এই ছবিটি যেন ‘বিরল’ হয়ে না থাকে

প্রথম আলো :

দপুর বিমানবন্দরে কুশল বিনিময় করছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ছবি: সংগৃহীত
প্রথমেই আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। তিনি সৈয়দপুর বিমানবন্দরের লাউঞ্জে নিজে গিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে কথা বলেছেন। কুশল বিনিময় করেছেন।

আমাদের রাজনীতিতে প্রতিপক্ষের সঙ্গে কথাবার্তা বলা বিরল উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি সামাজিক অনুষ্ঠানেও ‘ও পক্ষ’ আছে জানলে ‘এ পক্ষ’ গরহাজির থাকাকে শ্রেয় মনে করে। নবম জাতীয় সংসদে যখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সাংসদের একসঙ্গে অধিবেশনে বসতেন, তখনো দেখতাম তাঁরা একে অপরকে গালমন্দ করছেন। পরস্পরকে হেয় করা ছাড়া কোনো কাজ ছিল না। আর বর্তমান সংসদে তো বিএনপি নেই-ই। ফলে দুই দলের নেতাদের দেখা-সাক্ষাতের সুযোগও আর থাকেনি।

এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও বিএনপি মহাসচিবের মধ্যকার কুশল বিনিময় জনমনে কিছুটা হলেও কৌতূহল জাগিয়েছে। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের পর এই প্রথম দুই দলের সাধারণ সম্পাদক পর্যায়ে কুশল বিনিময় হলো। সেই সময়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফারনান্দেজ তারানকোর মধ্যস্থতায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের মধ্যে বৈঠক হয়েছিল। সে সময়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও বিএনপির বর্তমান মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছিলেন ভারপ্রাপ্ত। মির্জা ভারমুক্ত হয়েছেন এবং সৈয়দ আশরাফের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন ওবায়দুল কাদের।

সৈয়দপুর বিমানবন্দরে ওবায়দুল কাদের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। ‘আমরা যেহেতু রাজনীতি করি, তাই আলাপ-আলোচনার পথ খোলা রাখাই ভালো।’ বাংলাদেশের রাজনীতির মূল সমস্যাটিই হলো আলাপ-আলোচনার পথ খোলা না রাখা। সামরিক শাসনামলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা ক্ষমতা জবরদখলকারী এরশাদের সঙ্গে আলোচনা করতে পেরেছেন। কিন্তু এখন দেশের দুই প্রধান দলের নেতারা আলোচনা করতে পারেন না।

রাজনীতিতে আলোচনার পথ খোলা রাখলে একে অপরের অবস্থান বুঝতে সুবিধা হয়। নিজের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরা যায়, অপর পক্ষের যুক্তি খণ্ডনও করা যায়। আর আলোচনার পথ খোলা না থাকলে সন্দেহ-অবিশ্বাস বাড়ে। এই সুযোগে ষড়যন্ত্রকারীরা নানা মতলব আঁটে। রাজনীতি নিশ্চয়ই মল্লযুদ্ধের জায়গা নয় যে দুই দলের নেতারা হাজার হাজার দর্শকের সামনে শক্তি প্রদর্শন করবেন; যিনি জয়ী হবেন, জনগণ তাকে বাহবা দেবে।

হ্যাঁ, রাজনীতিক তথা রাজনৈতিক দল শক্তি প্রদর্শন করবে, তবে সেটি লাঠি-বন্দুক-বোমা-গ্রেনেড ইত্যাদির শক্তিতে নয়। তাঁরা শক্তি প্রদর্শন করবেন জনপ্রিয়তার, জনমতের। আর সে জন্য নির্বাচনই হলো উপযুক্ত জায়গা।

২০১৪ সালে কার পাপে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে পারেনি, কার গোঁয়ার্তুমিতে ১৫৩ জন সাংসদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন, সেই বিতর্কে গিয়ে লাভ নেই। ওই সংসদের মেয়াদ পৌনে চার বছর হয়েছে। বিএনপিও এখন আর আগাম নির্বাচন চায় না। বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষেই নির্বাচন চায়। দেশবাসী দেখতে চায়, আগামী নির্বাচনটি সব দলের অংশগ্রহণে হয়েছে। অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। যে নির্বাচনে ভোটাররা তাঁদের পছন্দসই প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন। ভোট দিয়ে বাড়িতে গিয়ে নিরাপদ থাকবেন। কারও বাড়িতে হামলা হবে না।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পাঁচ বছর পরপর নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে এক দল বা জোট জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। আরেক দল বিরোধী দলের আসনে বসে। এখানে জনগণ দ্বারা কাউকে ‘প্রত্যাখ্যান’ করার কোনো বিষয় নেই। নির্বাচনের পরদিন থেকে জনগণ বিজয়ী দলের কাছ থকে হিসাব নিতে চাইবে নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি পূরণে তারা কী করেছে। ছয় মাসে কী করেছে। এক বছরে কী করেছে। দুই, তিন, চার, পাঁচ বছরে কী করেছে। আওয়ামী লীগ একনাগাড়ে ১০ বছর ক্ষমতায় আছে, তাই তাদের ১০ বছরের হিসাব দিতে হবে। আবার ভোটাররা বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে কী করেছে, তার সঙ্গেও তুলনা করে দেখবেন।

প্রতিটি সরকারের আমলে উন্নয়নমূলক কাজ হয়। একটি সরকার উন্নয়নের পরিকল্পনা করে, আরেকটি সরকারে হয়তো সেই কাজে হাত দিল। কিন্তু পরের সরকার এসে সেই কাজ শেষ করল। উদাহরণ হিসেবে যমুনা সেতুর কথা বলতে পারি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সরকার প্রথমে এর উদ্যোগ নেয়। সম্ভাব্যতা যাচাই করে। কিন্তু কাজটি শুরু হয় খালেদা জিয়ার আমলে। আর শেষ হয় শেখ হাসিনার আমলে। এভাবেই দেশ এগোয়।

ফখরুলের সঙ্গে কুশলবিনিময়ের সময় ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘ঢাকা এয়ারপোর্টে আপনার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। কিন্তু শুনলাম আপনি আসছেন না। একসঙ্গে এলে ভালো হতো। কথা বলা যেত।’ ‘একসঙ্গে এলে ভালো হতো’—আশা করি কাদের সাহেব মন থেকেই কথাটি বলেছেন। একসঙ্গে কেবল বিমানে যাওয়া কেন, একসঙ্গে বসে নির্বাচনের বিষয়েও একটি সিদ্ধান্তে আসুন। দেশের মানুষ আপনাদের অভিনন্দন জানাবে।

রাজনীতিতে মত ও পথের ফারাক থাকবে। আদর্শের দ্বন্দ্ব থাকবে। কিন্তু নেতাদের মধ্যে কথাবার্তা বন্ধ হবে কেন? রাজনীতির লক্ষ্যই তো দেশের উন্নয়ন, জনগণের সেবা। এ কথাটি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা মনে রাখলে অনেক সমস্যারই সহজ সমাধান পাওয়া যেত।

ওবায়দুল কাদের ও মির্জা ফখরুলের কুশল বিনিময়টি বিরল উদাহরণ হয়ে না থেকে মাঝেমধ্যেই তাঁদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ হোক। দেশবাসী তাঁদের হাস্যময় ছবি দেখুক।

সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।


শেয়ার করুন