ঈদের আনন্দে কুতুবদিয়ায় পর্যটকের মিলন মেলা

01নিজস্ব প্রতিনিধি, কুতুবদিয়া :

ঈদের তিন দিন আগে থেকে প্রবল বৃষ্টি হলেও ঈদের দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আলোর মুখ দেখ পর্যটকরা। এর পর থেকে থেমে থেমে ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে কুতুবদিয়া সমুদ্র সৈকতে দেশী-বিদেশী পর্যটকের মিলন মেলায় পরিনত হয়েছে। দেশের মূল ভুখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়া। এই উপজেলা বাতি ঘরের জন্য বিখ্যাত হলেও স্থানীয়ভাবে এটি আওলিয়ার দ্বীপ নামে পরিচিত। এই দ্বীপের মাটিতে শায়িত আছেন শাহ মহিউদ্দিন আবদুল মালেক আল কুতুবী (রাহঃ),কুতুব উদ্দিন(রাহঃ),সোহরাব শাহ (রাহঃ)্, আকবর শাহ্ (রাহঃ)’র মত অসংখ্য আওলিয়াকেরাম। এই দ্বীপের পশ্চিম পার্শ্বে রয়েছে প্রায় ২২ কি.মি দৈর্ঘ্যরে সিলিকা বালি সজ্জিত দৃষ্টি নন্দিত সমূদ্র সৈকত। সৈকতের পাশে দৃষ্টিনন্দন ঝাউ বাগানের সারি যেন পর্যটককে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এখানে রয়েছে বায়ু বিদ্যৎ প্রকল্প, রয়েছে বাতিঘরসহ দেখার মত অনেক কিছু। আওলিয়াকেরামের এই দ্বীপ এক নজর দেখার জন্য প্রতিবছর এখানে ছুটে আসেন দেশ-বিদেশের হাজারো পর্যটক, সমূদ্র সৈকত পরিনত হয় মিলন মেলায়। প্রতিবারের ন্যয় এবারো কুতুবদিয়া সমুদ্র সৈকত দেশী-বিদেশী পর্যটকের পদচারণায় মিলন মেলায় পরিনত হয়েছে। দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার পর পবিত্র ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় করার পর ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পরিবার পরিজনকে নিয়ে ছুটে আসেন অপরূপ সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি কুতুবদিয়ার সমুদ্র সৈকতে। গত বৃহস্পতিবার (ঈদের দিন) থেকে সরেজমিনে পরিদর্শণ করে দেখা যায় সকাল বেলায় পর্যটকের ভিড় কিছুটা কম দেখা গেলেও বিকাল তিনটা থেকে পর্যটকের ভিড় বাড়তে থাকে এমনকি এক সময় সমুদ্র সৈকত এলাকা পর্যটকের পদচারণায় কানায় কানায় ভরপুর হয়ে উঠে। পর্যটকদের সাথে কথা বলে জানা যায় কুতুবদিয়ার বাইরে অবস্থান করা কর্মজীবীরা সরকারী ছুটি কাটাঁতে পরিবার পরিজন নিয়ে কুতুবদিয়ার সমূদ্র সৈকতের সৌন্দর্য্য উপভোগ করার জন্য ছুটে এসেছে। সেই সুবাদে কুতুবদিয়ার সমুদ্র সৈকতে সূর্যাস্থ দেখার পাশাপাশি ছুটে যাচ্ছেন বাতিরঘর ও বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্প দেখার জন্য। সেই সাথে হাতছাড়া করছেন না শাহ্ মহিউদ্দিন আবদুল মালেক আল কুতুবী (রাহঃ)’র মাজার জিয়ারত। গতবারের মত এবারের ঈদের আনন্দকে বাড়িয়ে দিতে স্থানীয়রা সৈমুদ্র সৈকতে টি ষ্টল ও চেয়ার বসিয়ে আয়োজন করেছে নানা ধরনের খেলাধুলার। তার মধ্যে ফুটবলই প্রাধান্য পেয়েছে বেশী। দেখা গেছে এখানে ভ্রমনে আসা পর্যটকদের আনন্দ উপভোগ করার কোন কমতি ছিলনা। পর্যটকদের কোন ধরনের অসুবিধায় পড়তে ও দেখা যায়নি। এখানে নেই কোন সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ কিংবা চোর-ডাকাত। গত মঙ্গলবার বরিশাল থেকে আসা শিশির মনির জানান আমি স্ব-বান্দবে কুতুবদিয়ায় বেড়াতে এসেছি , উঠেছি “সমূদ্র বিলাস” হোটেলে। এখানে সবকিছু ফ্রেস এবং স্বল্প মূল্যে পাওয়া যায়,আমাদের খুব ভালো লাগছে। আরো কয়েকদিন থাকবেন বলে জানালেন তিনি। শুক্রবার ফেনী থেকে আসা পর্যটক রোজিনা আকতার ও স্বামী আসাব উদ্দিন বলেন, গতবারও এসছিলাম আবারো আসলাম। তিনি বললেন এই সৈকত কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত থেকে কোন অংশেই কম নয়। চট্টগ্রাম থেকে ভ্রমণে আসা জেয়াসমিন আকতার জানায়, কুতুবদিয়া সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে এসে খুব ভাল লাগছে। কক্সবাজারের চেয়ে কুতুবদিয়ায় হোটেলে থাকা ও খাওয়া এবং যাতায়তে অনেক কম খরচ হয়। তিনি আরো জানান সমূদ্র বিলাসের মত একটি আধুনিক হোটেল দেখে আরো ভালো লাগছে। পর্যটকরা আর্থিক ভাবেও লাভবান হচ্ছে। চট্রগ্রাম থেকে ভ্রমনে আসা চট্রগ্রাম সরকারি কলেজের ছাত্রী জেয়াসমিন আকতার (মুন্নি), রুজিনা আকতার, তুহিন,ও কুতুবদিয়া কলেজের ছাত্রী জান্নাতুল নাঈমা(হেবেন) বলেন,লোকমুখে শুনেছিলাম চর এলাকা ও দ্বীপাঞ্চলের মানুষ পাষন্ড প্রকৃতির হয় কিন্তু কুতুবদিয়ার মানুষের সাথে মিশে দেখলাম তাদের মত মিশুক লোক অন্য কোথাও আছে কিনা সন্দেহ। এ দ্বীপের মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি, স্বভাব দেখে আমরা সত্যিই মুগ্ধ। বাংলাদেশের মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন ও বঙ্গোপসাগর ঘেঁষা কক্সবাজার জেলার দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়া। জানা যায় ১৬শ সালের শুরু থেকে এ দ্বীপে জনবসতি গড়ে উঠে। সুদূর আরব দেশ থেকে শুভাগমন ঘটে প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন কুতুব আউলিয়া (রাহঃ)’র। ৫শ’ বছর আগে এ কুতুব উদ্দিন আউলিয়ার নামানুসারে কুতুবদিয়া নামকরণ করা হয় বলে জনশ্রুতি রয়েছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা এই দ্বীপের পশ্চিমে উপকূল ঘেঁষে প্রায় ২২ কিলোমিটার দীর্ঘ সমূদ্র সৈকত রয়েছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, লবণ শিল্পে ও মৎস্য শিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ এ কুতুবদিয়ায় জীব বৈচিত্র্যের পাশাপাশি রয়েছে আলি আকবার ডেইলে কুতুব আউলিয়ার মাজার শরীফ,উপজেলা সদর থেকে ৪ কিলোমিটার উত্তরে দক্ষিণ ধুরং আলী ফকির ডেইলের সমূদ্র সৈকত সংলগ্ন ঐতিহাসিক বিখ্যাত বাতিঘর। যার জন্য কুতুবদিয়া দ্বীপ বিখ্যাত। একই গ্রামের সমূদ্র সৈকত হতে ৩ কিলোমিটার পূর্বে কুতুব আউলিয়ার সুযোগ্য উত্তরসুরি হযরত শাহ আবদুল মালেক আল কুতুবী (রহঃ) এর মাজার শরীফ। যেখানে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে প্রতিদিন অসংখ্য ভক্তবৃন্দের আগমন ঘটে। উপজেলা শহর হতে ৭কি.ম. উত্তরে উত্তর ধূরুং এ রয়েছে প্রাচিন স্থাপত্য ঐতিহাসিক কালামার মসজিদ। এ মসজিদে প্রতিদিন অসংখ্য মুসলি¬ম যাওয়া আসা করে। দ্বীপে রয়েছে বিশাল মৎস্য ভান্ডার। এ ছাড়াও রয়েছে উপজেলা সদর হতে ২কিলোমিটার দক্ষিণ আলী আকবর ডেইল এলাকায় সমূদ্র সৈকতে দেশের প্রথম বায়ু বিদ্যুৎ পাইলট প্রকল্প। দৃষ্টিনন্দন সারি সারি ঝাউ বাগনে ঘেরা এই দ্বীপে ভুগর্বস্থ বাংলাদেশের সর্ব বৃহৎ সম্ভাবনাময়ী গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের কথা জানিয়েছে পেট্রোবাংলা।
বিশ্বখ্যাত হনলুলু, ওয়াইকিকি ও সিসিলি এ রকম বিছিন্ন সাগর বেষ্টিত পর্যটন কেন্দ্রের উদাহরণ টেনে স্থানীয় সাংসদ আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, কুতুবদিয়াকে সরকারীভাবে পর্যটন কেন্দ্র ঘোষনা করার জন্য স্থানীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের দীর্ঘদিনের দাবী রয়েছে। জনগণের পক্ষ থেকে আমি বিষয়টি সংসদে উত্থাপন করবো। এছাড়াও বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় বরাবরে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি পত্র প্রেরণ করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন,দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র সেন্টমার্টিন ও কুয়াকাটার তুলনায় কুতুবদিয়া দ্বীপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে দিক দিয়ে কোন অংশেই কম নয়। সেন্টমার্টিন যেহেতু একটি মাত্র ইউনিয়ন।
সমূদ্র বেষ্টিত ৬ ইউনিয়ন বিশিষ্ট কুতুবদিয়া দ্বীপের পশ্চিমে রয়েছে ২২ কিলোমিটার দীর্ঘ সমূদ্র সৈকত। দ্বীপের পূর্বে চ্যানেল সংলগ্ন কুতুব আউলিয়ার সুযোগ্য উত্তরসুরি হযরত শাহ আবদুল মালেক আল কুতুবী (রহঃ) এর মাজার শরীফ। মাজারের পূর্বদিকে বিসিক’র বিশাল লবণ উৎপাদন প্রদর্শনী খামার। লবণ মৌসুমে প্রতিদিন দেশী-বিদেশী, গবেষক, প্রযুক্তিবিদ ও কবি লেখক লবণ উৎপাদন প্রক্রিয়া স্ব-চুক্ষে দেখতে আসেন।
এ দ্বীপে দেশী-বিদেশী পর্যাটক আসছে দাবি করে কুতুবদিয়া মগনামা ঘাট ইজাদার সাবের কুম্পানী বলেন, প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ডেনিশ বোট ও স্পীট বোটে কমপক্ষে ৫ হাজার যাত্রী পারা পার করে। নগর জীবনের কর্মব্যস্থতার এক ফলকে স্বীয় মনমানসিকতাকে সতেজ ও সমৃদ্ধ করতে কয়েকদিনের জন্য প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের রানী কুতুবদিয়ায় ভ্রমণে আসলে নিঃসন্দেহে মন প্রাণ জুড়িয়ে যাবে দাবি করেন কুতুবদিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এ,টি,এম, নুরুল বশর চৌধুরী ।তিনি আরো বলেন,কুতুব আউলিয়ার মাজার,শাহ আব্দুল মালেক মাজার, ঐতিহাসিক বাতিঘর, প্রাচীন স্থাপত্য কালারমার মসজিদ, বিশাল মৎস্য ভান্ডার ও দেশের প্রথম বায়ু বিদ্যুৎ পাইলট প্রকল্প স্ব-চুক্ষে দেখলে পর্যাটকরা আনন্দের শেষ প্রান্তে পৌছে যায়।
কুতুবদিয়া উপজেলা আ’লীগের সভাপতি সাবেক ছাত্রনেতা ও বড়ঘোপ বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটির সচিব আওরঙ্গজেব মাতবর বলেন, সরকার সুদৃষ্টি দিলে অপার সম্ভাবনাময় সাগর কন্যা কুতুবদিয়া হতে পারে দেশের উল্লে¬খ যোগ্য পর্যটন কেন্দ্র। এখানে অন্যান্য পর্যটন জোনের ন্যায় সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ নেই। অত্যান্ত সুলভ মূল্যে থাকা এবং প্রেশ খাবার পাওয়া যায়। পর্যটকদের কোন ধরনের অসুবিধায় পড়তে হয়না। পর্যটকদের সুবিধার্থে আমরা বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটির পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষক ঠিম গঠন করে কোন পর্যটক হয়রানির হচ্ছে কিনা তা তদারকী করে থাকি। কেউ করে থাকলে সাথে সাথে আইনি ব্যবস্থা নিয়ে কঠোর শাস্তি নেওয়া হয়।
ইউপি চেয়ারম্যান এড়ভোকেট ফরিদুল ইসলাম,নূরুচ্ছাফা বি.কম, জলাল আহম্মদ বি এ (অনার্স),আ.শ.ম শাহারিয়ার চৌধুরী ও মানবাধিকার কর্মী এইচ এম রাসেল বলেন, পর্যটকদের কোন ভোগান্তির শিকার হতে হয়না ও চলাফেরার যথেষ্ট সুযোগ সুবিধা রয়েছে। চলতি বর্ষা মৌসুমেও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে কুতুবদিয়ায় প্রচুর পর্যটক আসছে। এ রকম বিছিন্ন সাগর বেষ্টিত পর্যটন কেন্দ্র দ্বীপকে আধুনিকায়নের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।
যেভাবে আসতে হবে-দেশের যে কোন প্রান্ত থেকে গাড়িযোগে চট্রগ্রাম অথবা কক্সবাজার। এস,আলম বা যেকোন বাসে করে পেকুয়া উপজেলার মগনামা ঘাটে আসতে হবে। ঐ ঘাট থেকে এক ঘন্টা পর পর ডেনিশ বোট ছাড়ে। ্আর যেকোন সময় স্পীট বোট পাওয়া যায়। কুতুবদিয়া চ্যানেল পার হতে সময় লাগে স্পীড বোটে ৬-৮ মিনিট এবং ডেনিশ বোটে -২৫-৩০ মিনিট ।


শেয়ার করুন