উৎপাদন খরচ না বাড়লেও বিদ্যুতের দাম বাড়ছে

দ্য রিপোর্ট : বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ না বাড়লেও ফের বাড়ান হচ্ছে বিদ্যুতের দাম। উন্নত গ্রাহকসেবা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ও বিদ্যুতের ভর্তুকি কমানোর কথা বলে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) বিদ্যুৎ উৎপাদন বিতরণী সংস্থা ও কোম্পানির পক্ষে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ প্রস্তাবের ওপর বিইআরসিতে ২০-২৫ জানুয়ারি নিয়ম রক্ষার গণশুনানি অনুষ্ঠিত হবে।

সর্বশেষ ২০১৪ সালের ১৩ মার্চ বিদ্যুতের দাম গড়ে ছয় দশমিক ৯৬ শতাংশ বাড়ান হয়। এ হিসেবে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম বাড়ে ৪০ পয়সা। এর আগে ২০১২ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিদ্যুতের দাম বাড়ান হয়েছিল। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত সাতবার বিদ্যুতের দাম বাড়ান হয়েছে। এবার আরেক দফা বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, গত দুই বছর নতুন কোনো বাড়তি দামের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হয়নি। উৎপাদনে আসেনি নতুন বিদ্যুৎ। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানী তেলের দাম বাড়েনি বরং কমেছে। ফলে উৎপাদন খরচও বাড়েনি। কিন্তু আগে থেকেই যে দাম বেড়ে আছে, সেই ভর্তুকি পূরণ করতেই আবার দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছে সংশ্লিষ্টরা।

বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাবে কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, পাইকারি পর্যায়ে দাম বাড়ালে কেনা-বেচার পার্থক্য বাড়বে। সে জন্য বিদ্যুতের দাম বাড়ান প্রয়োজন। যদিও বিশ্ববাজারে তেলের দাম এখনো বাড়েনি বরং কমেছে। এ কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ না বেড়ে বরং কমেছে। তবুও পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

খুচরা পর্যায়ে বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (বিপিডিবি) ২২ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। এ ছাড়া ডিপিডিসি ১৭ দশমিক ৮৫, আরইবি ২৫ দশমিক ৮৯, ডেসকো ১৭ দশমিক ৪৫ এবং ওজোপাডিকো ২১ দশমিক ৩১ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। অন্যদিকে পাইকারি পর্যায়ে ১৮ দশমিক ১২ শতাংশ এবং সঞ্চালনে ৭০ দশমিক ৪০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। পাইকারি ও সঞ্চালনের দাম সরবরাহকারী কোম্পানির জন্য প্রযোজ্য হবে।

এবারও অল্প বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের জন্য বিশেষ সুবিধা থাকছে। ৩০ ইউনিটের কম ব্যবহারকারীদের জন্য কোনো কোনো কোম্পানি দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেনি। বেশী বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীর দামও বেশী রেখে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। পিডিবি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে বলেছে, আগের চেয়ে গ্রাহকদের খরচ বাড়বে। কিন্তু বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবে। শিল্প ও বাণিজ্যিক গ্রাহকের তুলনায় আবাসিক গ্রাহকের কম হারে দাম বাড়ান হচ্ছে।

এদিকে বিতরণী সংস্থা ও কোম্পানিগুলোর দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের ওপর গণশুনানির জন্য বিইআরসি ২০-২৫ জানুয়ারি দিন ধার্য করেছে। ২০ জানুয়ারি মঙ্গলবার সকাল ১০টায় বিপিডিবির পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ওপর গণশুনানি অনুষ্ঠিত হবে।

২১ জানুয়ারি বুধবার সকাল ১০টায় পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)-এর সঞ্চালন দামের ওপর এবং দুপুর ২টায় ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশনের (ওজোপাডিকো) খুচরা মূল্য বাড়ানোর জন্য গণশুনানি অনুষ্ঠিত হবে। ২২ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় বিপিডিবি ওদুপুর ২টায় ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি)-এর খুচরা মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাবের উওর গণশুনানি অনুষ্ঠিত হবে।

আগামী ২৫ জানুয়ারি রবিবার সকাল ১০টায় বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) ও দুপুর ২টায় ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো)-এর খুচরা মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি অনুষ্ঠিত হবে।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৫-১৬ সালের মধ্যে যে সব কেন্দ্র উৎপাদনে আসার কথা এমন অনেক কেন্দ্রে এখনো কোনো কাজই শুরু হয়নি। এমনকি ২০১৪ সালে যে সব কেন্দ্র উৎপাদনে আসার কথা ছিল তারও অগ্রগতি শূন্য। ২০১৭ সালের মধ্যে উৎপাদন করার অঙ্গীকার করে সাত হাজার ৩০৮ মেগাওয়াটের চুক্তি করা হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে তিন হাজার ৯২৯ মেগাওয়াটের কাজই শুরু করতে পারেনি। এ সব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অর্থ সংস্থানও হয়নি। এর মধ্যে সরকারি প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট। বাকিটা বেসরকারি। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত জাতীয় গ্রিডে মোট যোগ হয়েছে পাঁচ হাজার ১১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। ২০০৯ থেকে ২০১৪ মে পর্যন্ত ১০ হাজার ৮৯৯ মেগাওয়াটের ৭৫টি কেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৪০টি কেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে, যার উৎপাদন ক্ষমতা তিন হাজার ৫৯১ মেগাওয়াট।

বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে বছরে দুই হাজার ৬২ কোটি টাকা আয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে আরইবি ৬৩২ কোটি, পিডিবি ৭২৪ কোটি, ওজোপাডিকো ১০৭ কোটি, ডেসকো ২৫০ কোটি এবং ডিপিডিসির ৩৪৯ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ছয় হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। এ বছরও সমপরিমাণ ভর্তুকি দিতে হতে পারে।

বিশ্ববাজারে জ্বালানী তেলের দাম কমেছে তবু বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ কেন, জানতে চাইলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গণমাধ্যমকে বলেন, শুধু তেল দিয়ে তো আর বিদ্যুৎ হয় না। গ্যাস দিয়েও হয়। এখনো বিদ্যুতে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। আমরা ভর্তুকি কমানোর জন্য দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছি। আস্তে আস্তে বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করা হবে। উৎপাদন খরচের সমান করা হবে।

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী জ্বালানী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম সোমবার বিকেলে দ্য রিপোর্টকে বলেন, সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর যে উদ্যোগ নিয়েছে এই মুহূর্তে আমার কাছে এর কোনো যৌক্তিকতা দেখছি না। কারণ জাতীয় বাজেটে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে, বিশ্ববাজারেও জ্বালানী তেলের দাম কমেছে। এই দুটো বিষয় এক করলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা থাকে না।

কনজুমারস এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম দ্য রিপোর্টকে বলেন, এই মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোনো কারণ দেখছি না। মঙ্গলবার থেকে শুনানি শুরু হচ্ছে। আমরা দাম বাড়ানোর বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরব।

এ ব্যাপারে বিপিডিবি চেয়ারম্যান প্রকৌশলী শাহীনুল ইসলাম খান দ্য রিপোর্টকে বলেন, বিদ্যুতের লোকসান মেটাতে দাম বাড়ান ছাড়া কোনো উপায় নেই।

 


শেয়ার করুন