এই ছাত্র সংগঠনটির ভেতরগত সমস্যাগুলো সংশোধন করে তাদের আত্মশুদ্ধির পথে ধাবিত করতে না পারলে অবশ্যই তা একটি নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হবে, যা কেবল সংগঠনের জন্যই নয়, তাদের মুরব্বী সংগঠন আওয়ামী লীগের জন্যই কেবল নয়, দেশের অন্যতম ‍বৃহৎ সংগঠন হিসেবে দেশের জন্যও অশুভকর বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হবে।

সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনার মাধ্যমে যেন সেই ইঙ্গিতই প্রকাশিত হচ্ছে। সেই সতর্ক-বার্তা গ্রহণ করবে কে? ছাত্রলীগের কতিপয় নেতা-কর্মী ক্রমে যে পথে ধাবিত হচ্ছে তাতে মানুষের মনে প্রশ্ন জাগছে— এই ছাত্রলীগ কোন্ ছাত্রলীগ? আসলেই প্রশ্ন সেটাই— এই ছাত্রলীগ কি সেই ছাত্রলীগ?

– See more at: http://www.thereport24.com/article/100224/index.html#sthash.qIpsc4bE.dpuf


শেয়ার করুন